মোবাইল ব্যাংকিং : হাজার কোটির অস্বাভাবিক লেনদেন, পাচারের আশঙ্কা

ফেনীর বনিটো কমিউনিকেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান বিকাশের জেলা ডিস্ট্রিবিউটর। এর মালিক স্থানীয় এক ব্যবসায়ী। তার ব্যক্তিগত ও প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে ৩ হাজার ৪৭০ কোটি ৩৪ লাখ টাকার অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য পেয়েছে আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা। এর মধ্যে গত এক বছরে তার ব্যাংক হিসাবে জমা হয়েছে ৯২৫ কোটি টাকা। বিপুল এ অর্থের ৯৯ শতাংশই জমা হয়েছে নগদ টাকা হিসেবে। এত টাকা নগদে জমা হওয়ায় ডিস্ট্রিবিউটরশিপের আড়ালে ডিজিটাল হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্সের বিপরীতে লেনদেন হয়েছে বলে সন্দেহ করছে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।

বিষয়টি অনুসন্ধান করছে সিআইডি। সিআইডির ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিটের বিশেষ পুলিশ সুপার বাছির উদ্দিন বলেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে পাঠানো কিছু মোবাইল ব্যাংকিং মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) গ্রাহকের অনিয়ম নিয়ে তারা কাজ করছেন। সেখানে বিকাশের বেশকিছু গ্রাহকের বিধিবহির্ভূত লেনদেনের প্রমাণ মিলেছে। এসব হিসাব খোলার ক্ষেত্রে যাদের সংশ্লিষ্টতা ছিল, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে পুলিশ।

পুলিশ সুপার বলেন, ‘হুন্ডি, অর্থ পাচারসহ বিধিবহির্ভূত লেনদেনে জড়িত মার্চেন্ট হিসাব ও এজেন্ট অসংখ্য।’ অনেকের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে মামলা হয়েছে। আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু ফেনীর বনিটো কমিউনিকেশন এবং এর মালিকের ব্যাংক হিসাবেই ৩ হাজার ৪৭০ কোটি ৩৪ লাখ টাকার অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য মিলেছে। এসব বিষয়ে অনুসন্ধান চলমান রয়েছে বলে জানান পুলিশ সুপার বাছির উদ্দিন।

এমএফএস ব্যবহার করে কয়েক বছর ধরে হুন্ডি, অর্থ পাচার ও ঘুষ লেনদেন চলছে। এসব অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও দায়ীদের আইনের আওতায় আনার লক্ষ্যে বিকাশ, নগদ, রকেট, উপায়, ইউক্যাশ, মাইক্যাশ, এমক্যাশ, শিওরক্যাশসহ এমএফএস-সেবা দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর সার্ভারে প্রবেশের অনুমতি চায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সংস্থাটির কর্মকর্তারা মোবাইল ব্যাংকিং-সেবা দেওয়া ১৩ এমএফএস প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি ও ব্যাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠকও করে। তাতে সাড়া মেলেনি।

দুদক পরিচালক (মানি লন্ডারিং) গোলাম শাহরিয়ার চৌধুরী প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘এমএফএস সার্ভিস ব্যবহার করে হুন্ডি ও ঘুষ লেনদেনের অনেক অভিযোগ আমাদের কাছে আসে। এসব প্রতিরোধে দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের নির্দেশে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সব এমএফএস সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দেওয়া হয়। এমএফএস সার্ভিস সার্ভারে প্রবেশাধিকারসহ তাদের জবাবদিহি নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন বিষয়ে তুলে ধরে প্রতিনিধিদের সঙ্গে কয়েকটি মিটিংও করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে এ উদ্যোগ আর এগোয়নি।’ তিনি আরও বলেন, বিশেষত হুন্ডির বিষয়টি সিআইডি তদন্ত করায় দুদক আর এ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেনি।

এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেওয়া দুদকের চিঠিতে বলা হয়, মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস ব্যবহার করে সরকারি-বেসরকারি দপ্তরে অবাধে ঘুষ লেনদেন হচ্ছে। এসব মাধ্যমে দেশের বাইরে হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাচারের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। এসব অবৈধ ও অপরাধমূলক লেনদেন বন্ধ এবং দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানের প্রয়োজনে এমএফএস সার্ভিসের সার্ভারে দুদকের প্রবেশাধিকার জরুরি।

দুদকের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, আমরা বেশকিছু অভিযোগ অনুসন্ধানের সময় দেখেছি বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের কিছু অসাধু কর্মকর্তা বিকাশ, নগদ ও রকেটের মাধ্যমে ঘুষ লেনদেন করেছেন। এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য-প্রমাণ চেয়ে বিএফআইইউকে চিঠি দিলে তারাও কিছু তথ্য আমাদের দিয়েছে, কিন্তু তা আশানুরূপ নয়।

দুদকের গোয়েন্দা ইউনিটের এক রিপোর্টে বলা হয়, ‘সরকারি দপ্তরের কিছু অসাধু কর্মকর্তা মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে প্রচুর পরিমাণে ঘুষের টাকা গ্রহণ করেছেন। এসব বিষয়ে বিএফআইইউর কাছ থেকে দুদক আশানুরূপ তথ্য পাচ্ছে না। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি এক সার্কুলারে এমএফএস অ্যাকাউন্টে সব ধরনের ক্যাশ ইন/ক্যাশ আউটের ডিজিটাল মানি রিসিটের বিস্তারিত তথ্য দুদকের অনুসন্ধান বা তদন্তের প্রয়োজনে সরবরাহের নির্দেশনা দিয়েছে। একই সার্কুলারে এমএফএস গ্রাহক ও লেনদেনের তথ্যভাণ্ডার থেকে দুদককে রিয়েল টাইম তথ্য প্রদানের বিষয়টিও নিশ্চিত করা হয়েছে।

অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধ ও দমন কার্যক্রম জোরদারের লক্ষ্যে গঠিত কেন্দ্রীয় টাস্কফোর্সের এক সভায় পুলিশের পক্ষ থেকে এমএফএস সার্ভারে প্রবেশের বিষয়ে বলা হয়। ওই সভায় জালিয়াতি রোধে গ্রাহকদের তথ্য সরাসরি সরবরাহ নিশ্চিত করার কথা বলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা।

বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো সিআইডির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এমএফএস নিয়মের বাইরে বিকাশের কিছু মার্চেন্ট এজেন্ট খোলা হয়েছে। এসব হিসাব বিকাশ এজেন্ট পয়েন্টে চালু রেখে তাতে বিধিবহির্ভূত লেনদেন করা হয়েছে। বিকাশ কর্তৃপক্ষ অর্থ পাচার বিধিমালা অনুযায়ী গ্রাহকের বিষয়ে যথাযথ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। বিকাশের কিছু মার্চেন্ট হিসাবে লেনদেনে ব্যাপক অসঙ্গতি পাওয়া গেছে। সিআইডি ওইসব মার্চেন্ট হিসাব ও এজেন্টের নিবন্ধন বাতিলের সুপারিশ করে। পাশাপাশি যেসব ডেইলি সেলস অফিসার (ডিএসও) অভিযুক্ত মার্চেন্ট হিসাবগুলো খুলে দিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধেও বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করে। একই সঙ্গে যেসব এজেন্ট পয়েন্ট ওই মার্চেন্ট হিসাবগুলো রেখে বিধিবহির্ভূতভাবে লেনদেন করেছে, তাদের এজেন্টশিপ বাতিল, নিবন্ধনদাতা ডিস্ট্রিবিউটরের ডিস্ট্রিবিউটরশিপ বাতিলের কথা বলা হয়। অর্থ পাচার বিধিমালা অনুযায়ী গ্রাহকের বিরুদ্ধে যথাযথ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে সিআইডি।

প্রতিবেদনে উদাহরণ হিসেবে বলা হয়, ঢাকার আশুলিয়ায় মোল্লা ডেকোরেটর অ্যান্ড টেলিকমের নামে খোলা মার্চেন্ট হিসাবটি ব্যবহার করেন বিকাশ এজেন্ট মো. রাজু আহম্মেদ। নিজের এজেন্ট পয়েন্টে মার্চেন্ট হিসাবে লেনদেন করেন তিনি। অপর একটি মার্চেন্ট অ্যাকাউন্ট খোলা হয় চট্টগ্রামের প্রতিষ্ঠান টু স্টার পোল্ট্রি অ্যান্ড সেলস সেন্টারের নামে। সেই মার্চেন্ট হিসাবটি উদ্ধার করা হয়েছে পার্শ্ববর্তী বিকাশ এজেন্ট পয়েন্ট বায়েজিদ কুলিং কর্নার অ্যান্ড টেলিকম থেকে। সেখানে ক্যাশ আউট করতে আসা গ্রাহকদের কাছ থেকে মার্চেন্ট হিসাবে পেমেন্ট নেওয়া হতো, যা বিধিসম্মত নয়।

বিকাশের হেড অব করপোরেট কমিউনিকেশনস শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম বলেন, ‘কোনো গ্রাহকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক অথবা বিএফআইইউ থেকে কোনো গ্রাহকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বললে আমরা সঙ্গে সঙ্গে তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। এ ছাড়া সন্দেহজনক বা অবৈধ লেনদেন প্রতিরোধে আমরা নিজেরাই সন্দেহজনক লেনদেন (এসটিআর) ও সন্দেহজনক কার্যক্রম (এসএআর) দুই ধরনের পর্যবেক্ষণ করে থাকি। কোনো গ্রাহকের সন্দেহজনক লেনদেন পাওয়া গেলে আমরা গ্রাহকের কার্যক্রম সাময়িক বন্ধ করাসহ তা প্রতিবেদন আকারে বিএফআইইউতে পাঠাই। বিএফআইইউ তদন্ত করে দেওয়া প্রতিবেদনের আলোকে আমরা বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। এটি নিয়মিত প্রক্রিয়ারই অংশ। দুদক, সিআইডি বা আইনপ্রয়োগকারী অন্য কোনো সংস্থা আমাদের সরাসরি প্রতিবেদন দেয় না। তারা অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য পেলে বাংলাদেশ ব্যাংককে দেয়। বাংলাদেশ ব্যাংক আমাদের সে অনুযায়ী নির্দেশনা দেয়।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. মেজবাউল হক অভিযোগ পেলে বাস্তবায়ন করা হয় বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এমএফএস সার্ভিস বা মোবাইল ব্যাংকিংয়ে অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য পেলে আমরা বিএফআইইউকে দিই। তারা বিধিবহির্ভূত লেনদেনের বিষয়ে সন্দেহ করলে অধিকতরও তদন্ত ও আইনগত ব্যবস্থা নিতে সিআইডি বা দুদকে দেয়। সিআইডি বা দুদক থেকে কোনো সুপারিশ করা হলে তা পর্যালোচনা করা হয়। এর মধ্যে যেগুলো বাস্তবায়নযোগ্য, সেগুলো বাস্তবায়ন করা হয়।