ভোট গণনার সময় কারচুপির কতটুকু ঝুঁকি রয়েছে?


বাংলাদেশের এবারের নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ও সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রথম থেকেই নানা ধরণের আপত্তি তুলেছে বিরোধী দলগুলোর জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট।
ভোট গ্রহণ এবং ভোট গণনার সময়েও বিভিন্ন ধাপে কারচুপি হতে পারে – এরকম আশঙ্কাও প্রকাশ করেছে তারা।
যদিও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন ভোট কারচুপি করে নির্বাচনে জেতার কোন অভিপ্রায় তার সরকারের নেই।
কিন্তু ভোট গণনার সময় কারচুপির বা জালিয়াতির সুযোগ রয়েছে কতটা? আসলেই কী গণনার সময় জালিয়াতির সুযোগ রয়েছে।
নির্বাচন কমিশনের সাবেক উপ-সচিব জেসমিন টুলি’কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল বাংলাদেশে কী পদ্ধতিতে ভোট গণনা করা হয়।
কোন পদ্ধতিতে ভোট গণনা করা হয়?
জেসমিন টুলি জানান একটি কেন্দ্রের সব কক্ষের ব্যালট বাক্স সাধারণত প্রিজাইডিং অফিসারের পছন্দ অনুযায়ী ঐ কেন্দ্রের কোনো একটি কক্ষে একত্রিত করা হয়।
“ব্যালট বাক্স একত্রিত করার পর সবগুলো বাক্সের ব্যালট একসাথে ঢালবেন প্রিজাইডিং অফিসার, তারপর প্রতীকের ভিত্তিতে ব্যালটগুলোকে ভাগ করবেন”, বলেন মিজ. টুলি।
গণনা শুরু হওয়ার পর প্রতীকভেদে ব্যালট আলাদা করে রাখা শুরু করবেন তিনি।
তবে যেসব ব্যালট দেখে পরিষ্কার বোঝা যায় না যে কোন প্রতীকে সিল পড়েছে, সেসব ব্যালট আলাদাভাবে রাখবেন প্রিজাইডিং অফিসার।
“কোনো ব্যালটে দুইটি মার্কাতে ভোট দেয়া থাকলে, সিল পরিষ্কারভাবে না পড়লে কোনো প্রার্থীর অনুকূলে ঐ ভোট গণনা করা হবে না।”
এই বাতিল হওয়া ভোটগুলো প্রিজাইডিং অফিসার আলাদাভাবে রেখে থাকেন।
এরপর সিলভিত্তিক সবগুলো ব্যালট ভাগ হয়ে গণনা শেষ হলে প্রিজাইডিং অফিসার সবার উপস্থিতিতে ঘোষণা করবেন যে কোন প্রার্থী কতগুলো ভোট পেলেন।
গণনা শেষে সবগুলো ব্যালট – টেন্ডার ভোট, চ্যালেঞ্জ ভোট, বাতিল বা নষ্ট হয়ে যাওয়া ব্যালটগুলো সহ – একটি বস্তায় ভরে সেটিতে সিলগালা করে দেন প্রিজাইডিং অফিসার।
মিজ. টুলি বলেন, “এরপর প্রিজাইডিং অফিসার তার কাছে দেয়া ফলাফলের কাগজগুলোতে অঙ্কে এবং সংখ্যায় প্রার্থীদের প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা লিখে কয়েকটি কপি তৈরি করেন।”
এরপর সেই ফলাফলের কাগজগুলোতে পোলিং এজেন্টরা স্বাক্ষর করতে চাইলে করতেও পারেন, তাদের আপত্তি থাকলে স্বাক্ষর নাও করতে পারেন; সেই ফলাফলের কাগজের এক কপি রিটার্নিং অফিসার বা সহকারী রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে পাঠিয়ে দেন প্রিজাইডিং অফিসার।
একটি কপি কেন্দ্রের এমন একটি স্থানে টাঙ্গানো হয় যেখানে সবাই দেখতে পারেন, একটি কপি ব্যালটগুলোর সাথে বস্তার ভেতরে সিলগালা করে দেয়া হয় এবং একটি কপি স্থানীয় পোস্ট অফিস থেকে নির্বাচন কমিশনের উদ্দেশ্যে ডাকযোগে পাঠিয়ে দিতে হয়।
আর প্রত্যেক প্রার্থীর উদ্দেশ্যে ফলাফলের কাগজের একটি কপি দেয়া হয়। ফলাফলের একটি কাগজ প্রিজাইডিং অফিসার নিজের কাছেও রাখেন।
এভাবে প্রত্যেকটি কেন্দ্রের ফলাফল সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে যাওয়ার পর সেখানে সেগুলো যোগ করা হয় এবং গণনা শেষে চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণা করা হয় বলে নিশ্চিত মিজ. টুলি।
কেন্দ্রে গণনার সময় আপত্তি তুললে কী হয়?
নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা ফেয়ার ইলেকশন মনিটরিং অ্যালায়েন্স, ফেমা’র সভাপতি মুনিরা খান বিবিসি’কে বলেন, একটি কেন্দ্রের ভোট গণনাকার্য যেহেতু রাজনৈতিক দলগুলোর পোলিং এজেন্ট, পর্যবেক্ষক, সাংবাদিক সবার সামনেই সম্পন্ন হয় সেখানে জালিয়াতির সুযোগ খুব বেশি থাকে না।
“ভোট গণনার সময় প্রার্থীর প্রতিনিধি হিসেবে একজন পোলিং এজেন্টই থাকে, যার নাম আগে থেকে প্রিজাইডিং অফিসারকে জানিয়ে দেয়া হয়।”
কোনো কেন্দ্রের ভোট গণনার পর কোনো পোলিং এজেন্ট যদি গণনার ফলাফল চ্যালেঞ্জ করেন (লিখিতভাবে) এবং ফলাফলের কাগজে স্বাক্ষর করতে আপত্তি জানান তাহলে প্রিজাইডিং অফিসার চাইলে আবার ভোট পুনর্গণনা করতে পারেন।
প্রিজাইডিং অফিসার চাইলে নিজে থেকেও কেন্দ্রের ভোট পুনর্গণনা করতে পারেন বলে জানান নির্বাচন কমিশনের সাবেক উপ-সচিব জেসমিন টুলি।
তবে সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন ফলাফল পাল্টে দেয়ার জন্য কারচুপির আশ্রয় নেয়া হতে পারে ভোটকেন্দ্রের ভেতরেই।
মি. হোসেন বলেন, “সারাদিন কেন্দ্রের ভেতরে দুপক্ষের এজেন্ট থাকল, তাদের সামনেই ভোট-গ্রহণ করা হল। তবে গণনার সময় কোন এক পক্ষের এজেন্টকে আর থাকতে দেয়া হল না বা কোন একটা উপায়ে তাকে সরিয়ে দেয়া হল।”
আবার এজেন্টও অনেক সময় বিক্রি হয়ে যান বলে মন্তব্য করেন মি. হোসেন। তখন গণনাতে বড় ধরণের কারচুপির সুযোগ থাকে বলে তিনি জানান।
এখন ভোট দিতে গিয়ে যদি কেউ দেখেন যে তার ভোটটি আগেই দেয়া হয়ে গেছে তাহলে করণীয় কী?
এ প্রসঙ্গে মি. সাখাওয়াত হোসেন জানান, কারও ভোট দেয়া হয়ে গেলে প্রিজাইডিং অফিসার ওই ভোটারের পরিচয় নিশ্চিত করার পর একটি টেন্ডার ভোট ইস্যু করবেন।
এই ভোটটি মূলত প্রমাণপত্র হিসেবে রাখা হয়।
এখন এই টেন্ডার ভোটের সংখ্যা যদি দশটি বা তারচেয়ে বেশি হয় তাহলে প্রিজাইডিং কর্মকর্তা চাইলে সেই ভোটকেন্দ্র বাতিল করতে পারেন। এটা পুরোটাই নির্ভর করে প্রিজাইডিং কর্মকর্তার সিদ্ধান্তের ওপর।
আর একটি আসনের কোনো কেন্দ্রের ভোট গণনা নিয়ে রিটার্নিং অফিসারের কাছে লিখিত অভিযোগ করতে পারেন প্রার্থী বা তাঁর নির্বাচনি এজেন্ট।
সেক্ষেত্রে রিটার্নিং অফিসারের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করবে তিনি অভিযোগ গ্রহণ করবেন কি না।
মিজ মুনিরা খান বলেন, “যদি রিটার্নিং অফিসার দেখেন যে গণনার ব্যাপারে অভিযোগ এতটা রয়েছে যে তার ফলে আসনের ফলাফল পরিবর্তিত হতে পারে, সেক্ষেত্রে সেই অভিযোগকে গুরুত্ব সহকারে নিয়ে নির্বাচন কমিশনের কাছে পাঠান রিটার্নিং অফিসার। তবে ছোটখাটো সংখ্যায় ভুলের ক্ষেত্রে অভিযোগ উপেক্ষা করতে পারেন রিটার্নিং অফিসার।”

এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন