ভারতীয় সেনাবাহিনীতে ৩০ বছর চাকরি, এখন ‘অবৈধ বাংলাদেশি’
ভারতীয় সেনাবাহিনীতে ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চাকরি করার পর আসাম পুলিশের কাছ থেকে ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ হিসেবে নোটিশ পেয়েছেন গুয়াহাটির বাসিন্দা মহম্মদ আজমল হক।
ভারতীয় সেনাবাহিনীতে ৩০ বছরের কর্মজীবন শেষে গত বছরই জুনিয়র কমিশনড অফিসার হিসেবে অবসর নিয়েছেন মহম্মদ আজমল হক।
দেশের বাড়ি, আসামের রাজধানী গুয়াহাটির কাছে ছায়াগাঁওতে যখন নিশ্চিন্তে বাকি জীবনটা কাটাবেন বলে সবে থিতু হয়েছেন, তখনই তার কাছে আসাম পুলিশের নোটিশ এসেছে- তিনি নাকি অবৈধভাবে বাংলাদেশ থেকে ভারতে এসেছিলেন।
হক বলেন, আমি ভারতের নাগরিক। ৩০ বছর ধরে দেশের সেবা করেছি। এখন অবসর নেয়ার পর বালবাচ্চা নিয়ে গুয়াহাটিতে নিজের বাড়িতে থাকি। আর আচমকা আমাকে নোটিশ পাঠিয়ে বলা হচ্ছে- আমি নাকি অবৈধ। আমি নাকি ১৯৭১-এর পর আসামে এসেছি!
অথচ সেনাবাহিনীতে নিয়োগ পাওয়ার সময় এই আসাম পুলিশই তাকে ভারতের নাগরিক হিসেবে ভেরিফাই করেছিল; আর এখন তারাই আবার তার নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।
আজমল হক বলেন, এটাই তো আমি ভেবে পাচ্ছি না। কারণ যখন একজন জওয়ান ভারতীয় সেনায় ভর্তি হয়, পুলিশ তার প্রপার ভেরিফিকেশন করে। পুলিশ তার গ্রামে গিয়ে বাবা-মায়ের কাগজপত্র খতিয়ে দেখে। বংশ-পরিচয় খোঁজ নিয়ে এরপরই তাদের রিপোর্ট পাঠায়। তারপরই আমাদের ‘কসম প্যারেড’ হয়। এত কিছুর পরও আজ যে তাদের সন্দেহ হচ্ছে- এটি আমার জন্য অত্যন্ত দুঃখের, অপমানের ও লজ্জার বিষয়!
বিবিসি বাংলাকে আজমল হক বলেন, এটি কিন্তু আমার প্রাপ্য ছিল না। রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালাম সাহেব আমাকে সেনাবাহিনীতে জেসিও হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। ৩০ বছর ধরে দেশের হয়ে বিভিন্ন কঠিন পোস্টিংয়ে যুদ্ধ পরিস্থিতিতে আমি ডিউটি করেছি। তার পরও যদি দেশের মানুষ বা আসাম সরকার আমাকে এভাবে চরম অপমান করে, আমি শুধু ন্যায্য বিচারই দাবি করব।
আসামের মানবাধিকার আইনজীবীরা বলছেন, সে রাজ্যে যে রকম ঢালাওভাবে বাংলাভাষী মুসলিমদের কাছে অবৈধ বিদেশি হিসেবে নোটিশ পাঠানো হচ্ছে, আজমল হকও তার সাম্প্রতিকতম ভিকটিম এবং বাংলাদেশি খোঁজার এই হিড়িকে আসামে লাখ লাখ মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তোলা হচ্ছে।
আসলে আজমল হক হলেন আসামের সেই লাখ লাখ বাঙালি মুসলিমদের একজন , যাদের অবৈধ বিদেশি বলে ঢালাও নোটিশ পাঠানো হচ্ছে আর ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে হাজির হয়ে তাদের ভারতীয়ত্ব প্রমাণ করতে হচ্ছে।
এ রকম বহু কেস নিয়ে লড়ছেন রাজ্যের শীর্ষস্থানীয় মানবাধিকার আইনজীবী আমন ওয়াদুদ। তিনি বলেন, কেউ কিন্তু আজমল হকের কাছে কোনো কাগজ বা নথিপত্র চায়নি। কোনো তদন্ত ছাড়াই বলে দেয়া হচ্ছে যে তিনি নাকি ১৯৭১-র পর বাংলাদেশ থেকে আসামে এসেছিলেন। আর এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; আসামে লাখ লাখ লোকের সম্পর্কে কোনো তদন্ত না করেই পুলিশ তাদের অবৈধ অভিবাসী বা বাংলাদেশি বলে রিপোর্ট করে দিচ্ছে!
আইনজীবী আমান ওয়াদুদ বলেন, ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে কিন্তু শতকরা আশি ভাগ কেসই ভারতীয় নাগরিক বলে প্রমাণিত হচ্ছে। তার মানে এটাই যে, পুলিশ কোনো ঠিকঠাক তদন্ত ছাড়াই এ রিপোর্টগুলো দাখিল করে দিচ্ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তো কোনো তদন্তই হয় না।
বিবিসিকে এই আইনজীবী বলেন, পরিস্থিতি খুব গুরুতর। এ মুহূর্তে রাজ্যের ছটি ডিটেনশন শিবিরে হাজারখানেকেরও বেশি লোক আটক আছেন। বাংলাদেশও তাদের নেবে না; আর কেনই বা নেবে, তারা তো আসলেই ভারতীয় নাগরিক।
এদিকে মহম্মদ আজমল হক বলেন, পাঁচ বছর আগে তিনি যখন সেনাবাহিনীর সার্ভিং অফিসার, তখন তার স্ত্রীও এ ধরনের নোটিশ পেয়েছিলেন।
তিনি বলেন, তখন আমি চণ্ডীমন্দির ক্যান্টনমন্টে পোস্টেড। আমার স্ত্রীও সঙ্গেই ছিলেন। দেশ থেকে জানানো হল- আমার স্ত্রীর নামে নাকি নোটিশ এসেছে- তিনি বিদেশি। সঙ্গে সঙ্গে আমি ছুটে গিয়ে কোর্টে সব কাগজপত্র জমা দিলাম। মহামান্য আদালত রায় দিলেন- না, মমতাজ খানম ওয়াইফ অব আজমল হক অবশ্যই ভারতের একজন বৈধ নাগরিক।
‘আমাদের গ্রামেই তো অন্তত ৪০ জনের বিরুদ্ধে এ রকম বিদেশি বলে নোটিশ এসেছে। কিন্তু আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি- চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে পারি, তারা সবাই নিজেদের ভারতীয় বলে প্রমাণ করতে পারবে’, খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেন আজমল হক।
আগামী ১৩ অক্টোবর ট্রাইব্যুনালে গিয়ে ভারতের এই সাবেক সেনা নিজের নাগরিকত্ব হয়তো প্রমাণ করতে পারবেন কিন্তু ঠিকঠাক কাগজপত্র না থাকা আসামের লাখ লাখ বাঙালি মুসলিম কিছুতেই ততটা আশাবাদী হতে পারছেন না।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন