মালালাকে কেন ঘৃণা করে পাকিস্তান?
গত ৭ জুলাই মালালা ইউসুফজাই টুইটারে প্রথম টুইট পোস্ট করেন। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে হাজার হাজার ফলোয়ার পান এবং টুইটার দুনিয়ায় অনেকেই তাকে উষ্ণ অভিনন্দন জানান। সম্প্রতি তিনি হাই স্কুল থেকে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেছেন এবং তার ২০তম জন্মদিন উদযাপন করেন।
এনিয়ে গত কয়েক দিন ধরে বিভিন্ন দাতা, রাজনীতিবিদ ও বিনোদন দুনিয়ার মানুষের কাছ থেকে আবেগপূর্ণ প্রশংসা ও হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়ার মতো অভিনন্দন বার্তা পাচ্ছেন মালালা।
তার সফলতার গল্পের প্রতিক্রিয়া কেবল স্বাভাবিক বলেই মনে হয়; যার শুরু হয়েছিল ২০১২ সালে। মাথায় তালেবান বন্দুকধারীদের গুলির পর থেকে তার গল্পের যাত্রা শুরু। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী হয়ে ওঠা ও বিশ্বব্যাপী নারী শিক্ষার অগ্রগামী মালালা এখন কাজ করছেন দেশের বাইরে। ২০১৩ সাল থেকে যুক্তরাজ্যে বসবাস করছেন তিনি। তবে সম্প্রতি কিছু পাকিস্তানি মালালাকে নিয়ে ভিন্নভাবে প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন।
টুইটারে অনেক পাকিস্তানি তাকে ‘কলঙ্কিত’ এবং ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। অনেকেই তার বিরুদ্ধে সমালোচনা শুরু করেছেন।
তারা বলছেন, মালালার ক্ষেত্রে বিশেষ কিছুই ঘটেনি। মালালার চেয়েও অনেক কঠিন ভাগ্য বরণ করছে অনেক পাকিস্তানি শিশু। মালালা এখন পর্যন্ত পাকিস্তানের জন্য কী করেছেন? বিশ্ব মালালাকে এতো ভালোবাসে কেন? মালালা যদি পাকিস্তানকে নিয়ে আগ্রহী হতেন তাহলে কেন তিনি দেশে ফিরছেন না? এ ধরনের বাজে মন্তব্য ছাড়াও সাধারণ একটি ষড়যন্ত্র তত্ত্বও আছে যে, ‘তাকে গুলির ঘটনা ছিল সাজানো।’
তবে অনেক পাকিস্তানি মালালার প্রশংসা করছেন এবং তাকে সাধুবাদ জানাচ্ছেন। পাকিস্তানি ম্যাগাজিন দ্য হেরাল্ডের পাঠকরা ২০১২ সালে এক ভোটাভুটিতে মালালাকে ‘পারসন অব দ্য ইয়ার’ নির্বাচিত করেন। ২০১৪ সালে পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক জরিপে দেখা যায়, তার সম্পর্কে অনুকূল দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন ৩০ শতাংশ মানুষ। এ সংখ্যা কম হলেও যারা তাকে অপছন্দ করেন তার চেয়ে ২০ শতাংশ বেশি।
মালালা জাতীয় বীর নন। দেশের বাইরে তিনি অনেক সম্মানিত, দেশের ভেতরে অনেক মধ্যবিত্ত পাকিস্তানিই তাকে গালিগালাজ করেন; যাদের তার শ্রেষ্ঠ ভক্ত হিসেবে মনে করা হতো। গত কয়েক বছর ধরে গণমাধ্যমে দেয়া সাক্ষাৎকারে বিভিন্ন স্তরের পাকিস্তানি শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী, দোকান মালিক, সাংবাদিক, গৃহবধূ, এমনকি মানবাধিকার কর্মী মালালার ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।
এ ধরনের কাজ কখনো কখনো আরো সংগঠিত আকার ধারণ করে। ২০১৪ সালের নভেম্বরে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার মাত্র এক মাস আগে পাকিস্তানের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সংগঠন ‘অল পাকিস্তান প্রাইভেট স্কুল ফেডারেশন’ মালালার বিরুদ্ধে নামে। প্রায় দেড় লাখ শিক্ষার্থীর এই সংগঠন সেসময় ‘আমি মালালা নই’ (আই অ্যাম নট মালালা) নামে একটি দিবস উদযাপনের ঘোষণা দেয়। মালালাকে নিষিদ্ধ করারও ডাক দেয় এই সংগঠন।
শত্রু দেখা যায় তার নিজ সম্প্রদায়েও। মে মাসে মালালার জন্মভূমি পাকিস্তানের সোয়াতের এক সংসদ সদস্য বলেন, মালালার ওপর হামলার ঘটনা ছিল পূর্বপরিকল্পিত এবং অনেক স্তরের খেলোয়াড় এর পেছনে জড়িত; এমনকি পাকিস্তানের সরকারি কর্মকর্তারাও।
এমনকি মালালার জীবনী নিয়ে লেখা বেস্ট সেলার বইটিও পাকিস্তানে মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারেনি। অনেক বিক্রেতা মালালার বই বিক্রি করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। কারণ তার বই বিক্রি না করতে তালেবানের হুমকি এবং স্থানীয় পুলিশের নির্দেশ ছিল।
একটা পর্যায়ে এ ধরনের মনোভাব ষড়যন্ত্র তত্ত্ব জিঁইয়ে রাখে কর্তৃপক্ষ। এ ধরনের মনোভাবাপন্ন মানুষ পাকিস্তানের সর্বত্রই ছড়িয়ে আছেন। যাদেরকে স্কুলের পাঠ্যবইয়ে, ধর্মীয় প্রচারে এবং টেলিভিশনের প্রাইম-টাইম শো’তে দেখা যায়।
আংশিকভাবে এটাই চরমপন্থার শক্তি এবং দরিদ্র শিক্ষা ব্যবস্থার একটা বাইপ্রোডাক্ট। তবে এক্ষেত্রে জাতীয় রাজনীতির বাস্তব অবস্থাও ভূমিকা রাখে। অন্যান্য প্রতিষ্ঠান যেমন; শক্তিশালী সেনাবাহিনী, দেশটির ভাগ্যকে রূপান্তর করার ক্ষেত্রে বড় হাত রয়েছে সেনাবাহিনীর। এছাড়া বড় ধরনের নীতিমালাসমূহ যেমন; সম্প্রতি চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর বাস্তবায়নে স্বচ্ছতার ঘাটতির অভিযোগ উঠে। একই সময়ে দেশটির সরকার এবং সামরিক কর্মকর্তারা পানি সংকট থেকে জঙ্গিবাদের মতো সমস্যায় পাবলিক নীতিমালাকে দায়ী করছেন।
দেশটির ইংরেজী ভাষী, সুশিক্ষিত অভিজাত শ্রেণির দৈনিক ‘ডন’ মালালাকে নিয়ে বিদ্রুপাত্মক একটি ব্লগ পোস্ট প্রকাশ করে ২০১৩ সালে। এতে মালালাকে গুলির পেছনে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র মিশন কীভাবে বাস্তবায়ন করা হয়েছিল তা তুলে ধরা হয়। ষড়যন্ত্র তত্ত্বের মাধ্যমে বিদ্রুপাত্মক এই গল্পও অনেক পাকিস্তানি পাঠক সত্য হিসাবে বিশ্বাস করেন। যদিও ডন গল্পের শেষে বলে দেয় যে, এই গল্পের পুরোটাই কাল্পনিক।
মালালার তারুণ্য, প্রাণোচ্ছ্বলতা, সাহস ও দেশপ্রেমকে পাকিস্তান ও দেশটির জনগণের প্রতীক হিসাবে তুলে ধরা হয়। তবে তার এই গল্প দেশটির অন্ধকার একটি অংশকে আয়নায় তুলে ধরেছে। এটি শুধুমাত্র সন্ত্রাসবাদ, নারীবিদ্বেষ এবং ষড়যন্ত্রের ক্ষেত্রে নয় বরং গভীর শ্রেণি বিভাজন এবং তাৎক্ষণিকভাবে বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গিতেও সুক্ষ্ণভাবে ফাঁটল তৈরি করেছে।
এটাই সেই পাকিস্তান, যেখানে একদিন ফেরার প্রত্যাশা করেন মালালা: একটি জটিল এবং বিভক্ত দেশ যেখানে কারো নায়ক তো অন্য কারো ভিলেন হতে হয় প্রায়ই। (সংক্ষেপিত)।
>>যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী ম্যাগাজিন ‘ফরেন পলিসি’তে প্রকাশিত নিবন্ধ।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন