মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা যাচাই করছে মন্ত্রণালয়

ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদে বেশি চাকরি শিক্ষক, ব্যাংক ও পুলিশে

ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদ নিয়ে এখনো সরকারি চাকরিতে কর্মরত আছেন মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার মধ্য ভাটেরচরের বাসিন্দা মৃত রজব আলী দেওয়ানের ছেলে মো. আব্দুল হক। তিনি গজারিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত। তার তিন সন্তানও ‘মুক্তিযোদ্ধার সন্তান’ কোটায় চাকরি করছেন। এক ছেলে পুলিশ বাহিনীতে, আরেক ছেলে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ে এবং আরেক জন সুপ্রিম কোর্টে চাকরিরত।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গজারিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয়ে উপজেলার প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই সংক্রান্ত সভা হয়। সভায় উপজেলার হালনাগাদ জীবিত ও মৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা যাচাই-বাছাই করা হয়। তালিকা যাচাইয়ে আব্দুল হক ও তার তিন সন্তানের বিষয়টি ধরা পড়ে। সভায় জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় থাকা মো. আব্দুর রশিদ (রাশেদ) এবং মো. সামছুল আলমের মুক্তিযোদ্ধার সনদের পক্ষেও কোনো তথ্য-প্রমাণ মেলেনি।
সভার কার্যবিবরণী থেকে জানা যায়, রাশেদ ও সামছুল আলম মুক্তিযোদ্ধা কোটায় সরকারি চাকরি নিয়েছেন। পরবর্তী সময় চাকরির বয়স দুই বছর বাড়িয়েছেনও। ভুয়া সনদে শুধু সরকারি চাকরি নেওয়াই নয়, দুর্নীতির মাধ্যমে বাড়ি-গাড়িসহ বিপুল অর্থেরও মালিক বনেছেন। স্ত্রী-সন্তানদের নামেও রয়েছে অনেক সম্পদ। বিষয়টি সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)সহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন স্থানীয় প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় এভাবে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের সরকারি চাকরি নিয়ে কর্মরতদের তালিকা করা হচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধা কোটায় সরকারি চাকরি পাওয়া এখন পর্যন্ত ৮৪ হাজার ৫৬ জনের তথ্য পাওয়া গেছে।
অভিযোগ রয়েছে, তাদের মধ্যে বেশকিছু আছেন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। তারা ভুয়া সনদ তৈরি করে চাকরি নিয়েছেন। এছাড়া সারা দেশে মুক্তিযোদ্ধার ভাতাভোগীদের মধ্যে কারা ভুয়া, সেই তালিকাও করা হচ্ছে। ভাতা হিসেবে তারা যে টাকা পেয়েছেন, সেই অর্থ ফেরত নেওয়া হবে। যাদের বিরুদ্ধে ভুয়া সনদে চাকরি নেওয়ার প্রমাণ পাওয়া যাবে, তাদের বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে তাৎক্ষনিকভাবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ পাঠাবে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়।

তালিকা থেকে ‘অমুক্তিযোদ্ধাদের’ নাম স্বেচ্ছায় প্রত্যাহার করে নিতে বলেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। ইতিমধ্যে ‘অমুক্তিযোদ্ধা শনাক্তকরণ অভিযোগ ফরম’ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়েছে। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা, ভাতা প্রদানসহ অন্যান্য তথ্য ‘ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম’ বা এমআইএস নামের একটি সফটওয়্যারে হালনাগাদ করে থাকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়।

এমআইএসের তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন বীর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ১ লাখ ৯৭ হাজার ৮০০। এর মধ্যে মাসিক ভাতা পান ১ লাখ ৯৬ হাজার ৪৫৪ জন। গত ২০ নভেম্বর জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) পুনর্গঠন করা হয়।

মুক্তিযোদ্ধার ‘সংজ্ঞা’ নির্ধারণসহ তালিকা প্রণয়ন-সংশোধনের কাজটি করে জামুকা। পুনর্গঠিত জামুকা গত ২৪ নভেম্বর ও ২ ডিসেম্বর দুটি বৈঠক করেছে। বৈঠকে জামুকা আইন সংশোধন, মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা নতুনভাবে নির্ধারণ, মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাওয়ার সর্বনিম্ন বয়স ঠিক করা, মুক্তিযোদ্ধাদের নামের আগে ‘বীর’ শব্দের ব্যবহার যৌক্তিক কি-না; এসব বিষয়ে আলোচনা হয়। পুনর্গঠিত জামুকার চেয়ারম্যান মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম। সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ইসরাত চৌধুরী, মেজর জেনারেল (অব.) আজিজুর রহমান বীর-উত্তম, ক্যাপ্টেন (অব.) নুরুল হুদা, মেজর (অব.) সৈয়দ মুনিবুর রহমান, মেজর (অব.) কাইয়ুম খান, ইসতিয়াক আজিজ উলফাত, সাদেক আহমেদ খান, হাবিবুল আলম বীরপ্রতীক, খ ম আমীর আলী। কমিটির সদস্য-সচিব জামুকার মহাপরিচালক শাহিনা খাতুন।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম গত আগস্টে মুক্তিযোদ্ধা কোটার চাকরিধারীদের তালিকা করার নির্দেশনা দেন। এরপর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরিরতদের তথ্য জানাতে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে চিঠি দেয়। সূত্র জানায়, এপর্যন্ত বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ থেকে পাঠানো তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় সরকারি চাকরি নিয়ে কর্মরত ৮৪ হাজার ৫৬ জন। তবে দু-একটি দপ্তর থেকে এখনো তথ্য পাওয়া যায়নি। সে তথ্য আসার পর এই সংখ্যা কিছুটা বাড়তে পারে। জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আসা তালিকার অর্ধেক যাচাই করা হয়েছে। এর মধ্যে অনেকের মুক্তিযোদ্ধার সনদ খুঁজে পাওয়া যায়নি। যাচাই-বাছাই শেষ করে শিগিগরই তাদের তালিকা চূড়ান্ত করা হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ তাদের অধীন প্রতিষ্ঠানগুলোতে ৫৬ জন মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরিতে থাকার তালিকা দিয়েছে। তাদের মধ্যে ছয় জনের সনদের তথ্য পায়নি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। বেশ কয়েক জনের সনদে থাকা নামে ভুল এবং কয়েক জনের নাম সনদে পাওয়া গেলেও মন্ত্রণালয়ের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমে (এমআইএস) পাওয়া যায়নি।

বর্তমানে সরকারি চাকরিতে মেধায় ৯৩ শতাংশ; মুক্তিযোদ্ধা, শহিদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনাদের সন্তানদের জন্য ৫ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ১ শতাংশ এবং শারীরিক প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১ শতাংশ কোটা রয়েছে। গত ২৩ জুলাই কোটাপদ্ধতি সংশোধনের আগে মুক্তিযোদ্ধার পোষ্যদের জন্য ৩০ শতাংশসহ ৫৬ শতাংশ কোটাধারীদের জন্য বরাদ্দ ছিল। জানা গেছে, সরকারি চাকরিতে বেসামরিক প্রশাসনে এখন ১৪ লাখ ৪৩ হাজার ৫১৮ জন কর্মরত। তাদের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি নিয়ে কর্মরত ৮৪ হাজার ৫৬ জন। এ হিসাবে ৫ দশমিক ৮২ শতাংশ কর্মচারী মুক্তিযোদ্ধা কোটার।

এদিকে, মুক্তিযোদ্ধাদের সব ধরনের তালিকা যাচাই করে ২ লাখ ৬ হাজার ৫১ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার বিস্তারিত তথ্য সমন্বিত তালিকা প্রকাশ করেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। কয়েক জনের আপিল আবেদন নিষ্পত্তি না হওয়ায় সমন্বিত তালিকায় আরো কিছু নাম অন্তর্ভুক্ত করা হবে। তাদের মধ্যে যাদের নাম এমআইএসে রয়েছে, তারা ভাতা পাচ্ছেন। কোটায় নিয়োগ পাওয়াদের মধ্যে যাদের নাম কোনো তালিকায়ই নেই, তাদের ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় ফেলা হচ্ছে। যাদের নাম সমন্বিত তালিকায় নেই; কিন্তু এমআইএসে আছে, সেগুলো পর্যালোচনা করা হচ্ছে। এমনও হতে পারে, সনদ বাতিল হওয়ার পর এমআইএসে তথ্য হালনাগাদ করা হয়নি।

মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে সব থেকে বেশি চাকরিতে কর্মরত। এরপর মুক্তিযোদ্ধা কোটায় পুলিশে চাকরি নেওয়ার সংখ্যা বেশি। এখন পর্যন্ত ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদে ব্যাংকে চাকরি নেওয়ার সংখ্যা বেশি পাওয়া গেছে, তারপর পুলিশে।
সূত্র:ইত্তেফাক