বড় ঋণগ্রহীতাদের কাছে জিম্মি ব্যাংক খাত
প্রভাবশালী কয়েকজন ঋণগ্রহীতাদের কাছে আটকে পড়েছে দেশের ব্যাংকিং খাত। ৫৫টি ব্যাংক বড় অংকের এসব গ্রাহকদের ঋণ দিয়েছে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ কোটি টাকা। যা মোট বিতরণ করা ঋণের প্রায় ৩৬ শতাংশ। আর ব্যাংকগুলোর মোট মূলধনের ২৩৩ শতাংশ বা দ্বিগুনেরও বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিভিন্ন চাপে বড় বড় অঙ্কের ঋণ দিয়ে অধিকাংশ ব্যাংকই এখন নগদ টাকার সংকটে পড়েছে। কারণ বেশির ভাগ বড় ঋণগ্রহীতা ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করছেন না। যার প্রভাব পড়ছে মূলধনের ওপর। সে কারণে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে মূলধন সংরক্ষণ করতে পারছে না অধিকাংশ ব্যাংক।
তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বড় গ্রাহকদের ক্ষেত্রে রিলেশনশিপ ব্যাংকিং থেকে বের হয়ে নতুন উদ্যোক্তাদের ঋণ প্রদানে মনোযোগী হতে হবে। রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, সঠিক নিয়মনীতি মেনেই ঋণ দেয়া উচিত। এছাড়া খেলাপিদের আইনের আওতা এনে উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় প্রভাবশালীরা দুর্নীতির মাধ্যমে ঋণ নিতেই থাকবে। আর দিন দিন খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়বে।
সাধারণত কোনো গ্রাহক কোনো একটি ব্যাংকের মূলধনের ১০ শতাংশের বেশি ঋণ নিলেই তা বড় অঙ্কের ঋণ হিসেবে গণ্য হয়। ব্যাংক একজন গ্রাহককে ১৫ শতাংশের বেশি ঋণ দিতে পারে না। এর বেশি দিতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হয়। আর বাংলাদেশ ব্যাংকও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি ঋণ বিতরণের অনুমোদন দিতে পারে না। সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির আর্থিক পরিস্থিতি যাচাই-বাছাই করে দেয়া হয়।
কিন্তু বড় ঋণ গ্রহীতারা প্রভাব খাটিয়ে এর চেয়ে অনেক বেশি ঋণ নিয়ে যায়। পরে ওই অর্থ পরিশোধ না করে ঋণ পুনর্গঠনের নামে উচ্চ আদালতে রিট করে, আবার কখনো কোনো ডাউন পেমেন্ট না দিয়েই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিশেষ সুবিধা নিয়ে ঋণ নবায়ন করে নেয়। এসব কারণে ব্যাংকের ঋণ আদায় কমে যাচ্ছে। ফলে খেলাপি ঋণ বাড়ার পাশাপাশি বাড়ছে ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয়। আর এই ব্যয় সমন্বয় করতে গিয়ে বিভিন্ন চার্জের নামে সাধারণ গ্রাহকদের থেকে অতিরিক্ত অর্থ নিতে হচ্ছে ব্যাংকগুলোকে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, উপরের লেভেলের চাপেই বড় ঋণগুলো দেয়া হয়। এমন ব্যক্তি সুপারিশ করে যে ঋণ না দিয়ে পারা যায় না। আর এসব ঋণ পরে খেলাপি হয়ে যায়।
জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে একটি গ্রুপ ব্যাংকের মূলধনের সর্বাধিক ২৫ শতাংশ পর্যন্ত নগদে ঋণ নিতে পারে। এভাবে একই ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান একাধিক ব্যবসায়ী গ্রুপ সৃষ্টি করে ব্যাংকের মূলধনের চেয়ে বেশি ঋণ নিয়ে যাচ্ছে। সাধারণত বড় শিল্পগোষ্ঠীগুলো নিজেদের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে একাধিক গ্রুপ তৈরি করে আইনের ফাঁক দিয়ে ওইসব প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যাংকের অর্থ নিয়ে যাচ্ছে।
গত বছরের অক্টোবরে করা বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, অগ্রণী ব্যাংকের মোট মূলধন ৩ হাজার ৫৩ কোটি টাকা। কিন্তু ব্যাংকটি বড় অঙ্কের ঋণ দিয়েছে ৭ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা। যা মূলধনের ১৯৯ শতাংশ। জনতা ব্যাংকের ২ হাজার ৯৭৯ কোটি টাকার মূলধনের মধ্যে বড় অঙ্কের ঋণ দিয়েছে ১৩ হাজার ৩৭৭ কোটি টাকা, যা মোট মূলধনের ৩৬৫ শতাংশ। একইভাবে সোনালী ব্যাংক ৫৪৬ শতাংশ এবং রূপালী ব্যাংক ৫৫৫ শতাংশ ঋণ দিয়েছে মোট মূলধনের। এভাবে ৫৫টি ব্যাংকের মোট ৯০ হাজার ১৩১ কোটি টাকার মূলধনের বিপরীতে বড় ঋণগ্রহীতাদেরকে ঋণ দিয়েছে প্রায় সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকা। এ ঋণ ব্যাংকগুলোর মোট মূলধনের ২৩৩ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, বড় অঙ্কের ঋণ ঠেকাতে আইনের সংশোধনসহ কেন্দ্রীয় ব্যাংককে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। অন্যথায় ব্যাংকিং খাতের বিপর্যয় ঠেকানো যাবে না।
এসব গ্রাহকদের থেকে কিভাবে মুক্তি মিলবে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন বলেন: ব্যাংকগুলো রিলেশনশিপ ব্যাংকিংয়ে ঝুঁকে পড়ছে। অর্থাৎ একবার যাদের ঋণ দেয়া হয়, সম্পর্ক রাখতে গিয়ে বারবার তাদের ঋণ দেয়া হয়। কারণ ব্যাংকগুলো মনে করে, তারা প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। তাদের অর্থের প্রবাহ ও সম্পদ দৃশ্যমান। আর এভাবেই বড় বড় গ্রাহকদের কাছে অর্থ চলে যায়। এই প্রবণতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
ব্যাংকিং খাতের নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি করা উচিত হলেও দুর্ভাগ্য যে তারা এটা করছে না, মন্তব্য করে তিনি বলেন: নতুন ও অপেক্ষাকৃত ছোট ব্যবসায়ীদের বেশি ঋণ দেয়া হয় না। কারণ ব্যাংক তাদের নগদ টাকার প্রবাহ, মুনাফা, সম্পদ, আর্থিক ভিত্তি ইত্যাদি বিবেচনা করে। তবে অনেকের এগুলোতে সমস্যা থাকলেও তাদের ঋণ পরিশোধ করার ক্ষমতা থাকে।
ড. সালেহ উদ্দিন বলেন: বড় গ্রাহকদের থেকে মুক্তি পেতে ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পরিষদকে কঠোর হতে হবে। সম্পর্ক নয়, নিয়মনীতির মধ্যে ঋণ বিতরণ করতে হবে। অন্যথায় এই পথ থেকে মুক্তি মিলবে না।
এটি নতুন নয়, দীর্ঘদিন থেকে হয়ে আসছে উল্লেখ করে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন: বড় গ্রাহকদের ঋণ পুন:তফসিল করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংককে কঠোর নীতি অবলম্বন করতে হবে।
‘তবে এ ক্ষেত্রে স্ব স্ব ব্যাংককে ঋণ পুন:তফসিলীকরণের বিষয়ে কঠোর হতে হবে বেশি। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক স্বপ্রণোদিত হয়ে পুন:তফসিল করে না। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের অনুরোধে করে থাকে।’
তিনি বলেন: পুন:তফসিল করার আগে ঋণ দেয়া ব্যাংকগুলোর চিন্তা করা উচিত ওই ঋণ ফেরত পাবে কি না কিংবা অন্যভাবে অর্থ আদায় করা যায় কি না।
মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন: সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি থাকলে এভাবে খেলাপি হতেই থাকবে। যদি এমন করা যায় যে, রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ দেয়া যাবে না এবং খেলাপিদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করা যায় তাহলে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র দেবাশীষ চক্রবর্তী কোনো কোনো গ্রাহক ব্যবসায়ীকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, বা অন্য কোনো কারণে ঋণ পরিশোধ করতে পারে না। আবার কেউ কেউ ইচ্ছাকৃত ঋণের অর্থ ফেরত দেয় না।
সবগুলো ঋণের গ্রাহক যে ভাল হবে তা নয় এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, ঋণ প্রদানকারী গ্রাহকদেরও অনেক দায়িত্ব রয়েছে। গ্রাহকরা ওই টাকা কি করবে, তাদের মূলধন কেমন, কি ধরণের ব্যবসা, সম্পদ কেমন, ভালো গ্রাহক কি না এসব বিষয় যাচাই করে ব্যাংকগুলোর ঋণ দেয়া উচিত।-খবর চ্যানেল আই অনলাইনের।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন