লাইসেন্স ছাড়া হরিণ-হাতি পালনে জেল-জরিমানা
লাইসেন্স ছাড়া হরিণ ও হাতি পালনে জেল-জরিমানার বিধান রেখে ‘হরিণ ও হাতি লালন-পালন বিধিমালা-২০১৭’ চূড়ান্ত করেছে সরকার। আগের নীতিমালায় লাইসেন্স নেয়ার কথা ছিল না। শুধু নামমাত্র অর্থের বিনিময়ে অনুমোদন নিতে হতো। অনুমোদন না নিলেও ছিল না কোনো শাস্তির বিধান ছিল না।
সম্প্রতি পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় থেকে ‘হরিণ ও হাতি লালন-পালন বিধিমালা-২০১৭’ জারি করা হয়েছে। বাণিজ্যিকভাবে হরিণ উৎপাদন চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে এই নীতিমালাটি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
তবে বিধিমালা অনুযায়ী বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য ছাড়া সর্বোচ্চ ১০টি হরিণ লালন-পালনকারী ব্যক্তি ‘শৌখিন লালন-পালনকারী’ হিসেবে অবিহিত হবেন। এজন্য তাকে লাইসেন্স নিতে না হলেও ‘পজেশন সার্টিফিকেট (মলিকানা সনদ)’ নিতে হবে।
বিধিমালায় বলা হয়েছে, কোনো স্থানে ১০টির বেশি হরিণ বা একটি হাতি লালন-পালন করা হলে তা খামার হিসেবে গণ্য হবে। হরিণ বলতে শুধু চিত্রল হরিণ বুঝাবে। হরিণ ও হাতি পালনে আগের আবেদন ফি বাতিল করা হলেও এখন লাইসেন্স ফি দিতে হবে। একই সঙ্গে পজেশন ফিসহ অন্যান্য ফি-ও বাড়ানো হয়েছে। কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে হরিণ ও হাতি বিক্রি, দান ও বিনিময় করা যাবে বলে বিধিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।
বিধিমালা অনুযায়ী, লাইসেন্স ছাড়া বা লাইসেন্স নবায়ন ছাড়া খামারে হরিণ ও হাতি লালন-পালন করলে সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে। একই অপরাধ আবার করলে সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
এর আগে ‘বাংলাদেশ চিত্রল হরিণ লালন-পালন নীতিমালা-২০০৯’ এবং ‘হাতি লালন-পালন নীতিমালা-২০১১’ বহাল ছিল। নতুন বিধিমালা জারি হওয়ায় এই দুই নীতিমালা বাতিল হয়ে গেছে। এই দুই নীতিমালার ওপর ভিত্তি করে আরও কিছু সংযোজন-বিয়োজন করে নতুন বিধিমালাটি করা হয়েছে বলে বন বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন। বিধিমালাটি বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকবে বন বিভাগ।
নতুন বিধিমালায় হরিণ ও হাতি পালনে খামারির লাইসেন্স ফি সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ধরা হয়েছে ২০ হাজার টাকা, সিটি কর্পোরেশনের বাইরে ১০ হাজার টাকা। প্রতিটি হরিণের জন্য পজেশন ফি ১০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে এক হাজার টাকা করা হয়েছে। শৌখিন লালন-পালনকারীদের মতো খামারিদের প্রতিবছর পজিশন ফি দিতে হবে। আগে ব্যক্তিগতভাবে বা বাসাবাড়িতে চিত্রল হরিণ পোষার অনুমোদন ফি ছিল ৫০০ টাকা। স্থানভেদে খামারের জন্য অনুমোদন ফি ছিল দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকা। বিধিমালা অনুযায়ী এই ফি এখন নেই।
বিধিমালার বিষয়ে বন অধিদফতরের বন সংরক্ষক (বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ) জাহিদুল কবির বলেন, ‘বাণিজ্যিকভাবে হরিণ চাষের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। হরিণ ছাগলের চেয়েও সহজে পালন করা যায়। সেজন্য খামার পর্যায়ে সবাই হরিণ পালন করতে চায়। এটা সঠিকভাবে করতে পারলে বনের হরিণের ওপর চাপ কমে যাবে। খামারে হরিণ পেলে মানুষ আর ঝুঁকি নিয়ে বনে গিয়ে অবৈধভাবে হরিণ শিকার করবে না।’
তিনি বলেন, ‘আগে হরিণ ও হাতির খামারের জন্য সেভাবে লাইসেন্সের বিষয় ছিল না, তবে অনুমোদন নেয়ার বিষয় ছিল। লাইসেন্স না নেয়াসহ বিধিমালা না মানলে শাস্তিরও ব্যবস্থা রয়েছে, এটা আগে ছিল না। ফিও আগের চেয়ে বাড়ানো হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের ফর্ম, আবেদন প্রক্রিয়াও সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে।’
নতুন বিধিমালার কারণে হরিণ ও হাতি পালনের বিষয়টি কাঠামোর মধ্যে আসবে জানিয়ে জাহিদুল কবির বলেন, ‘আগামীতে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে বন বিভাগের কার্যক্রমকে আরো শক্তিশালী করা হবে। এখন একজন বন সংরক্ষক (বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ) আছেন, তখন সারাদেশে মোট তিনজন, বন্যপ্রাণীর জন্য এখন সাতটি ডিভিশন থেকে ১৪টি ডিভিশনে উন্নীত হবে। সারাদেশে যাতে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের কাজটা ভালোভাবে মনিটরিং করা যায়। ক্রাইম কন্ট্রোল ইউনিটটাকেও শক্তিশালী করা হবে, সেন্ট্রাল অফিস ছাড়াও ১৬টি অফিস থাকবে। এই প্রস্তাবটি আমরা শিগগিরই মন্ত্রণালয়ে পাঠাবো।’
নিতে হবে লাইসেন্স
কোনো ব্যক্তি আগের নীতিমালা অনুযায়ী অনুমোদন নিয়ে থাকলে তাকে এই বিধিমালা কার্যকর হওয়ার এক বছরের মধ্যে লাইসেন্স নিতে হবে। লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষ তদন্ত প্রতিবেদন এবং সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে এক বছরের জন্য লাইসেন্স ইস্যু করবে। একই সঙ্গে লাইসেন্সের অনুলিপি সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে পাঠাবে।
কর্তৃপক্ষ কোনো আবেদনকারীর আবেদন নামঞ্জুর করার সিদ্ধান্ত নেয়ার সাতদিনের মধ্যে কারণ উল্লেখ করে আবেদনকারীকে লিখিতভাবে জানাবে বলে বিধিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে। বিধিমালা অনুযায়ী, মেয়াদ শেষ হওয়ার কমপক্ষে ৩০ দিন আগে লাইসেন্স নবায়নের জন্য আবেদন করতে হবে। আবেদনপত্রের সঙ্গে পজেশন সার্টিফিকেটের অনুলিপি দিতে হবে। কর্তৃপক্ষ হরিণ বা হাতির সংখ্যা অনুযায়ী স্থান, শেড, জলাধার ও উপযুক্ত পরিবেশ রয়েছে কি না- তা ফের সরেজমিনে তদন্ত করে লাইসেন্স নবায়ন করবে।
নবায়নের ফি হবে লাইসেন্সের মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পর লাইসেন্স ফি-র শতকরা ২৫ ভাগ, লাইসেন্সের মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার ৬০ দিনের লাইসেন্স ফি-র শতকরা ৫০ ভাগ এবং লাইসেন্সের মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে লাইসেন্স ফি এর শতকরা ৮০ ভাগ।
পজেশন সার্টিফিকেট
কোনো শৌখিন লালন-পালনকারী এবং লাইসেন্স প্রাপ্তির পর কোনো খামারি পজেশন সার্টিফিকেট ছাড়া হরিণ বা হাতি নিজ মালিকানায় বা দখলে রাখতে পারবেন না। পজেশন সার্টিফিকেটের মেয়াদও হবে এক বছর। মেয়াদ শেষে এটি নবায়ন করতে হবে।
চারণ সার্টিফিকেট
কোনো খামারি চারণ সার্টিফিকেট ছাড়া সরকারি বনাঞ্চলের হাতি চারণ করতে পারবেন না। কর্তৃপক্ষ এক বছরের জন্য চারণ সার্টিফিকেট ইস্যু করবে। বিধিমালায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তির লাইসেন্স, পজেশন সার্টিফিকেট বা চারণ সার্টিফিকেট হারিয়ে গেলে, ক্ষতিগ্রস্ত বা ছিঁড়ে গেলে প্রতিলিপি ফি (এক হাজার টাকা) জমা দিয়ে সার্টিফিকেটের প্রতিলিপি নিতে পারবেন। তবে এজন্য আবেদনের সঙ্গে সনদ হারানো বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়ে সাধারণ ডায়েরির (জিডি) কপি যুক্ত করতে হবে।
হরিণ পালনের শর্ত
হরিণের খামারের জন্য নিজস্ব মালিকানা, ভাড়া বা সরকারের কাছ থেকে দীর্ঘমেয়াদি ইজারার মাধ্যমে পাওয়া ভূমির দখল থাকতে হবে বলে বিধিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে। শৌখিন লালন-পালনকারী এবং খামারি উভয় ক্ষেত্রে প্রত্যেক হরিণের বিশ্রামের জন্য শেডের সর্বনিম্ন পরিমাপ হবে ১০০ বর্গফুট এবং উচ্চতা ১০ ফুট। শেডের মধ্যে দানাদার খাবার, খনিজ লবণ ও সুপেয় পানি সরবরাহের জন্য ভিন্ন ভিন্ন পাত্রের ব্যবস্থা থাকতে হবে এবং পর্যাপ্ত সুপেয় পানি ও সুষম খাদ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
উল্লিখিত শেডের আয়তন ছাড়াও প্রত্যেক হরিণের বিচরণ ক্ষেত্রের পরিমাপ হবে কমপক্ষে ৫০০ বর্গফুট পরিমাণ উন্মুক্ত ভূমি। শেড এবং বিচরণ ক্ষেত্রের চারিদিকে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা বেষ্টনী (উচ্চতা কমপক্ষে ১০ ফুট) থাকতে হবে। হরিণ লালন-পালনের স্থান বা খামার হরিণ পাওয়া যায় এমন প্রাকৃতিক বনের সীমানা থেকে কমপক্ষে ৩০ কিলোমিটার দূরত্বে স্থাপন করতে হবে। আগে এই দূরত্ব ছিল ১০ কিলোমিটার। আগে স্থাপন করা কোনো হরিণের খামার যদি ৩০ কিলোমিটারের মধ্যে হয় তবে বিধিমালা জারির ১২০ দিনের মধ্যে তা অন্যত্র স্থানান্তর করতে হবে।
হাতি পালনের শর্ত
হাতি পালনে নিজস্ব মালিকানা, ভাড়া বা সরকারের কাছ থেকে দীর্ঘমেয়াদি ইজারার মাধ্যমে পাওয়া ভূমির দখল থাকতে হবে। চারণ সার্টিফিকেট ছাড়া সরকারি বনাঞ্চলে হাতি চারণ করা যাবে না। প্রত্যেক হাতির কান লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কেনা ট্যাগের মাধ্যমে স্থানীয় বন কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে চিহ্নিত করতে হবে। বাচ্চা প্রসবের ৯০ দিনের মধ্যে বাচ্চা হাতির কান ট্যাগের মাধ্যমে চিহ্নিত করতে হবে।
হরিণ ও হাতি বিক্রি
সংখ্যাধিক্য, লাইসেন্স বাতিল, লাইসেন্স নবায়নে ব্যর্থতা, পজেশন সার্টিফিকেট বাতিল বা অন্য যেকোনো কারণে কোনো খামারি, শৌখিন লালন-পালনকারী বা অন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের লিখিত অনুমতি ছাড়া কোনো হরিণ বা হাতি বিক্রি, দান, বিনিময় বা অন্য কোনোভাবে হস্তান্তর করতে পারবেন না। এক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের লিখিত অনুমতি লাগবে।
হরিণ ও হাতি জব্দ-বাজেয়াপ্তকরণ
কোনো হাতির বাচ্চা প্রসবের ৯০ দিনের মধ্যে এর কানে ট্যাগের মাধ্যমে চিহ্নিত করা না হলে, হরিণ পাওয়া যায় এমন বন থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে খামার স্থানান্তর করা না হলে, সৌখিন পালনকারীর ১০টির বেশি হরিণ বিক্রি বা হস্তান্তর করা না হলে এই হরিণ বা হাতি সরকার বাজেয়াপ্ত করতে পারবে।
পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তা বা লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষ যেকোনো সময়, কোনো ধরনের অগ্রিম নোটিশ ছাড়া শৌখিন লালন-পালনকারী ও খামারির হরিণ বা হাতি লালন-পালনের স্থান বা খামার পরিদর্শন করতে পারবেন।
পরিদর্শনের সময় কর্মকর্তা রেজিস্ট্রার দেখতে এবং শৌখিন লালন-পালনকারী বা খামারিকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে বা কোনো তথ্য চাইতে পারবেন। কোনো অনিয়ম পেলে খামারির লাইসেন্স ও শৌখিন পালনকারীর পজিশন সনদ বাতিলের আবেদন করতে পারবেন।
কোনো খামারি আইন বা বিধি বা লাইসেন্সের কোনো শর্ত লঙ্ঘন করলে কর্তৃপক্ষ তাকে যুক্তিসঙ্গত কারণ দর্শানোর সুযোগ দিয়ে লাইসেন্স স্থগিত বা বাতিল করতে পারবে।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন