মহালয়া: মায়ের আগমনে করোনামুক্ত হোক ধরণী
করোনার কারণে এবার দুর্গাপূজার আনন্দ অনেকটা ফিকে হতে চলেছে। পূজার সেই চিরচেনা এলাহী কান্ড লুকিয়ে থাকবে অগোচরে। বাইরে ঘুরতে যাওয়া, নানা ধরনের আয়োজন সবকিছুতেই দুর্গোৎসবের চির পরিচিত আমেজ থাকছে না। মহালয়া থেকে শুরু করে শারদীয় এ উৎসবের সবক্ষেত্রেই থাকছে স্বাস্থ্যবিধির কড়া নির্দেশ।
পঞ্জিকা অনুযায়ী, এবার মহালয়া হচ্ছে ১৭ সেপ্টেম্বর। সাধারণত মহাসপ্তমীর ঠিক সাতদিন আগে হয় মহালয়া কিন্তু পঞ্জিকার হিসাবে এবার আশ্বিন মাস ‘মল মাস’, মানে অশুভ মাস। সে কারণে এবার আশ্বিনে দেবীর পূজা হবে না। পূজা হবে কার্তিক মাসে। সেই হিসেবে এবার দেবী দুর্গা ‘মর্ত্যে আসবেন’ মহালয়ার ৩৫ দিন পরে। তাই ২২ অক্টোবর মহাষষ্ঠী তিথিতে হবে বোধন। পরদিন সপ্তমী পূজার মাধ্যমে শুরু হবে দুর্গোৎসবের মূল আচার অনুষ্ঠান। ২৬ অক্টোবর মহাদশমীতে বিসর্জনে শেষ হবে দুর্গোৎসবের আনুষ্ঠানিকতা।
করোনা পরিস্থিতিতে কীভাবে হবে দুর্গাপূজা সে অনিশ্চয়তা মাথায় নিয়ে চলছে দেবী বন্দনার প্রস্তুতি। প্রতিমা তৈরির কাজও চলছে ধুমছে। ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন প্রতিমাশিল্পীরা।
মহালয়া প্রতিবছরই আসে, কিন্তু প্রতিবছরই যেন নতুন করে আসা। তাই এই দিনটা এলেই মনের ভেতরটা হৈ হৈ করে ওঠে-সীমাহীন আনন্দে ভরে যায়। প্রতিদিনের কর্মব্যস্ত জীবন থেকে কোথাও যেন একটা মুক্তি। আকাশে ছেঁড়া মেঘের ভেলা, শহরের ইতিউতি কোথাও যেন কাশ ফুলের দেখা পাওয়া যাওয়া আর ভোরবেলা শিউলির ফুলের গন্ধ। মা আসছেন। মহালয়ার দিন ভোর বেলাতেই ঘুম ভাঙে বেতার বা টেলিভিশনবার্তায় (মহালয়ার গান -‘বাজল তোমার আলোর বেণু’) শুনে বা মর্ত্যে দেবী আগমনের নাট্যরূপ দেখে। অবসান হয় পিতৃপক্ষের, সূচনা হয় দেবীপক্ষের। বছর ঘুরে আনন্দময়ীর এই আগমন সান্নিধ্যে বাঙালি তার দুঃখ যন্ত্রনা ভুলে কিছুটা আনন্দ পেতে চায়। অভাব-যন্ত্রনা ক্লিষ্ট, অগ্নিমূল্য বাজার, রাজনৈতিক অস্থিরতা পীড়িত এই জাতির এরূপ চাহিদাতে নুন্যতা নেই। কিন্তু স্বভাব দোষে এই আনন্দ তার পবিত্রতা হারিয়েছে অনেকাংশে। বৈভব-অহংকার, প্রতিযোগিতা, আত্মকেন্দ্রিকতা, নেশাগ্রস্ততা, অবৈধ কার্যকলাপ, হুজুগপ্রিয়তা, উদ্দেশ্যহীনতা আর করোনা মহামারী এই আনন্দের আবর্তকে করে তোলে পঙ্কিল। তার পরও আমরা নতুন আশায় বুক বাঁধি-স্বপ্ন বুনি পুরাতন বছরের সকল দুঃখ-ব্যর্থতা ভুলে নতুন একটি বছরের আনন্দময় সফলতার আশায়- করোনামুক্ত একটি সকালের।
আজ মহালয়া। দেবীকে আহবান জানানো হবে আজকে এই ধরনীতে আগমনের জন্য। দেবীর কাছে প্রার্থনা, হে দেবী, তুমি জাগো, তুমি জাগো, তুমি জাগো, ধন্য করো তোমার আগমনে এই পৃথিবীকে। করো কলুষতা মুক্ত- করোনা মহামারী মুক্ত। মাতৃরূপে, বুদ্ধিরূপে, শক্তিরূপে, বিদ্যারূপে আশীর্বাদ করো পৃথিবীর প্রতিটি মানুষকে। বিনাশ করো আমাদের অসুর প্রবৃত্তিকে।
মহালয়া অতি পূণ্য তিথি। আনন্দময়ীর আগমনে মধুর কলধ্বণি স্ফুরিত হয়ে ওঠে মহালয়ার পূণ্য তিথিতে। মধুকৈটববিনাশিনী, মহিষাসুরমর্দিনী মহাদেবীর আবির্ভাব ঘটে মহালয়ার পবিত্র মুহূর্তে। মহালয়ার তিথিতে দেবীপক্ষের সূচনা। দেবীপক্ষ মানে অসুরের বিরুদ্ধে দেবীর সংগ্রামের পক্ষ এবং এখানে দেবীর জয় সূচিত হয়। চ-ীপূজা, চ-ীপাঠ ইত্যাদি ধর্মীয়ানুষ্ঠানের মাধ্যমে মহালয়া উদযাপিত হয়্ মহালয়ার অমাবস্যার পরবর্তী শুক্লপক্ষে দেবীর পূজা আরম্ভ হয়। দুর্গাপূজা অসুর বধের পূজা। আমাদের মধ্যেও নানা প্রকার অসুরত্ব আছে। দুর্গাপূজার মাধ্যমে এ অসুরত্ব বিনাশে আমরা দেবীর কাছে প্রার্থনা করি।
শরণাগত দীনার্ত পরিত্রাণ পরায়ণে।
সর্ব্ব স্যার্ত্তি হরে দেবী নারায়ণি নমোহস্তুতে। (শ্রী শ্রী চ-ী)
ধর্মশাস্ত্রের তিনটি অমাবস্যার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ১. আলোক অমাবস্যা, ২. মহালয়ার অমাবস্যা, ৩. দীপান্বিতা অমাবস্যা। আলোক অমাবস্যা ভাদ্র মাসে, মহালয়া অমাবস্যা আশ্বিন মাসে এবং দীপান্বিতা অমাবস্যা কার্তিক মাসে অনুষ্ঠিত হয়। যে কৃষ্ণপক্ষের শেষে মহালয়া অমাবস্যা হয় সেই কৃষ্ণপক্ষকে বলা হয় অপরপক্ষ। অপরপক্ষ মানে যারা অপর হয়েছেন অর্থাৎ প্রয়াত হয়েছেন। এ সময়ে পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে তর্পন করা হয়। মহালয়া তিথিতে পার্বণ শ্রাদ্ধ। বিশেষ শ্রাদ্ধাদি পারলৌকিক ক্রিয়া কৃষ্ণপক্ষে বিহিত। চন্দ্রের ক্ষীয়মান অবস্থা হল কৃষ্ণপক্ষ। কৃষ্ণপক্ষে তাই পারলৌকিক ক্রিয়া তথা পিতৃকার্য করার বিধান শাস্ত্রে দেয়া হয়েছে। চন্দ্রশুদ্ধি হচ্ছে মনের শুদ্ধি। মন শুদ্ধ থাকলে শুভকর্ম সিদ্ধ হয়। বিভিন্ন তিথিতে বিভিন্ন পূজার বিধান শাস্ত্রে রয়েছে। তিথি মানে চন্দ্রকলার হ্রাস-বৃদ্ধি দ্বারা সীমাবদ্ধ কাল। প্রতিপদ দ্বিতীয়া, তৃতীয়া, চতুর্থী, পঞ্চমী থেকে পঞ্চদশী অর্থাৎ পূর্ণিমা বা অমাবস্যা পর্যন্ত এ তিথিকাল বিস্তৃত। চন্দ্রের ষোড়স ভাগের এক এক ভাগকে কলা বলা হয়। চন্দ্রের যখন এক এক কলার হ্রাস পায় তাকে বলা হয় কৃষ্ণপক্ষ আর যে পক্ষে বৃদ্ধি পায় তাকে বলা হয় শুক্লপক্ষ। কৃষ্ণপক্ষের সর্বশেষ তিথি অমাবস্যা আর শুক্লপক্ষের সর্বশেষ তিথি পূর্ণিমা। শাস্ত্রের কিছু প্রসিদ্ধ পূর্ণিমার কথা উল্লেখ রয়েছে যেমন বৈশাখী পূর্ণিমা, আষাঢ়ী পূর্ণিমা, গুরু পূর্ণিমা, মধু পূর্নিমা, লক্ষ্মী পূর্ণিমা, রাস পূর্নিমা, মাঘী পূর্ণিমা ইত্যাদি দীপান্বিতা অমাবস্যার রাত্রিতে অনুষ্ঠিত হয় কালীপূজা। মহালয়ার দেবীচ-ী মহাকালী হয়েছিলেন। দেবীচ-ী যুদ্ধে মহিষাসুরকে বধ করলেও রক্তবীজ নামক এক অসুরকে বিনাশ করার জন্য দেবীচ-ী মহাকালীরূপে ধারণ করে আপন জিহ্বা বিস্তৃত করে সেই বিস্তৃত জিহ্বার উপরে রক্তবীজকে রেখে নিধন করলেন যাতে রক্তার মাটিতে পড়তে না পারে। এভাবে দেবীচ-ী রক্তবীজ অসুরকে বধ করে দেবলোকে শান্তি স্থাপন করলেন।
“ওঁ পিতা স্বর্গঃ পিতা ধর্ম পিতা হি পরমন্তপঃ ।।
পিতরি প্রীতিমাপন্নে প্রীয়ন্তে সর্বদেবতাঃ ।।”
পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে পার্বন শ্রাদ্ধ ও তর্পণ করার অনুষ্ঠান বা রীতিই হল পিতৃপক্ষ। এই পক্ষ ষোলোশ্রাদ্ধ, কানাপাত, জিতিয়া মহালয়াপক্ষ নামেও পরিচিত। এই পক্ষ সূচিত হয় প্রধানত: দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতে গণেশ উৎসবের পরবর্তী পূর্ণিমা তিথিতে। শেষ হয় মহালয়া অমাবস্যা তিথিতে। অন্যদিকে, উত্তর ভারত ও নেপালে ভাদ্রের পরিবর্তে আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষকে পিতৃপক্ষ বলা হয়।
জলদানের মাধ্যেমে পিতৃলোকের তৃপ্তিসাধনই হল তর্পণ বিধি। পিতৃপক্ষে ‘পুত্র বিনা মুক্তি নাই’। পুত্র কর্তৃক শ্রাদ্ধানুষ্ঠান হিন্দুধর্মে অবশ্য করণীয় একটি অনুষ্ঠান। হিন্দু শাস্ত্র মতে, অনুপবীত দ্বিজাতি, অসংস্কৃত শূদ্র ও স্ত্রীলোকের তর্পণ করবার অনুমতি নেই। কেবলমাত্র প্রেততর্পণে অদিকার রয়েছে। কিন্তু বিধবা, পুত্র পৌত্রের অভাবে স্বামী-শ্বশুর ও শ্বশুরের পিতা এই তিন পুরুষের মাত্র তর্পণ করতে পারেন।
মহালয়া পক্ষ সাধারণত পনেরোটি তিথিতে বিভক্ত। সেগুলি হল, প্রতিপদ, দ্বিতীয়, তৃতীয়া, চতুর্থী, পঞ্চমী, ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, দশমী, একাদশী, দ্বাদশী, ত্রয়োদশী, চতুর্দশী ও অমাবশ্যা। হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, যে ব্যক্তি তর্পণে ইচ্ছুক হন, তাঁকে তাঁর পিতার মৃত্যুর তিথিতে তর্পণ করতে হয়।
সর্বপিতৃ অমাবস্যা দিবসে তিথির নিয়মের বাইরে সকল পূর্বপুরুষেরই শ্রাদ্ধ করা হয়। যাঁরা নির্দিষ্ট দিনে শ্রাদ্ধ করতে ভুলে যান, তাঁরা এই দিন শ্রাদ্ধ করতে পারেন। এই দিন গয়ায় শ্রাদ্ধ করলে তা বিশেষ ফলপ্রসূ হয়। উল্লেখ্য, গয়ায় সমগ্র পিতৃপক্ষ জুড়ে মেলা চলে। বাংলায় মহালয়ার দিন দুর্গাপূজার সূচনা হয়। লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, এই দিন দেবী দুর্গা মর্ত্যলোকে আবির্ভূতা হন। মহালয়ার দিন অতি প্রত্যুষে চ-ীপাঠ করার রীতি রয়েছে। আশ্বিন শুক্লা প্রতিপদ তিথিতে দৌহিত্র মাতামহের তর্পণ করেন।
শ্রাদ্ধকর্তাকে স্নান করে শুদ্ধ হয়ে ধুতি পরে শ্রাদ্ধ করতে হয়। শ্রাদ্ধের পূর্বে তিনি কুশাঙ্গুরীয় (কুশ ঘাসের আঙটি) ধারণ করেন। এরপর সেই আঙটিতে পূর্বপুরুষদের আবাহন করা হয়। শ্রাদ্ধ খালি গায়ে করতে হয়, কারণ শ্রাদ্ধ চলাকালীন যজ্ঞোপবীতের অবস্থান বারংবার পরিবর্তন করতে হয়। শ্রাদ্ধের সময় সিদ্ধ অন্ন, ময়দা, ঘি ও তিল দিয়ে মাখিয়ে পিন্ডের আকারে উৎসর্গ করা হয়। একে পিন্ডদান বলে। এরপর দুর্বাঘাস, শালগ্রাম শিলা বা স্বর্ণমূর্তিতে বিষ্ণু এবং যমের পূজা করা হয়। এরপর পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে খাদ্য প্রদান করা হয়। এই খাদ্য সাধারণত ছাদে রেখে আসা হয়। যদি কোন কাক এসে সেই খাদ্য খেয়ে যায়, তাহলে ধরা হয় যে খাদ্য পিতৃগণ কর্তৃক গৃহীত হয়েছে। মনে করা হয়, পাখিটি আসলে যম বা পিতৃগণের আত্মার প্রতিনিধি। গরু ও কুকুরদেরও খাওয়ানো হয়। অনুষ্ঠান শেষে ব্রাহ্মণদের ফল, পান, সুপারি, গামছা, চাল ও ধূপ দেওয়া হয়। কোথাও কোথাও ব্রাহ্মণদের ভোজনও করানো হয়। পূর্বপুরুষ (কাকের বেশে) এবং ব্রাহ্মণেরা ভোজন করলেই তবে পরিবারের সদস্যরা অন্নগ্রহণ করেন। কোন কোন পরিবারে পিতৃপক্ষে ভাগবত পুরাণ, ভগবদ্গীতা বা শ্রশ্রীচন্ডী পাঠ করা হয়। অনেকে পূর্বপুরুষের মঙ্গল কামনায় ব্রাহ্মণদের দান করেন। পূর্বপুরুষকে যে খাদ্য উৎসর্গ করা হয়, তা সাধারণত রান্না করে রুপা বা তামার পাত্রে কলাপাতার উপর দেওয়া হয়। এই খাদ্যগুলি হল ক্ষীর, লপসি, ভাত, ডাল, গুড় ও কুমড়া।
মার্কন্ডেয় পুরাণ গ্রন্থে বলা হয়েছে, পিতৃগণ শ্রাদ্ধে তুষ্ট হলে স্বাস্থ্য, ধন, জ্ঞান ও দীর্ঘায়ু এবং পরিশেষে উত্তরপুরুষকে স্বর্গ ও মোক্ষ প্রদান করেন। পুরাতাত্ত্বিক উষা মেননের মতেও, পিতৃপক্ষ বংশের বিভিন্ন প্রজন্মের মধ্যে সম্পর্ককে সুদৃঢ় করে। এই পক্ষে বংশের বর্তমান প্রজন্ম পূর্বপুরুষের নাম স্মরণ করে তাঁদের শ্রদ্ধা নিবেদন করে। পিতৃপুরুষের ঋণ হিন্দুধর্মে পিতৃমাতৃ ঋণ অথবা গুরু ঋণের সমান গুরুত্বপূর্ণ।
পরিবেশ-পরিস্থিতি, অনৈক্য, আত্মগৌরব হীনতা, পরানুকরণ সবই বাঙালি হিন্দু জাতিকে মরনাপন্ন করে তুলেছে। তাইতো মা এসেছেন মৃত্যুপথগামী সন্তানদের বাঁচাতে। শক্তি, বুদ্ধি, প্রেম, ভক্তি, সেবা, সাহস যুগিয়ে আমাদের বাঁচাতে। যেথা চৈতন্য, শ্রীজ্ঞান, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, অরবিন্দ, প্রণবানন্দ; যেথায় জয়মল্ল, প্রতাপাদিত্য, রাজসিংহ, দুর্গাবতী, ভবশঙ্করী, রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্র, বিপিন, রাসবিহারী, সুভাষ, ক্ষুদিরাম, বিনয়-বাদল-দিনেশ, কানাইলাল, প্রফুল্ল, যতীন দাস, বাঘা যতীন, সূর্যসেন, প্রীতিলতা, ইলা মিত্র, বিনোদ বিহারী, চিত্ত রঞ্জন দত্ত, জগৎজ্যোতি আর হাজারো সন্তানেরা এই মাতৃভূমিকে দেবভূমি, পূণ্যভূমি, ধর্মভূমি, কর্ম ভূমিতে রূপান্তরিত করতে চেয়েছিলেন, মা কখনই চান না এই পবিত্র ভূমি ধর্মহীন রাজনীতি, সীমাহীন ভোগবাদ, বৈদেশিক অনুকরণ আর স্বেচ্ছাাচারের লীলাভূমি হয়ে উঠুক।
বাঙালি যদি একবার তার ক্ষুদ্র আনন্দ উদযাপনের মোহ ভেদ করে শ্রী শ্রী চন্ডীর শক্তিকে আপনার করে নিতে পারে, দেবী বোধনের চালচিত্রে সামাজকে একত্রিত করে, তাঁর হাতের দশ অস্ত্র সহায়ে মানবতা, আধ্যাত্মিকতা ও প্রকৃতিকে বাঁচাতে আবার ধর্মযুদ্ধে অবতীর্ন হয়, তবেই বাঙালি হিন্দু ধী, ঐশ্বর্য্য, ঐক্য ও পৌরুষ সহকারে দশ দিশায় এক ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’ এর ধর্ম সাম্রাজ্য স্থাপন করতে পারবে। বৈদেশিক অধর্ম, রাজনীতি, মাতৃভূমির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী আর ভোগ বিলাসের মহিষাসুররা ত্যাগ-তিতিক্ষা-সেবা-সাধনার অস্ত্রাঘাতে নিপাতিত হবে।
বাঙালি সনাতনী হিন্দু একবার অতীত গৌরব স্মরণ করুন। স্বাধীনতার ক্রান্তিকালে শক্তি সাধনার ধারাকে পাথেয় করুন। আনন্দমঠের যে শিক্ষায় মহেন্দ্র তার নিস্পৃহতা আর নিবীর্জ্যতাকে পরিহার করে জীবন সমরে প্রবৃত্ত হয়েছিল, আসুন সেই শিক্ষাই গ্রহণ করি। ভাবুন এই মাটি আমার মা, এই জাতি আমার মা, আসুন মাতৃসাধনার সাধনসমরে প্রবৃত্ত হই। ষড় রিপু জয়ে আত্মবোধনের মধ্য দিয়ে আসুন সপ্তগ্রামে দেবী মাহাত্ম প্রচার করি। কঠোর অষ্ট ব্রত পালনে নব যুগের সন্ধিক্ষণে পৌঁছে দশদিক আমোদিত করে বলি জাগো হে সনাতন। কায়মনোবাক্যে মায়ের কাছে প্রার্থনা করি মা বিজয়ী কর, শত্রু নাশ করো। জয় মা। ত্বং বৈ প্রসন্না ভুবি মুক্তিহেতুঃ। তুমিই প্রসন্না হয়ে সংসারে মুক্তির কারণ হও।
আমরা মায়ের পূজা করি অসুরত্ব বিনাশের জন্য। আমাদের মধ্যে যে আসুরিক প্রবৃত্তি রয়েছে মায়ের পূজায় সেই অসুরত্বের বিনাশ সাধনেই আমাদের মাতৃপূজার সার্থকতা নিহিত। মায়ের দুইরূপ একটি ভয়ংকরী অপরটি ক্ষেমংকরী। দুষ্টের জন্য তিনি ভয়ংকরী আবার শিষ্টের জন্য তিনি ক্ষেমংকরী। তাই আনন্দময়ীর আগমনে পৃথিবীর আকাশ-বাতাস মুখরিত করে মায়ের আগমনবার্তা ঘোষিত হয়। সর্বশেষে শ্রী শ্রী মা আনন্দময়ীর রাতুল চরণে প্রার্থনা জানাই। এবারের মহালয়া অনুষ্ঠান থেকে সকলে শারীরিক, মানসিক, নৈতিক, আধ্যাত্মিক, সাংগঠনিক এবং আত্মশক্তির প্রেরণা লাভ করুন।
‘যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেন সংস্থিতা।
নমস্তসৈ, নমস্তসৈ, নমস্তসৈ, নমোঃ নমোঃ’
মা দুর্গা এক কিন্তু কোটি কোটি ভক্ত তাদের মন্দির একই মা-কে বিভিন্ন সজ্জায় সজ্জিত করে পূজা করবে। কিন্তু মায়ের মূর্তি যেন নর্তকীর না হয়ে মাতৃভাবে পূজিত হন এবং আশুরিক লোকেরা যাতে উপহাস না করতে পারে সেভাবেই পূজাটা হলে সকলের দূর্গতি দূর হবে। করোনামুক্ত আগামীর প্রত্যাশায়।
লেখক: কলামিস্ট, চিকিৎসক, সংগঠক এবং সমাজকর্মী
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন