‘লকডাউন হতে হবে লকডাউনের মতো’

তিন সংখ্যায় ছাড়িয়েছে করোনা আক্রান্তে মৃত্যু। হাজার হাজার মানুষ শনাক্ত হচ্ছেন। পরিসংখ্যন বলছে- শনাক্তের হার মাত্রাতিরিক্ত বাড়ছে। নমুনা পরীক্ষায় চরম অনিহা দেখাচ্ছেন করোনা সন্দেহভাজন সাধারণ মানুষ। গত বছরের তুলনায় চলতি বছরের করোনা পরীক্ষায় নমুনা দেয়া ব্যপক হারে হ্রাস পেয়েছে। দেশের প্রান্তিক পর্যায়ের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে গেলো বছর প্রায় প্রতিদিনই গড় অর্ধশতাধিক মানুষ নমুনা দিয়ে করোনা পরীক্ষা করাতেন। সেখানে চলতি সময়ে নমুনা দেয়ার সংখ্যা কমেছে। জেলা পর্যায়েই এখন প্রতিদিন গড় একশো’র কম-বেশি মানুষ নমুনা পরীক্ষা করাচ্ছেন। এতোসবের মাঝেও নমুনার বিপরীতে শনাক্তের মাত্রা উদ্বেগজনক হয়ে পড়েছে।

করোনার ভয়াবহতা রোধে সরকার নানান পদক্ষেপ নিলেও কার্যত তেমন সুফল মিলছে না। বিধি-নিষেধ, লকডাউন, কঠোর লকডউন ইত্যাদি আরোপ করা হলেও মানতে চাইছেন না সাধারণ মানুষ। আবার অনেক ক্ষেত্রে কাগজে-কলমে এরূপ নানান বিধি আরোপ করা হলেও বাস্তবে প্রতিফলন দেখা দায় হয়েছে।

সবমিলিয়ে করোনা প্রতিরোধে আর দেশের মানুষকে সুরক্ষিত রাখতে সোমবার থেকে ফের ‘কঠোর লকডাউন’ ঘোষনা করেছে সরকার। শুধু ঘোষনা নয়, নাম যাই হোক, লকডাউন হতে হবে লকডাউনের মতোই। এমনটাই মনে করছেন বিশেষজ্ঞ মহল।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘লকডাউন বা কঠোর লকডাউন অথবা শাটডাউনের মধ্যে আসলে কোন পার্থক্য নেই। কারণ কেউই তা মানছে না। ঢাকার আশপাশের সাত জেলায় লকডাউন দেওয়া হলেও মানুষের চলাচল বন্ধ হয়নি। সামনে ঈদে লাখ লাখ মানুষের যাতায়াত হবে। তখন করোনা পরিস্থিতি আরো জটিল হবে। মহামারী নিয়ন্ত্রণ করতে হলে মানুষকে স্বাস্থবিধি মানতে বাধ্য করতে হবে। আর সব মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি, সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তাসহ সবার সম্পৃক্ত করে লকডাউন ঘোষণা করতে হবে।

করোনা নিয়ন্ত্রণে লকডাউন শক্তভাবে বাস্তবায়নের পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা।

বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা বলেন, ‘স্বাস্থ্যবিধি না মানার প্রবণতা অব্যাহত থাকলে এবং উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ জেলা-উপজেলায় চিকিত্সা সেবার সক্ষমতা বৃদ্ধি করা না হলে সামনে মৃত্যু আরো বাড়বে। সংক্রমণের উপর মৃত্যুর সংখ্যা নির্ভর করে। জেলা-উপজেলায় চিকিত্সা সেবা না পেয়ে রোগীরা সব রাজধানীতে আসছে। আসা-যাওয়ার পথে অনেক মানুষকে তারা সংক্রমিত করছে। এ কারণে ঢাকাকে রক্ষা করা কঠিন হবে।’

আইইডিসিআরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. মাহমুদুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সামনে করোনায় মৃত্যু ও শনাক্ত দুটিই বাড়বে। অতীতের ভুল থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত। লকডাউন কেউ মানে না। সব জায়গায় স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষিত। কোন কোন অফিস অর্ধেক খোলা। সাত জেলায় লকডাউন দেওয়া হলেও ওই সব জেলাগুলোতে আগের মতো অবস্থা বিরাজ করছে। মানুষের মুভমেন্ট বন্ধ হয়নি। লকডাউন হতে হবে লকডাউনের মতো। জরুরি সার্ভিস ও রোগীর যাতায়াত ছাড়া সব কিছু বন্ধ রাখতে হবে। মন্ত্রী, এমপিসহ সর্বস্তরের জনপ্রতিনিধি, সিটি কর্পোরেশনসহ সবাইকে সম্পৃক্ত করে লকডাউন ঘোষণা করতে হবে, যাতে তা বাস্তবায়ন করা যায়।’

করোনা মোকাবেলায় গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. বেনজীর আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সামনে ঈদে কয়েক কোটি মানুষের যাতায়াত হবে, এ কারণে করোনা সংক্রমণ আরো বাড়বে। আর আক্রান্তের সংখ্যার উপর মৃত্যুর হার নির্ভর করে। করোনা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সীমান্তবর্তী জেলা-উপজেলাসহ উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা এলাকাগুলোতে জরুরি ভিত্তিতে চিকিত্সা সেবার সক্ষমতা বাড়াতে হবে। কারণ জেলা-উপজেলায় চিকিত্সা সেবা না পেয়ে মানুষ ঢাকায় আসছে।’

কোভিড হাসপাতাল ম্যানেজমেন্ট কমিটি ও কোভিড-১৯ গাইডলাইন কমিটির সভাপতি এবং ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. একে আজাদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘স্বাস্থ্যবিধি মানাতে বাধ্য করার পাশাপাশি ৪০টি উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ জেলাতে জরুরি ভিত্তিতে চিকিত্সা সেবার সক্ষমতা বাড়াতে হবে। যে যেখানে করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে, তাকে সেখানে চিকিত্সা সেবা দিতে পারলে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। কারণ চিকিত্সা নিতে ঢাকায় আসা-যাওয়া করতে গিয়ে রোগীরা অন্যদের সংক্রমিত করছে।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিত্সক অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘করোনায় মৃত্যু তিন সংখ্যায় দাঁড়িয়েছে। এটা আমাদের জন্য বড় সতর্কবার্তা। করোনা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে বাধ্য করতে হবে। সবার মাস্ক পরতে হবে। বিশ্বের ১৩০টি দেশ টিকা পায়নি। তারা স্বাস্থ্যবিধি মেনে করোনা নিয়ন্ত্রণ করছে। তাহলে আমরা কেন পারবো না?’
‘জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে না পারলে সামনে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হবে’ বলে তিনি আশংকা প্রকাশ করেন।

উল্লেখ্য, করোনার উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের ৪০টি জেলা। এরমধ্যে উত্তরাঞ্চল, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলসহ সীমান্তবর্তী জেলাও রয়েছে। এসব জেলা ও এর আওতাধীন উপজেলা হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেন ও বেডের সংকট প্রকট। হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও জেলা-উপজেলায় চিকিত্সা সেবার সক্ষমতা কেন বাড়েনি এমন প্রশ্ন রাখেন বিশেষজ্ঞরা।

গত ১৯ এপ্রিল করোনায় ১১২ জনের মৃত্যুর সংবাদটি ছিলো দেশের সর্বোচ্চ। এরপর ২৫ জুন সারাদেশে ১০৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। একদিনের পরিসংখ্যানে এটা দেশে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যু। দেশে শুক্রবার পর্যন্ত ১৩ হাজার ৯৭৬ জনের মৃত্যু হলো করোনা ভাইরাসে। আর আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল আট লাখ ৭৮ হাজার ৮০৪ জনে।