যে চিকিৎসা নিতে পাশ্চাত্যের নাগরিকেরা বাংলাদেশে
অবাক লাগছে? লাগারই কথা? যেখানে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সেবার মান নিয়ে নেতিবাচক খবরে মিডিয়া সয়লাব, দেশের মানুষ পাগলের মত ছুটছে ভারত, থাইল্যান্ড, সিংগাপুরসহ নানা দেশে সে দেশে যদি ব্রিটিশ কিংবা আমেরিকান নাগরিকেরা চিকিৎসা নিতে আসে সেটাকে পাগলের প্রলাপ মনে হতেই পারে।
তবে এটি কোন প্রলাপ না, এটি একদমই বাস্তব। বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস উপলক্ষ্যে গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএস কনফারেন্স রুমে লিভার রোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ সপ্নীল জানান এ কথা। তিনি এবং তার মত এদেশের ডাক্তারদের কাছেই যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের মত অঞ্চল থেকে রোগীরা আসছেন ক্রনিক হেপাটাইটিস এর চিকিৎসা নিতে। কেন, আসছেন? কি করেছেন ডাঃ সপ্নীলেরা?
NASVAC নামটি মনে রাখুন। কারন এটি বাংলাদেশীদের উদ্ভাবিত প্রথম নিউ ড্রাগ মলিউকিউল যেটি ক্লিনিকাল ট্রায়ালের নানা ধাপ পেরিয়ে শেষ ধাপে আছে এবং কিউবা সহ আরো কিছু দেশে ইতিমধ্যে বাজারজাত শুরু হয়েছে। ডাঃ মাহতাব আল মামুন সপ্নীল, বংগবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ও ড. শেখ মোহাম্মদ ফজলে আকবর, জাপান প্রবাসী চিকিৎসাবিজ্ঞানী, তারা দুজন এই সাফল্যের নেপথ্য কারিগর। Novel Nasal Vaccine for Hepatitis B বা NASVAC যুক্তরাষ্ট্রের FDA এবং বাংলাদেশ ওষূধ প্রশাসন এর অনুমতি নিয়ে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালিয়েছে যাতে দেখা গেছে ন্যাসভ্যাক প্রয়োগে ৬ মাসে ৫৯% হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের কারনে ক্রনিক হেপাটাইটিসে আক্রান্ত রোগী সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করেছেন অন্যদিকে প্রচলিত স্বীকৃত ওষুধ পেগাইলেটেড ইন্টারফেরন প্রয়োগে আরোগ্য পেয়েছেন ৩৮ শতাংশ রোগী। বর্তমানে ওষুধটি জাপানে মাল্টি সেন্টার ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে আছে। বাংলাদেশে উপযোগী আইন না থাকায় এটি এখনো এদেশে প্রস্তুত করা যায় নি তবে আগামী ২-১ বছরের মাঝেই এটি বাজারে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। চিন্তা করতে পারছেন বাংলাদেশের তৈরি একেবারে নিজেদেরই একটা ঔষধ!
শেষ হয়নি এখনো। বিজ্ঞান পত্রিকা কিংবা প্রচলিত মিডিয়াতেই আমরা অনেক সময় অত্যাধুনিক কিছু চিকিতসার নাম শুনি তার মাঝে স্টেম সেল থেরাপী অন্যতম। উন্নত দেশগুলোতে এ বিষয়ে আলাদা শিক্ষা ও প্রশিক্ষনের সুযোগ রয়েছে। আমাদের দেশে এমন কিছু নেই। কিন্তু যদি বলি এদেশে স্টেম সেল থেরাপী দেয়া হচ্ছে সেটি বিশ্বাস হবে? অবিশ্বাসের কিছু নেই। ডাঃ সপ্নীল ও তার দল এই বাংলাদেশেই স্টেম সেল থেরাপীর মাধ্যমে লিভার সিরোসিস বা ফেইলিউর হয়ে যাওয়া রোগীদের চিকিতসা শুরু করেছেন। লিভার সিরোসিস বা ফেইলিউর হওয়া অধিকাংশ রোগী মৃত্যুবরন করেন এবং এর প্রচলিত চিকিতসা লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট যাতে খরচ প্রায় ৪০-৫০ লক্ষ টাকা এবং উপযোগী ডোনার পাওয়ায় কস্টসাধ্য। স্টেম সেল পদ্ধতিতে চিক্তিসায় খরচ মাত্র ৫০ হাজার থেকে দেড় লক্ষ্য টাকা। স্টেম সেল ব্যবহারের পদ্ধতিটি নতুন না হলেও ডাঃ স্বপ্নীল ও তার দল নিজস্ব উদ্ভাবিত পদ্ধতিতে সরাসরি লিভারের আর্টারিতেই স্টেম সেল প্রয়োগ করছেন এবং এ প্রক্রিয়া ৩ জন রোগীর উপর প্রয়োগ করে ইতিমধ্যে সাফল্য ও পেয়েছেন।
না, এখনো শেষ হয়নি! হেপাটাইটিস সি। হেপাটাইটিস বি এর পাশাপাশি হেপাটাটিস সি ভাইরাস ও লিভার নস্ট হয়ে মারা যাবার অন্যতম কারন। বহির্বিশ্বে স্বীকৃত এই রোগে ব্যবহার্য ওষুধের মূল্য প্রায় ১ লক্ষ ডলার, বাংলাদেশে সেই একই ওষুধ এর মূল্য কত জানেন? মাত্র ১ হাজার ডলার! তৈরি করছে ইনসেপ্টা এবং বিকন। মূল একটিভ মলিকিউল তৈরি করা কোম্পানি বাংলাদেশ ও ভারতে এই ওষুধ তৈরির অনুমতি দিয়েছে। বাংলাদেশ ২০৩৩ সাল পর্যন্ত পেটেন্ট রেস্ট্রিকশন পাওয়ায় এখানে এই ওষুধের দাম ভারতের চেয়ে কম। তাই বহির্বিশ্বের প্রচুর রোগী এই ওষুধ নিতে সরাসরি বাংলাদেশে আসছেন কিংবা অনলাইনে অর্ডার করে নিচ্ছেন। কিছুদিন পুর্বে বিবিসি ওয়েবসাইটে এমনই একজন ব্রিটিশ নাগরিকের সাক্ষাতকার প্রকাশ করা হয়েছিলো যিনি বাংলাদেশ থেকে অনলাইনে অর্ডার করে ওষুধ নিয়েছেন এবং খেয়ে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়েছেন।
বাংলাদেশ অমীত সম্ভাবনার দেশ। স্বাস্থ্যসেবায় আমাদের অর্জন অনেক। এই অর্জনের গল্পগুলো আর চাপা পড়ে না থাকুক। মূল ধারায় মিডিয়ায় সেভাবে প্রকাশিত না হলেও বিকল্প মিডিয়ায় ছডিয়ে পড়ুক আমাদের সাফল্যের গল্প গুলো। স্বাস্থ্য সেবায় এই উপমহাদেশে বাংলাদেশ হউক সর্বশ্রেষ্ঠ। সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের কাছে দাবী জানাচ্ছি বাংলাদেশের এই সাফল্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় প্রচার করা হোক সারা বিশ্বে। এই সাফল্যের সিড়ি ধরে বাংলাদেশে হেলথ ট্যুরিজম কে প্রতিষ্ঠিত করা হোক যা হতে পারে দেশের রেভিনিউ অর্জনের আরেকটি বড় খাত, কেননা সারা পৃথিবীতে সবচেয়ে কম খরচে স্বীকৃত আধুনিক অনেক চিকিৎসাই এই বাংলাদেশ দিচ্ছে।
-ডাঃ মারুফুর রহমান অপু
চিকিৎসা কর্মকর্তা, সেন্টার ফর মেডিকেল বায়োটেকনোলজি
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন