মিরপুরের ‘দুই কষ্ট’ দুবাইয়ে মুছে যাবে?

এশিয়া কাপ। ক্রিকেটের এই টুর্নামেন্টটার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কটা নিবিঢ়। বলা যায় আত্মার। বাংলাদেশ প্রথম বার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের স্বাদ পায় এই এশিয়া কাপ দিয়ে। সেটা সেই ১৯৮৬ সালে। শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় এশিয়া কাপে অংশ নেওয়ার মাধ্যমেই ওয়ানডে ক্রিকেটে অভিষেক হয় বাংলাদেশের। এর পরের সব ক’টি এশিয়া কাপেই উড়েছে লাল-সবুজের পতাকা। ক্রিকেট দেবতার কারসাজিতে বাংলাদেশের অন্যতম সেরা ‘দুই ক্রিকেট কষ্ট’ও এই এশিয়া কাপেই।

বুঝতেই পারছেন সেই কষ্ট দুটি ফাইনালে হার। এর আগে দুবার এশিয়া কাপের ফাইনালে খেলেছে বাংলাদেশ। দুটিতেই হার। দুবারই দেশবাসী এশিয়া কাপের শিরোপা স্বপ্ন পূরণের আশায় বুদ হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সহজ সমীকরণটা মেলেনি। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা মেলাতে পারেননি। ক্রিকেট দেবতা দুবারই কাঁদিয়েছে বাংলাদেশের মানুষকে। বাংলাদেশের এই দুটি ক্রিকেট কষ্টেরই স্বাক্ষী মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়াম। শেরে বাংলার গ্যালারিতে বসেই কেঁদেছে বাংলাদেশি সমর্থকেরা। কেউ অঝোরে, হাউমাউ করে। কেউ কেঁদেছে চাপা কান্না।

কান্নার দৃশ্যগুলোর প্রতীকী ছবি হয়ে আছে সাকিব আল হাসানের কান্নার সেই দৃশ্যটি। ২০১২ সালের এশিয়া কাপের ফাইনালে পাকিস্তানের কাছে ২ রানে হারের পর কি কান্নাটাই কেঁদেছিলেন সাকিব! হাউমাউ করে কেঁদেছিলেন মুশফিকুর রহীমও। তবে সাকিবের কান্নাই দেশবাসীর হৃদয় স্পর্শ করেছিল বেশি করে।

এখনো ক্রিকেটে বাংলাদেশের অর্জন-সাফল্যের খাতা খুলতে গেলে সাকিবের সেই ছবিটি হৃদয়পটে ভেসে উঠে। হারলেও সেটা ছিল বাংলাদেশ ক্রিকেটের সাফল্যেরই গল্প। প্রথম বারের মতো এশিয়া কাপের ফাইনালে খেলা, এবং তাতে পরাশক্তি পাকিস্তানকে কাঁদিয়ে ছাড়া-তীরে গিয়ে শিরোপা স্বপ্ন ডুবে গেলেও তখনো পর্যন্ত ক্রিকেটে সেটাই ছিল বাংলাদেশের সেরা সাফল্য।

টানটান উত্তেজনার ম্যাচে জিতব জিতব করে শেষ পর্যন্ত হার। ওই হারের কষ্টের মধ্যে তাই লুকিয়ে ছিল রোমাঞ্চও! শেষ ওভারে বাংলাদেশের দরকার ছিল ৯ রান। হাতে ছিল ২ উইকেট। কিন্তু সমীকরণটা মেলাতে পারেননি মাহমুদউল্লাহ, রাজ্জাকরা। রাজ্জাকের উইকেট হারিয়ে বাংলাদেশ তুলতে পারে ৬ রান। পেতে হয় ২ রানের কষ্ট।

২০১৬ সালে টি-টোয়েন্টি এশিয়া কাপেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। এবার অবশ্য ফাইনালে প্রতিদ্বন্দ্বিতাই গড়তে পারেনি বাংলাদেশ। ২০ ওভারের ক্রিকেটের একমাত্র এশিয়া কাপের ফাইনালটিতে অনায়াসেই জিতে যায় ভারত। বাংলাদেশের করা ১২০ রান ২ উইকেট হারিয়ে মাত্র ১৩.৫ ওভারেই টপকে যায় ভারত। বাংলাদেশের মানুষ পায় শিরোপা জিততে না পারার দ্বিতীয় কষ্ট।

এই দুই কষ্টের পথ বেয়ে আবারও এশিয়া কাপের ফাইনালে বাংলাদেশ। তবে এবার ঢাকায় নয়, ফাইনালটা হবে আরব আমিরাতের দুবাইয়ে। বুধবার আবুধাবিতে ‘অলিখিত সেমিফাইনালে’ রূপ নেওয়া সুপার ফোরের শেষ ম্যাচে পাকিস্তানকে ৩৭ রানে হারিয়ে তৃতীয় বারের মতো ফাইনালে উঠেছে মাশরাফি বিন মুর্তজার দল। কাল শুক্রবার দুবাই ক্রিকেট স্টেডিয়ামে শিরোপার লড়াইয়ে প্রতিপক্ষ ভারত।

সেই ভারত, দুই বছর আগে যারা মিরপুরে কষ্টে কাঁদিয়েছিল দেশবাসীকে। স্বাভাবিকভাবেই মনের কোণে প্রশ্নটা জাগছে, মিরপুরের সেই দুই কষ্ট দুবাইয়ে মুছে ফেলতে পারবে মাশরাফির বাংলাদেশ? নাকি মিরপুরের মতো দুবাইও সাজিয়ে রেখেছে বাংলাদেশের জন্য ‘তৃতীয় কষ্ট’?

সম্ভাবনা দুটিই আছে। তবে আসুন ম্যাচ শুরুর আগে আমরা শুধু প্রথম সম্ভাবনার ছবিটাই আঁকি। শিরোপার স্বপ্নের ছবিই আঁকব। কিন্তু সেই স্বপ্ন সাজাতে গিয়ে দুটি বিষয় উঠে আসছে সামনে। প্রথমত ভারত ক্রিকেটের অন্যতম পরাশক্তি। এশিয়া কাপে সর্বোচ্চ ৬ বারের চ্যাম্পিয়ন তারা। এবারও ফাইনালে উঠেছে দাপটের সঙ্গে।

আফগানিস্তানের বিপক্ষে টাই ম্যাচটা বাদ দিলে টুর্নামেন্টের বাকি ৪ ম্যাচেই দাপুটে জয় পেয়েছে ভারত। বিশেষ করে পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে রীতিমতো নাস্তানুবাদ করে ছেড়েছে তারা। পাকিস্তানকে আবার বিধ্বস্ত করেছে দুবার। স্বাভাবিকভাবেই কালকের ফাইনালে পরিস্কার ফেভারিট রোহিত শর্মার ভারত।

দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশকে ফাইনালটি খেলতে হচ্ছে দলের সবচেয়ে বড় দুই তারকা সাকিব আল হাসান ও তামিম ইকবালকে ছাড়া। এই দুজনকে ছাড়াই অবশ্য বুধবার পাকিস্তানকে হারিয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু ফাইনাল প্রতিপক্ষ ভারত বলেই তামিম-সাকিবের শূন্যতার বিষয়টি বড় হয়ে উঠছে। ভারতকে হারাতে হলে নিশ্চিতভাবেই ব্যাটে-বলে আরও কঠিন লড়াই করতে হবে বাংলাদেশকে।

সেই লড়াইয়ে সবচেয়ে বড় অস্ত্র হতে পারতেন তামিম-সাকিব। কিন্তু চোট তাদের ছিটকে ফেলেছে। তাদের অনুপস্থিতি অবশ্য অনুপ্রেরণারও হতে পারে। বুধবার পাকিস্তানের বিপক্ষে অন্তত তাদের অনুপস্থিতিকে অনুপ্রেরণা প্রমাণ করেছে মাশরাফির দল। মুশফিক, মিঠুন, মোস্তাফিজ, মাহমুদউল্লাহ, মেহেদী হাসান মিরাজদের পারফরম্যান্স দেখে মনেই হয়নি তামিম-সাকিব নেই। একটা দল হিসেবেই পাকিস্তানকে হারিয়েছে বাংলাদেশ।

কাল ঠিক এভাবে একটা দল হয়ে খেলতে পারলেই খুলে যেতে পারে সম্ভাবনার দুয়ার। মুছে যেতে পারে মিরপুরের ওই দুই কষ্ট। খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে টানা দুই জয়ে ফাইনাল। মাশরাফির দল সত্যিকার অর্থেই আত্মবিশ্বাসে টইটুম্বুর। এই আত্মবিশ্বাসটাই হতে পারে মিরপুরের দুই কষ্ট মুছে ফেলার টোটকা।

মাশরাফিরা পারবেন সেই দুই কষ্ট ভুলিয়ে দেশকে প্রথম বারের মতো এশিয়ার চ্যাম্পিয়ন করতে?