মাদক নিয়ে ফেসবুকে ওসির অকপট স্বীকারোক্তি!
মাদক নিয়ন্ত্রণ না হওয়ার পেছনে সোর্স কালচার অন্যতম কারণ বলে মনে করেন রাজধানীর বাড্ডা থানার ওসি কাজী ওয়াজেদ আলী। মাদক নির্মূল না হওয়ার পেছনে পুলিশের ব্যর্থতার কথাও অকপটে স্বীকার করেছেন তিনি।
সম্প্রতি একাধিক ফেসবুক স্ট্যাটাসে নিজের অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করেছেন কাজী ওয়াজেদ আলী। তিনি বলেন, পুলিশের সঙ্গে থেকে অভিযানের তথ্য গোপনে ফাঁস করে দেয় সোর্সরা। এসব তথাকথিত সোর্স নামধারী মাদক ব্যবসায়ীরা শুধুমাত্র ওইসব ব্যবসায়ীকে ধরিয়ে দেয় যারা ওদের পেমেন্ট দেয় না। তাই মাদক ব্যবসায়ীরা কখনও কখনও পুলিশের চেয়ে কথিত ফর্মাদের সোর্স বেশি ভয় পায়। তাছাড়া মাদকবিরোধী সভা-সেমিনারে যারা উচ্চকণ্ঠে কথা বলেন তারাই মাদক ব্যবসায়ীদের থানা থেকে ছাড়িয়ে নিতে তদবির করেন।
ওয়াজেদ আলী বলেন, মাদকসহ কেউ ধরা পড়লে প্রকাশ্যে মাদকবিরোধী গরম বক্তব্য দেয়া ব্যক্তিরাই নির্লজ্জের মতো মাদক বিক্রেতাকে ছাড়ানোর জন্য তদবির করেন। আগের দেয়া তার গরম ভাষণকে স্মরণ করিয়ে দিলেও তিনি তা আমলে নিতে চান না। উপরন্তু ভাবখানা এমন যে মাদক ব্যবসায়ীকে থানা থেকে ছাড়ানোটা তার নৈতিক দায়িত্ব। তার তদবির না রাখাটা তার পোস্ট পজিশনের জন্য অত্যন্ত অমর্যাদাকর।
ওসি ওয়াজেদ আলী বলেন, মাদকের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন অফিসারদের নির্দেশিত জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করে চিহ্নিত মাদক স্পট ধ্বংস করা হয়। অনেক ব্যবসায়ীকে মাদকসহ চালান দেয়া হয়, উদ্ধার করা হয় বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য। চিহ্নিত স্পটগুলো এত কিছুর পরও মাদকসেবীর সংখ্যা কমানো যায়নি।
তিনি জানান, থানায় রুজুকৃত মামলার ৪০ ভাগই মাদকের। তারপরও কমছে না মাদকসেবীর সংখ্যা। উত্তরে মাদক বিক্রি বন্ধ করলে শুরু হয় দক্ষিণে, আবার দক্ষিণে যেতে যেতেই পূর্বে। অনেকটা কানামাছি খেলার মতো। আমাদের সাফল্যের পারদটা শুধুমাত্র সংখ্যা আর তথ্যনির্ভরই মনে হয়। তাই আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঠিকভাবে মাদকবিরোধী কর্মকাণ্ড পরিচালনায় মানসিকতার পরিবর্তন আনাটা জরুরি।
পুলিশের সোর্সদের বিষয়ে ওয়াজেদ আলী বলেন, মাদকে ছেয়ে থাকা এলাকায় মাঠপর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে লক্ষ্য করা গেছে, আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথাকথিত সোর্স নামধারী কিছু লোক এলাকার মাদক ব্যবসাগুলো নিয়ন্ত্রণ করে। তারা কখনও পুলিশের সঙ্গে সখ্যতার সুযোগে মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সপ্তাহ, মাসিকসহ বিভিন্ন সুবিধা নিয়ে ব্যবসার সুযোগ করে দেয়। আবার কখনও ধরিয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে ওদের কাছ থেকে সুবিধা আদায় করে। কখনও কখনও আইনশৃংখলা রক্ষাকারীদের বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে প্রলুব্ধও করে ফেলে। কখনও মাদক ব্যবসায়ী ধরতে পারলে বা মাদকদ্রব্য উদ্ধার করতে পারলে সোর্স মানি হিসেবে উদ্ধারকৃত মাদকের অংশ দাবি করে। অনেক ক্ষেত্রে সোর্সরাই মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে।
একটি ঘটনার বর্ণনা দিয়ে কাজী ওয়াজেদ আলী বলেন, কিছুদিন আগে একদিন সন্ধ্যায় একজন মধ্যমসারির সমাজপতির খুব রাগান্বিত স্বরে হঠাৎ ফোন :
ওসি সাহেব, আমার ছেলেকে থানায় নিয়েছেন কেন?
ওনার ছেলের নামটা শুনে নিয়ে বললাম আমি একটু জেনে বলি।
যে অফিসার নিয়ে এসেছে তাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, ওনার ছেলের কাছে ২ পিস নেশাজাতীয় ইয়াবা ট্যাবলেট পাওয়া গেছে।
বিষয়টা ওনাকে বলার সঙ্গে সঙ্গে তলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন। বললেন- এটা কখনও হতে পারে না, আমার ছেলে মোটেও খারাপ না। সে ওগুলোর সঙ্গে জড়িত হতে পারে না। আপনার অফিসার অসত্য বলছে। আপনি থানায় থাকেন, আমি এক্ষুনি আসছি।
কিছুক্ষণের মধ্যেই গজগজ করতে করতে হাজির হলেন ভদ্রলোক। আমার অফিসার অফিস কক্ষে নিয়ে এল ওনার ছেলেকে। আমার সম্মুখেই ভদ্রলোক রীতিমতো জেরা শুরু করলেন আমার অফিসারকে। থামিয়ে দিয়ে বললাম, কথা বলেন আপনার ছেলের সঙ্গে।
সুন্দর চেহারার উজ্জ্বল ফর্সা কলেজপড়ুয়া ছেলেটিকে দেখে সে ইউরোপিয়ান নাকি পশ্চিমা তা প্রথমে ঠাওর করতে পারলাম না। মুখে দাড়ির স্টাইলটা দেখে মনে হলো সৌদি আরবের রাজা-বাদশা হবে হয়তো। আবার মাথার চুলের স্টাইল যে কাকে অনুকরণ করে করা হয়েছে, তা ঠিক আন্দাজ করতে পারছিলাম না। ডান কানে ঝুলন্ত রিং আর হাতে রাবার ও স্টিলের বালা। ঝুলে ঝুলে হাঁটার ভাব দেখে মনে হলো এখনি পড়ে যাবে। টোটাল স্টাইলটা চোখে লাগার মতো।
বাবার জিজ্ঞাসা: তোমাকে পুলিশ ধরল কেন?
ছেলের জবাব: ড্যাড, আমার কোনো বডি রিকভারি ছিল না।
বডি রিকভারি কথাটা শুনে হকচকিয়ে গেলাম। বুঝলাম যথেষ্ট সমঝদার।
আমার অফিসারকে জিজ্ঞেস করায় সে বলল স্যার, রাস্তার মোড়ের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় পুলিশ দেখে দৌড় দিলে সন্দেহ হওয়ায় কিছু দূর গিয়ে তাকে ধরার সঙ্গে সঙ্গেই সে নিজের পকেট থেকে ২ পিস ইয়াবা বের করে মাটিতে ফেলে দেয়। ইয়াবাগুলো সে সেবন করার জন্যই রেখেছিল বলে উদ্ধারের সময় স্বীকারও করেছিল।
এটা শোনার পরও বিশ্বাস করতে চান না ভদ্রলোক। ওনার ব্যক্তিগত আর পারিবারিক শত্রুতার সঙ্গে পুলিশ হাত মিলিয়ে ষড়যন্ত্র আর চক্রান্ত করছে বলে তিনি জানান।
আমার অফিসারকে জিজ্ঞেস করলাম, ইয়াবা উদ্ধারের সময় কোনো সাক্ষী ছিল কিনা? তিনি বললেন রাস্তায় অনেক লোক ছিল। তারা দৌড়াতে দেখেছে। তবে ইয়াবা পকেট থেকে ফেলে দেয়ার বিষয়টা ওভাবে কেউ লক্ষ্য করেছে কিনা তা সঠিক বলতে পারব না স্যার।
বুঝলাম ঘটনা সত্য হলেও প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী পাওয়া মুশকিল। তাছাড়া ছেলেটি বয়সে তরুণ, ছাত্র মানুষ। এত মাদকের হাটের মধ্যে মাত্র ২ পিস ইয়াবাসহ মামলা হলে যেমন হাসাহাসি হবে তেমনি এই বয়সে হাজতবাস করলে সে খারাপও হতে পারে। তাই সুনির্দিষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণের আইনগত অভাব আর বয়স কম বিধায় মানবিক কারণে সেদিন ওকে কনসিডার করলেও যাওয়ার সময় ওর বাবার রক্তচক্ষুটা খুব দৃষ্টিকটুই লাগল। ছেলেটির ষণ্ডামার্কা চাহনিতেও একধরনের অহংকারবোধ উপলব্ধি করলাম। ভাবটা এমন যে, কি করতে পারলেন?
ঘটনার প্রায় দুই মাস পর ওই ভদ্রলোক একদিন আবার আমাকে ফোন করলেন। এবার অনেক নরম কণ্ঠে বললেন, ভাই আমি কি আপনার সঙ্গে একটু সাক্ষাৎ করতে পারি? বললাম কেন না?
থানায় এসে আমার রুমে গিয়ে সব লোক বের করে দিয়ে দরজা বন্ধ করে কান্না শুরু করলেন। বললেন, ভাই আমার ছেলেটাকে এখনই অ্যারেস্ট করেন। সে নেশা করে, আমার মানসম্মান সব শেষ। নেশার টাকার জন্য আমাকে মারে, আমার স্ত্রীকে মারে, বাসার টাকা-পয়সা উজাড় করে নিয়ে যায়, পড়ালেখা করে না ইত্যাদি ইত্যাদি।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন