ভ্রমন কাহিনী : বেলাই বিলে অথৈ জলে নৌবিহারে একদিন

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের এক অনন্য জনপদের নাম গাজীপুর। শাল,গাজারী,মেহগনি,সেগুন বেষ্টিত এবং শীতলক্ষ্যা, ব্রহ্মপুত্র, বানার, তুরাগ বিধৌত গাজীপুর থেকেই মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রতিরোধ রচনা হয়েছিল।এ জেলায় আছে জাতীয় উদ্যান। গাজীপুর জেলার সবচেয়ে আকর্ষনীয় পর্যটন কেন্দ্র হচ্ছে বেলাই বিল। চিলাই নদী থেকে বেলাই। বেলাই বিলকে নিয়ে রয়েছে নানা উপাখ্যান ।

আমাদের দেশে যেসব বিল রয়েছে, এর মধ্যে বেলাই বিল রূপ-সৌন্দর্য্যে অনন্য। বিশাল বিলটির কোনো কোনো স্থানে প্রায় সারা বছরই পানি থাকে, তবে বর্ষায় এর রূপ বেড়ে যায় অনেক। বর্তমানে বিলটি আট বর্গমাইল এলাকায় বিস্তৃত হলেও একসময় এটি আরও বড় ছিল। বাড়িয়া, ব্রাহ্মণগাঁও, বক্তারপুর ও বামচিনি মৌজা গ্রামঘেরা বেলাই বিল। তবে ৪০০ বছর আগের ইতিহাসে বেলাই বিলে কোনো গ্রামের অস্তিত্ব ছিল না। খরস্রোতা চেলাই নদীর কারণে বিলটিও খরস্রোতা স্রোতস্বিনীরূপে বিরাজমান ছিল। কিংবদন্তি আছে, ভাওয়ালের সেই সময়ের ভূস্বামী ঘটেশ্বর ঘোষ ৮০টি খাল কেটে চেলাই নদীর জল নিঃশেষ করে ফেলেন তার ছেলের সলিল সমাধির কারণে। তার পরই এটি প্রকাণ্ড বিলে পরিণত হয়। বর্ষা মৌসুমে ছেলেরা বিলের চারপাশে ডাঙ্গি খনন করে। এখানে ধরা হয় মাছ। আর শুষ্ক মৌসুমে বিলটি হয়ে ওঠে একফসলি জমি। তাতে চাষ হয় ইরি বোরো ধান। বেলাই বিলের নানান জাতের দেশীয় মাছ খেতে অনেক সুস্বাদু। বর্তমানে বেলাই বিলের কৃষক-জেলে-নৌকার মাঝিদের বিড়ম্বনা কচুরিপানা।

ভ্রমন পিপাসুদের দারুন ভাবে আকর্ষন করে বেলাই বিল ।ভরা বর্ষায় বেলাই বিলে নৌকা ভ্রমন যেন অনাবিল আনন্দের ছোয়া । আর নৌকার ছাদে খোলা নীল আকাশের নীচে সঙ্গীতের সুরের মূর্চনা কিংবা মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নিজেকে রোমাঞ্চ করে দারুন ভাবে। বন্ধুবর হুমায়ূন কবিরের উদ্যোগে বেশ কয়েকবার আমার সৌভাগ্য হয়েছে বেলাই বিলে নৌবিহারের।

গাজীপুর সাংস্কুতিক কেন্দ্রের পরিচালক,বিশিষ্ট সাংবাদিক প্রিন্সিপাল হুমায়ূন কবির আমার দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত বন্ধু । হুমায়ূন ও আমি ছাত্র জীবন থেকেই সাংবাদিকতার সাথে জড়িত ।লেখা-লেখি ও করেছি একই পত্রিকায়। দু’জনই প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম।

আমাদের বন্ধু মহলে হুমায়ূন সবচেয়ে বেশী ভ্রমন পাগল বলে পরিচিত। ভ্রমন না করলে যেন তার পেটের ভাতই হজম হয়না । তার প্রচেষ্টার কারনেই বছরে বেশ কয়েকবার ভ্রমনের আয়োজন হয়। ভ্রমনের সুবাধে বন্ধুদের সাথেও দেখা হওয়ার সুযোগ হয়। এ কারনে হুমায়ূন অবশ্যই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য।

২০০১৭ খ্রিস্টাব্দের বর্ষায়ও তার উদ্যোগের ব্যতিক্রম হলোনা । গত ১১ আগস্ট ২০০১৭ খ্রিস্টাব্দে কলেজ বন্ধের দিন শুক্রবার বেলাই বিলে নৌকা ভ্রমনের দাওয়াত পেলাম হমায়ূন এর কাছ থেকে । অবশ্য দু’ এক দিন আগে থেকেই সে আমাকে বার বার মোবাইলে ভ্রমনের দিন তারিখ স্মরণ করে দিচ্ছিল। বৃহস্পতিবার থেকেই অবিরাম বৃষ্টি হচ্ছে। শোনা যাচ্ছে বন্যার পদধ্বনি। শুক্রবার রাত থেকেই মূষলধারে আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি পড়ছে। সকালে বৃষ্টির বেগ যেন আরো বাড়ছে। সকাল ৯টায় গাজীপুরে গিয়ে নাস্তা করার কথা । ভাবছিলাম হয়তো অনুষ্ঠান হবে না ।হুমায়ূনের বার বার মোবাইলে তাগাদা পেয়ে প্রবল বৃষ্টি উপেক্ষা করে ছাতা মাথায় নিয়ে কাপাসিয়ার বাসা থেকে গাজীপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। কাপাসিয়া পাবুর রোডের সিএনজি স্টেশন থেকে সিএনজিতে করে ৪৫ মিনিটের মধ্যে হারিনাল পৌঁছলাম । হারিনাল থেকে ১০ টাকায় টমটমে করে তিতারকূল ব্রিজের কাছে গিয়ে দেখি অসংখ্য নৌকা থরে থরে সাজানো ।আমাদের লোকজন ছাড়া ও অনেক ভ্রমন পিপাসু ব্যক্তিরা যার যার নৌকায় চড়ে বসছে। আমাদের জন্য নির্ধারিত নৌকায় উঠলাম। সেখানে পরিচিত অনেকেই অপেক্ষা করছেন। অ্যাডভোকেট ফখরুল ভাই আমাকে প্রথমেই স্বাগত জানালেন। নৌকাতে আরো আগেই বসে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছেন অধিকাংশ লোকজন। টাঙ্গাইল সন্তোষ মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণসংযোগ কর্মকর্তা প্রিয় বন্ধু, সাপ্তাহিক শুভ সকালেন সম্পাদক শামসুল আলম শিবলি, সঙ্গীত শিল্পী শামীম আহমেদ, উপাধ্যক্ষ হারুন অর রশিদ ,মনছবি সাংস্কৃতিক সংগঠনের সিরাজ ভাই সহ অধিকাংশ লোকজন দীর্ঘক্ষণ যাবত নৌকায় বসে আমাদের জন্য অপেক্ষার প্রহন গুনছেন । একটু পরেই হুমায়ূন ভাইয়ের সাথে নৌকায় উঠলেন কবি মতিউর রহমান মল্লিকের হাতে গড়া সংগঠন বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের পরিচালক মালিক আব্দুল লতিফ, বাংলাদেশের বিখ্যাত ইসলামী সঙ্গীত শিল্পী আবুল আলা মাসুম ।সকাল ১১ টায় তিতারকূল থেকে ৬০ জনের বিশাল এক বহর নিয়ে নৌকা ছাড়া হলো । নৌবিহারে লেখক, কবি , সাহিত্যিক, সাংবাদিক, অধ্যাপক, শিক্ষাবিদ, আইনজীবি, সুরকার, গীতিকার, নাট্যকর্মী সহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মকর্তাগন অংশগ্রহণ করেছিলেন। গাজীপুরের অতি পরিচিত সাংস্কৃতিক সংগঠন স্পন্দন শিল্পী গোষ্ঠী, মনছবি শিল্পী গোষ্ঠী, তুরাগ শিল্পী গোষ্ঠী, পূর্বাচল শিল্পী গোষ্ঠী সহ শিশু কল্যাণের ক্ষুদে শিল্পীদের অংশ গ্রহণ আমাদের ভ্রমনকে করেছিল আনন্দময়। আমাদের আগে পিছে চলছে আরো অনেক নৌকার সারি। সেদিন বেলাই বিলে ভ্রমন পাগলদের ঢল নেমেছিল।

নৌকার ছাদে বসার জন্যে চেয়ারের ব্যবস্থা ছিল। ছাদের ওপর থেকে বেলাই বিলের পুরো সৌন্দর্য্য উপভোগ করছিল সবাই। মন প্রাণ দিয়ে, মন্ত্রমুগ্ধের মত বেলাই বিলের প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য্য দেখছিল সবাই । এরই মাঝে সকালের নাস্তা হিসেবে পরিবেশন করা হলো গরুর গোস্ত সহ বুনা খিচুরী । গাজীপুর সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের উপ-পরিচালক সিরাজ ভাইয়ের স্ত্রীর নিজের হাতে পাক করা খিচুরী খেয়ে সবাই ভাবীর প্রশংসায় মেতে উঠল।

বেলাই বিলের কচুরি পানা,মাছ ধরার খরা আর নানা দ্বীপ, গোপ পেরিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে নৌবিহার।আমরা কানাইয়া বাজারের পাশ দিয়ে যখন যাচ্ছিলাম তখন বিল বেলাইয়ের জেলেরা তালগাছের কোন্দা দিয়ে নানান জাতের মাছ ধরছিল। বেলাই বিলের উপর নির্মিত ছোট-বড় সেতুর উপর থেকে শিশু-কিশোররা লাফ দিয়ে নীচে পড়ছিল। এ দৃশ্য দেখে ছ্টো বেলায় শীতলক্ষ্যায় লাফ দেয়ার দৃশ্যগুলো মনের মাঝে উকি দিচ্ছিল বার বার।

পূবাইল বাজারের কাছা কাছি যাওয়ার সময় জুমার নামাজের আযান হচ্ছিল। আমরা বিল বেলাইয়ের দ্বীপ পূবাইল বাজার জামে মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করলাম। নামাজের পর পরই বাজারের গরুর দুধের চা খেতে হুমড়ি খেয়ে পড়ল সবাই। কচুরিপানা, শাপলা মাড়িয়ে নৌকা আবার সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের গন্তব্য গাজীপুরের বিখ্যাত সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান‘ মনছবির’ ‘বেলাই বিলাস ইকো রিসোর্ট’। অথৈ জলরাশির এক প্রান্তে গড়ে তোলা হয়েছে মনছবির বেলাই বিলাস ইকো রিসোর্ট। বেলাই বিলাস থেকে অসংখ্য গ্রামের ছবি দেখা যায়।বিল বেলাইয়ের ভ্রমন পিপাসুদের জন্য এ পিকনিক স্পটটি খুবই আকর্ষনীয়।

নৌকা ভ্রমনের প্রধান আকর্ষন ছিল মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। জুমার নামাজের পর পরই শুরু হয় নৌকার ছাদে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের শিল্পীদের মাঝে কবিতা আবৃতি, ইসলামী সঙ্গীত,দেশাত্ববোধক গান,একক ও যৌথ অভিনয় ,কৌতুক প্রতিযোগিতা । সবার অংশ গ্রহনে ছিল মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক পরিবেশনা । সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার জন্যে ছিল আকর্ষনীয় ক্রেস্ট । নৌকার গতির সাথে তাল মিলিয়ে স্টিলের ছাদে চলছে সাংস্কৃতিক প্রোগ্রাম । অনেক পরিপাটি, পরিকল্পিত ও গোছানো ছিল সাংস্কৃতিক আয়োজন। বলতে গেলে মানসম্মত একটি অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানের ফাকে ফাকে চলছিল আগত অতিথিদের মজাদার কথার ফুলঝুড়ি।

শেষ বিকেলে দুপুরের খাবারের জন্যে আমরা পৌঁছলাম হুমায়ূন ভাইয়ের হাতে গড়া আমাদের সেই কাক্সিক্ষত বেলাই বিলাস ইকো রিসোর্ট । বিলের কিনারে ছোট একখন্ড দ্বীপ। চারিপাশে বিল। একটু দূরেই অনেক গুলি গ্রাম।বিলের স্বচ্ছ পানিতে বিভিন্ন দেশীয় মাছেরা খেলা করে। সাময়িক সময়ের জন্যে বিরতি ঘোষণা করা হলো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ।

বিলের খাদের কিনারায় চেয়ার পেতে দুপুরের খাবার ক্ষেতে বসলাম। শুকনো লাল মরিচ দিয়ে শরিষার তেলে চপ্ চপ্ করা আলুর ভর্তা, জাতীয় মাছ ইলিশের ভুনা, কৃষকের গোয়ালে পালা দেশীয় খাটি গরুর গোস্ত ,ডাল সহ শাক-সাব্জি দিয়ে আয়েশ করে সবাই দুপুরের খাবার খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলল। দুপুরের খাবারের পর হুমায়ুন ভাই সবাইকে পান বিলি করলেন । পূবাই বাজার থেকে জুমার নামাজের পর আমাদের জন্যে পান কিনে রেখেছিলেন তিনি । পানের অভ্যাস না থাকলে ও বাঙ্গালীর স্বভাব অনুযায়ী সবাই রস করে পান চিবিয়ে ঠোট করলেন লাল। বেলাই বিলের পানিতে অযু করে নৌকাতে একাধিক জামাতে সবাই আছরের নামাজ আদায় করলেন । নামাজের পরই নৌকা আবার চলতে লাগল , সেই সাথে আবার শুরু হলো অসমাপ্ত সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। রাত ৯টা পর্যন্ত আমরা ছিলাম বেলাই বিলে। মাগরিবের নামাজও আমরা বেলাই বিলের মাঝখানে নৌাকাতেই আদায় করলাম।

শেষ পর্যায়ে পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে আমাদের সাথে পূবাইল থেকে শরীক হলেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ শেখ ইবনে ফয়েজ সহ আরো কয়েক জন। ইবনে ফয়েজ সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের মাঝে পুরষ্কার বিতরণ করেন। দিনের বেলাই বিলের চেয়ে রাতের বেলাই বিল যেন আরো অনেক আকর্ষনীয় হয়ে ধরা দিল আমাদের সামনে। রাতের বেলাই বিল থেকে গাজীপুর শহরের বিদ্যুতের আলো ঝলমলে পরিবেশ দেখে মনে হচ্ছিল ভারতের যমুনা নদী থেকে সম্রাট শাহজাহানের অমর কীর্তি তাজমহল দেখার কথা। গত বছর ও বেলাই বিলে গিয়েছিলাম নৌবিহারে কিন্ত এবারের ভ্রমন যেন একটু ভিন্ন প্রকৃতির, বহুমাত্রিক,অন্য আমেজের । বেলাই বিলের সৌন্দর্য্য যেন আবার আমায় ডাকে ।

লেখকঃ অধ্যাপক শামসুল হুদা লিটন
সাধারন সম্পাদক, কাপাসিয়া প্রেসক্লাব, কাপাসিয়া,গাজীপুর ।