রংপুরে নির্ভার ৩ প্রার্থী , বাকিদের হবে কঠিন লড়াই

প্রতীক বরাদ্দের মধ্য দিয়ে গত সোমবার (১৮ ডিসেম্বর) থেকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরু হয়েছে। মাইকিং, পাড়া-মহল্লায় গণসংযোগ, পোস্টার সাঁটানো নিয়ে ব্যস্ত দলীয় ও স্বতন্ত্র প্রার্থী এবং তাদের কর্মী-সমর্থকরা। ভোটারদের কাছে ছুটছেন নতুন নতুন প্রতিশ্রুতি নিয়ে।

রংপুর জেলার ৬টি সংসদীয় আসনের মধ্যে রংপুর-১, রংপুর-২ এবং রংপুর-৫ আসনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস মিললেও বাকি তিনটিতে শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় নেই ভোটের উত্তাপ। রংপুর-৩, রংপুর-৪ এবং রংপুর-৬ আসনে একপেশে নির্বাচন হবে বলে মনে করছেন সাধারণ ভোটাররা।

এদিকে প্রচারণার তৃতীয় দিন বুধবারও দেখা মেলেনি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও রংপুর-৩ আসনের প্রার্থী জিএম কাদেরের। এদিন সকাল থেকেই স্বতন্ত্র প্রার্থী তৃতীয় লিঙ্গের আনোয়ারা ইসলাম রানীকে মাঠ চষে বেড়াতে দেখা যায়। জাতীয় পার্টির সাথে আওয়ামী লীগের আসন সমঝোতায় তুষার কান্তি মন্ডল প্রার্থিতা প্রত্যাহার করায় লাঙ্গলের জিএম কাদের এখন অনেকটাই চিন্তামুক্ত। নিশ্চিন্তে আছেন রংপুর-৬ (পীরগঞ্জ) আসনের প্রার্থী জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এবং রংপুর-৪ (পীরগাছা-কাউনিয়া) আসনের আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি।

রংপুর-১ আসনটি জাতীয় পার্টির জন্য আওয়ামী লীগ ছেড়ে দেওয়ায় প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন নৌকার প্রার্থী অ্যাডভোকেট রেজাউল করিম রাজু। তবে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন দলটির আরেক নেতা ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান বাবলু (কেটলি প্রতীক)। অন্যদিকে জাতীয় পার্টির প্রার্থী ও সাবেক সংসদ সদস্য হোসেন মকবুল শাহরিয়ার আসিফের সঙ্গে ভোটযুদ্ধে নেমেছেন পার্টির বহিষ্কৃত সাবেক মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গাঁ (ট্রাক)। এর ফলে আসনটিতে ত্রিমুখী লড়াইয়ে সম্ভাবনা দেখছেন সাধারণ ভোটাররা।

রংপুর-১ আসনে ভোটার ৩ লাখ ৩২ হাজার ৪৬ জন। এই আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য ও সাবেক এলজিআরডি প্রতিমন্ত্রী মসিউর রহমান রাঙ্গাঁ ২০০১ সালে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন। সর্বশেষ ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনি নির্বাচিত হন। এ আসন থেকে ২০০৮ সালে এরশাদের ভাতিজা হোসেন মকবুল শাহরিয়ার আসিফ জাতীয় পার্টি থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এখানে আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত স্বতন্ত্র প্রার্থী আসাদুজ্জামান বাবলুসহ ৯ জন প্রার্থী নির্বাচনে লড়বেন।

রংপুর-২ এই আসনেও ত্রিমুখী লড়াইয়ের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবুল কালাম মো. আহসানুল হক চৌধুরী ডিউকের (নৌকা প্রতীক) সঙ্গে জাতীয় পার্টির প্রার্থী আনিছুল ইসলাম মন্ডল (লাঙ্গল প্রতীক) ও আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত স্বতন্ত্র প্রার্থী বিশ্বনাথ সরকার বিটুর (ট্রাক প্রতীক) মধ্যে লড়াই দেখার অপেক্ষায় ভোটাররা।
৩ লাখ ৫৬ হাজার ৫৯২ জন ভোটারের এই আসনটিতে এবার প্রতিদ্বন্দ্বী তিনজন। আবুল কালাম মো. আহসানুল হক চৌধুরী ডিউক ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হন। সর্বশেষ ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনি আওয়ামী লীগ থেকে দ্বিতীয়বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এ আসন থেকে জাতীয় পার্টির আনিছুল ইসলাম মণ্ডল ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন। প্রবাসফেরত এই ব্যবসায়ী প্রথমবার নির্বাচিত হলেও ২০১৮ সালের নির্বাচনে পরাজিত হন। সেইবার তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন।

রংপুর-৩ এই আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হয়েছেন দলটির চেয়ারম্যান জিএম কাদের। ফলে সমঝোতার কারণে স্বাভাবিকভাবেই দলীয় প্রার্থী তুষার কান্তি মন্ডলকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে আওয়ামী লীগ। এখানে আওয়ামী লীগের কোনো স্বতন্ত্র প্রার্থীও নেই। ফলে জিএম কাদেরের জয় অনেকটা নিশ্চিত বলেই মানেন তার দলের কর্মী-সমর্থকরা। ফুরফুরে মেজাজে থাকা জিএম কাদেরের সঙ্গে এই আসনটিতে ভোটযুদ্ধে লড়বেন আরও পাঁচজন।
রংপুর-৩ আসনে ভোটার ৫ লাখ ১৯ হাজার ৯৭০ জন। এই আসনটির বর্তমান সংসদ সদস্য এরশাদপুত্র রাহগীর আল-মাহি সাদ। এবার তিনি ভোটযুদ্ধে মাঠে নেই। সাদের আসনে তার চাচা জিএম কাদের লড়ছেন লাঙ্গল প্রতীকে। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সংসদের বিরোধীদলীয় উপনেতা জি এম কাদের পেশায় একজন রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবী। তিনি পাঁচবার সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে একবার পরাজিত হন।

রংপুর-৪ আওয়ামী লীগের প্রার্থী টিপু মুনশির (নৌকা প্রতীক) মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হতে যাচ্ছেন জাতীয় পার্টির মোস্তফা সেলিম বেঙ্গল। গত নির্বাচনে তিনি জাতীয় পার্টির প্রার্থী হয়ে মাত্র ৭ হাজার ভোট পেয়ে তৃতীয় হয়েছিলেন। তবে গত নির্বাচনে টিপু মুনশির মূল প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি এবার নির্বাচনে না আসায় তার নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া সহজ হবে বলে মনে করা হচ্ছে। ৪ লাখ ৭৭ হাজার ৬৪৩ জন ভোটারের এই আসনটিতে এবার প্রার্থী তিনজন ।

রংপুর-৪ আসনে চতুর্থবারের মতো প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন টিপু মুনশি। তিনি ২০০৮ সালের নবম, ২০১৪ সালের দশম ও ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে রংপুর-৪ (পীরগাছা ও কাউনিয়া) আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তবে ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি একই আসন থেকে পরাজিত হয়েছিলেন।

রংপুর-৫ এ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ এইচ এন আশিকুর রহমানের ছেলে রাশেক রহমানের (নৌকা) সঙ্গে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত স্বতন্ত্র প্রার্থী ও সদ্য সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জাকির হোসেন সরকারের (ট্রাক)। আসনটি থেকে প্রার্থী হয়েছেন জাতীয় পার্টির আনিছুর রহমান। গত নির্বাচনে এখানে তৃতীয় অবস্থানে ছিল লাঙ্গল প্রতীক। এবার বিএনপি-জামায়াত নির্বাচনে না থাকায় এখানে পকেট ভোটে চমক থাকবে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।

রংপুর-৫ আসনে ভোটযুদ্ধে লড়বেন আটজন প্রার্থী। ভোটার রয়েছে ৪ লাখ ৩৯ হাজার ৩৪৭ জন। পাঁচবারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য এবং সাবেক প্রতিমন্ত্রী আশিকুর রহমানের ছেলে রাশেক রহমান আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় প্রচার ও প্রকাশনা উপ-কমিটির সদস্য। তিনি এবারই প্রথম দলীয় প্রতীকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। তার সঙ্গে জাকির হোসেন সরকারের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, অর্জন ও জনসম্পৃক্ততার লড়াই হবে ব্যালেটে।

রংপুর-৬ এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জাতীয় সংসদের স্পিকার বর্তমান সংসদ সদস্য ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। তার সঙ্গে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় পার্টির প্রার্থী নুর আলম মিয়া যাদু। তবে পীরগঞ্জে আওয়ামী লীগের আধিপত্যের কারণে ড. শিরিন শারমিন নির্বাচনী দৌড়ে এগিয়ে আছেন বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। এখানে আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত স্বতন্ত্র প্রার্থী সিরাজুল ইসলাম লড়ছেন ট্রাক প্রতীকে।

শিরীন শারমিন চৌধুরী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শ্বশুরবাড়ি পীরগঞ্জ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এর আগে তিনি নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংরক্ষিত নারী আসনে সংসদ সদস্য ছিলেন। ২০১৪ সালে তিনি রংপুর-৬ আসনের উপ-নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন।

এদিকে জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোবাশ্বের হাসান জানান, রংপুর জেলার ছয়টি আসনে দলীয় ও স্বতন্ত্র মিলে ৩৬ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এর মধ্যে রংপুর-১ আসনে নয়জন, রংপুর-২ আসনে তিনজন, রংপুর-৩ আসনে ছয়জন, রংপুর-৪ আসনে তিনজন, রংপুর-৫ আসনে আটজন এবং রংপুর-৬ আসনে সাতজন প্রার্থী। তফসিল অনুযায়ী নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা ৫ জানুয়ারি সকাল ৮টা পর্যন্ত চলবে। ভোটগ্রহণ আগামী বছরের ৭ জানুয়ারি (রোববার) অনুষ্ঠিত হবে।