মোবাইল-সিম-ইন্টারনেটের ওপর বাজেটে ভ্যাট-ট্যাক্স কমবে কি?
ডিজিটাল বাংলাদেশের সুবিধা আরো বেশি করে ছড়িয়ে দিতে আসন্ন ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে মোবাইল, সিম, ইন্টারনেটের ওপর আরোপিত উচ্চ ভ্যাট বা মূল্য সংযোজন কর, ট্যাক্স (আয় বা লভ্যাংশরে ওপর প্রদেয় কর) কমানোর দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ খাতে উচ্চ হারের ভ্যাট ও ট্যাক্স গ্রামীণ জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দেয়ার অন্তরায় বলে মনে করছেন তারা। আর কম্পিউটার পণ্যে আমদানি শুল্ক ও মূসক আগের মতো রাখার দাবি আসলেও দেশে তৈরি আরো উৎসাহিত করতে আমদানির ওপর শুল্ক বাড়ানোর পক্ষে ডাক ও টেলিযোযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার।
জানা যায়, বাংলাদেশে বর্তমানে ডেটা ব্যতীত মোবাইল সেবা ব্যবহারের ওপর ট্যাক্স রয়েছে ৩৩ দশমিক ২৫ শতাংশ (ভ্যাট ১৫ শতাংশ, সম্পূরক শুল্ক ১০ শতাংশ, এবং সারচার্জ ৫ শতাংশ ) এবং মোবাইল ইন্টারনেট কথা ডেটা সেবার ওপর তা ২১ দশমিক ৭৫ শতাংশ (ভ্যাট ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক ১০ শতাংশ সারচার্জ ৫ শতাংশ)। অর্থাৎ গ্রাহককে ১০০ টাকা সমমূল্যের সেবা ব্যবহার করতে গেলে আরো ৩৩ দশমিক ২৫ টাকা ট্যাক্স আকারে দিতে হয়। যা ডাটার ক্ষেত্রে ২১ দশমিক ৭৫ টাকা। গত বছরের বাজেটে সম্পূরক শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি করে ১৫ শতাংশ করা হয়েছিল। নতুন সিম সংযোগ ক্রয়ের ক্ষেত্রে এখন সিম প্রতি ২০০ টাকা ভ্যাট প্রযোজ্য।
অন্যদিকে বর্তমানে ওএনইউ (অপটিকাল নেটওয়ার্ক ইউনিট) এবং ওএলটির (অপটিক্যাল লাইন টার্মিনাল) ওপর ট্যাক্স ৩৭ শতাংশ ও ৫৯ শতাংশ আরোপিত রয়েছে। এসবকে উচ্চহার বলছেন এ সংক্রান্ত সেবাদান প্রতিষ্ঠান বা ব্যবসায়ীরা।
২০১১-১৫ এর সঙ্গে ২০১৬-২০ সময়কাল টেলিযোগাযোগ খাতের সম্মিলিত সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ তুলনা করলে দেখা যায় পরবর্তী ৫ বছরে তা ৩৮ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। এর পেছনে বড় একটি কারণ উচ্চ করপোরেট কর হার (শেয়ারবাজারে অন্তর্ভুক্ত হলে ৪০ শতাংশ না হলে ৪৫ শতাংশ সাধারণ হার ৩২ দশমিক ৫ শতাংশ ও ২৫ শতাংশ)।
অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায় বাংলাদেশে করপোরেট কর হার সবচাইতে বেশি। যেমন ভারতে ২২ শতাংশ, শ্রীলঙ্কায় ২৮ শতাংশ, নেপালে ৩০ শতাংশ, মালয়েশিয়ায় ২৪ শতাংশ এমনকি আফগানিস্তানে ২০ শতাংশ। করপোরেট করও গ্রাহকদের কাছ থেকে আদায় করা হয় পরোক্ষভাবে।
দেশে উচ্চগতির ইন্টারনেট সেবা প্রদানের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট। কিন্তু ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট প্রার্থী ও সরবরাহের ক্ষেত্রে রয়েছে অনেক প্রতিবন্ধক কর হার। নানাবিধ হার বিদ্যমান থাকায় গ্রাহকরা উচ্চ গতির ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যদিও ভ্যাট ১৫ শতাংশ। বাস্তবে ইন্টারনেটের সঙ্গে চুক্তির ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন কর সম্পৃক্ত থাকায় কর অনেক বেশি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন,
মোবাইল সিমের ওপরে ২০০ টাকা ট্যাক্স। এই ২০০ টাকা কিন্তু গ্রাহকদের কাছ থেকেই নেয়া হয়। মোবাইল কোম্পানিগুলো ৫০ থেকে ৬০ টাকায় সিম বিক্রি করলেও পরবর্তীতে এরা বিভিন্নভাবে টাকা কেটে রাখে। গ্রাহক কত টাকা রিচার্জ করে কত খরচ করল এ ব্যাপারে তারা যদি ব্যালেন্স শিট দিত তাহলে বোঝা যেত। এই টাকা তারা একবারে কাটা না। আস্তে আস্তে ভ্যাট হিসেবে কেটে নেয়। তাই সরকারকে এই ট্যাক্স মওকুফ করে দেয়ার দাবি জানাই।
তিনি বলেন, দেশে মোবাইল তৈরি করার জন্য সরকার উৎসাহ দিচ্ছে। কিন্তু মোবাইলফোন আমদানি করলে প্রায় ৬০ শতাংশ শুল্ক-কর দিতে হয়। আবার দেশীয় উৎপাদনকারীরা আরেকটি সুবিধা পায়। তারা কাঁচামাল আমদানির ওপর ৫ শতাংশ সুবিধা পায়। তারা সরকারের কাছ থেকে উল্টো আরো সুবিধা নিলেও দাম কিন্তু কম রাখে না। মানেও কিন্তু আমদানি করার মোবাইলের মতো নয়, অথচ দাম বেশি।
এখন সাধারণ শিক্ষার্থীরা মোবাইল সেট পাচ্ছে না, কিন্তু দেশীয় কোম্পানিগুলোর তৈরি মোবাইলের দাম কিন্তু কমেনি।
মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, তাই বাজার প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করার জন্য আমদানি শুল্ক আরো কমানোর দাবি জানাই। কারণ দেশে উৎপাদনকারী মোবাইল কোম্পানি রাষ্ট্রের সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবে অথচ জনগণ উপকৃত হবে না।
অন্যদিকে আমদানিকারকরা বিভিন্নভাবে অবৈধপথে মোবাইল আনবে। এতে দেশের জনগণ এবং রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমরা শিক্ষার্থীদের মাঝে কমমূল্যে হ্যান্ডসেট সরবরাহ করতে শর্তসাপেক্ষে অপারেটরদের সংযুক্তসহ এই শুল্ক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে সুপারিশ করছি।
এ বিষয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, আজকে বাংলাদেশ মোবাইল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের দিকে যাচ্ছে। ইতোমধ্যেই আমরা ৬২ ভাগের ওপরে ডোমেস্টিক চাহিদা মিট করছি। রফতানিও করছি আমরা। স্মার্টফোনের প্রায় ৮৫ ভাগ বাংলাদেশ উৎপাদন করছে।
আর আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে আমরা রফতানি করছে। দেশেই মোবাইল তৈরিতে আমরা এক থেকে দুই বছরের মধ্যে পুরোপুরি স্বয়ংসম্পূর্ণ নতুন নতুন ইন্টারন্যাশনাল ব্র্যান্ড বাংলাদেশে উৎপাদনের চেষ্টা করছি। তারপরও কোনো কোনো যন্ত্রাংশের ক্ষেত্রে কিছু কিছু বাড়তি শুল্ক আছে। আমরা চিঠি দিয়েছি। সেই বাড়তি শুল্ক প্রত্যাহার করার আবেদন জানিয়ে রেখেছি।
তিনি আরো বলেন, ইন্টারনেটের দাম বেশি এ বক্তব্যের সঙ্গে আমি একমত না। সরকার তো মাত্র ২৮৫ টাকা পার এমবিবিএস ব্যান্ডউইথ বিক্রি করে। পারলে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য আমি নিঃসন্দেহে বিনামূল্যে দিতে চাই। সাবসিডিও দিতে চাই। কিন্তু ইন্টারনেটভিত্তিক বিজনেসের জন্য আমি মনে করি না বাংলাদেশে ইন্টারনেটের যে দাম, সেই দাম মোটেই বেশি। ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারীগুলোর (আইএসপি) যে ব্যান্ডউইথ বিক্রি করা ওটার সঙ্গে তুলনা করেন তাহলে সব ঠিক আছে। কিন্তু সবাই কেবলমাত্র আপনার মোবাইল ডাটার কথা হিসাব করেন। মোবাইল বেসিক্যালি ইন্টারনেটের কম্পনেন্ট না।
আমার ইন্টারনেট দেয়ার কথা হচ্ছে আইএসপির মাধ্যমে। আইএসপি লাইনের ক্ষেত্রে আমি তো একেবারে গ্রাম অঞ্চলে এমবিবিএস এক মাসে ৫০০ টাকার উপরে হয় না। আমরা দেশের সব জায়ায় আএসপি পৌঁছে দিচ্ছি।
কম্পিউটার পণ্যে আমদানি শুল্ক ও মূসক আগেই মতো রাখার দাবি
জানা যায়, ১৯৯৬ সালের পর থেকে এখন থেকে কম্পিউটার পণ্যে আমদানি শুল্ক ও মূসক নেই। ভ্যাটমুক্ত পণ্যগুলো হলো- কম্পিউটার প্রিন্টার, কম্পিউটার প্রিন্টারের জন্য টোনার/ইঙ্কজেট কারট্রিজ ও প্রিন্টারের অন্যান্য যন্ত্রাংশ; কম্পিউটার এবং কম্পিউটারের আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ; মডেম, ইথারনেট কার্ড, নেটওয়ার্ক সুইচ, হাব ও রাউটার; ডেটাবেইজ, অপারেটিং সিস্টেম, ডেভেলপমেন্ট টুলস, অন্যান্য ম্যাগনেটিক মিডিয়া, আনরেকর্ডেড অপটিক্যাল মিডিয়া, অ্যান্টিভাইরাস ও নিরাপত্তা সফটওয়্যার, ফ্ল্যাশ মেমোরি কার্ড অথবা একইরকম কার্ড, প্রক্সিমিটি কার্ড ও ট্যাগ; ডেটা প্রসেসিং সিস্টেমে ব্যবহৃত কম্পিউটার মনিটর, ২২ ইঞ্চি পর্যন্ত কম্পিউটার মনিটর এবং কম্পিউটার প্রিন্টারের রিবন।
কম্পিউটার পণ্যে আমদানি শুল্ক ও মূসক আগের মতো রাখার দাবি জানিয়েছেন এ সংক্রান্ত ব্যক্তিরা। কারো প্ররোচনায় যেন সরকার নতুন করে শুল্ক ও মূসক আরোপ না করে সেদিকে নজর রাখার অনুরোধ জানিয়েছেন ব্যবসায়ী নেতারা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির (বিসিএস) ভাইস প্রেসিডেন্ট জাবেদুর রহমান শাহীন বলেন, ‘আমরা এই মুহূর্তে অনেক কিছু চাইলেও সরকার তা দিতে পারবে না। কারণ গভর্নমেন্টের আর্থিক অবস্থা সেরকম ভালো না। তাই আমরাও নতুন করে কিছু চাই না। আমাদের দাবি কারো প্ররোচনায় কিংবা কারো পরামর্শে সরকার যেন ট্যাক্স আরোপ না করে। সবকিছু যেন আগের মতই থাকে। নতুন করে যদি ট্যাক্স ধরা হয় তাহলে এই ইন্ড্রাস্ট্রিটা বসে যাবে।
তিনি আরো বলেন, এখন মনিটরই ২২ ইঞ্চি আর থাকছে না। মনিটর যখন ২২ ইঞ্চির উপর চলে যায় তখন ট্যাক্স আসে ৬০ শতাংশ। এখন সব মনিটর ২৪, ২৭ ইঞ্চি হয়ে যাচ্ছে। সবাই বড় মনিটর ব্যবহার করতে চায়। পৃথিবীতে ছোট মনিটর ব্যবহার ও তৈরি কমে গেছে। ছোট মনিটর পাওয়া যায় না। তাই কমপক্ষে ২৪ ইঞ্চি পর্যন্ত ট্যাক্স ফ্রি চাচ্ছি আমরা।
এ বিষয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার জাগো নিউজকে বলেন, দেশে তৈরি ল্যাপটপ খুবই ভাল। আইসিটি ডিভিশন ও তার মন্ত্রণালয়সহ প্রায় ৯০ হাজার কম্পিউটার কিনলেও কোনো জটিলতা দেখা দেয়নি। কিন্তু দেশে কম্পিউটারে উৎপাদনের ক্ষেত্রে কিছু ট্যাক্স জটিলতা আছে। সেক্ষেত্রে এগুলো যেন প্রত্যাহার করা হয়।
একইভাবে আমি মনে করি কম্পিউটার আদানির ওপর শুল্ক আছে এই স্বল্প শুল্ককে বেশি শুল্কে রূপান্তরিত করা হোক। কারণ আমাদের অন্যের বাজার হওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই। শুধুমাত্র চিপ ছাড়া সবগুলো ইচ্ছে করলে আমরা লুকালি ম্যানুফ্যাকচার (উৎপাদন) করতে পারি এবং পারব।
বিটিআরসির ওয়েবসাইটে ২০২১ সালের মার্চ মাসের প্রতিবেদনে অনুযায়ী, দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে মোট ১১ কোটি ৬১ লাখ ৪০ হাজার। অপরদিকে ব্রডব্যান্ড গ্রাহকের সংখ্যা ৯৮ লাখ ১০ হাজার। দেশে মোবাইল ফোনের সংযোগের সংখ্যা ১৭ কোটি ৪৬ লাখ ৩০ হাজার।
ওয়েবসাইটে আরো উল্লেখ করা হয়, মোবাইল ফোনের সংযোগে শীর্ষে রয়েছে গ্রামীণফোন। তাদের সংযোগ সংখ্যা ৮ কোটি ৭৫ লাখ। রবির রয়েছে ৫ কোটি ১৯ লাখ ৪০ হাজার সংযোগ। যা দ্বিতীয় স্থান। অন্যদিকে বাংলালিংক আছে তৃতীয় স্থানে। তাদের সংযোগ সংখ্যা ৩ কোটি ৬২ লাখ ৫০ হাজার। আর টেলিটকের সংযোগ সংখ্যা ৫৬ লাখ ৫৭ হাজার।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন