লালমনিরহাটে মরা তিস্তায় তরমুজ চাষ, কৃষকদের মুখে হাসি

মরা তিস্তার বালুচর, বুকে সবুজের সমারোহ। যতদূর চোখ যায়, লতানো গাছের ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে গোলগাল তরমুজ। লালমনিরহাটের তিস্তা নদীর বুকে জেগে ওঠা চরের দৃশ্যপট এখন এমনই। এক সময়ের অভাব আর অনিশ্চয়তার ধূসর জমিনে এখন হাসছে আগাম তরমুজের সবুজ হাসি। আর এই হাসির হাত ধরেই ঘুরে দাঁড়াচ্ছে প্রতিকূলতার সাথে লড়াই করে টিকে থাকা এখানকার ভূমিহীন কৃষকেরা।
অনিশ্চয়তার দিন বদলের ডাক ‘জামির বাড়ী চর’ নামেই পরিচয়। তিস্তার ভাঙা-গড়ার খেলার মাঝে জেগে ওঠা এক ভূখণ্ড। এখানকার মানুষের জীবন বাঁধা ছিল নদীর খামখেয়ালিপনা আর চরের সামান্য কৃষির উপর। বর্ষায় বন্যার ভয়, আর শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাবে তিস্তা যখন মরা খাল, তখন জীবিকার প্রধান অবলম্বন মৎস্য শিকারও বন্ধ। ধান বা অন্য প্রচলিত ফসলে তেমন লাভ হতো না এখানকার বেলে-দোঁয়াশ মাটিতে। জীবন চলত খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে।
এই চক্র ভাঙার স্বপ্ন দেখেন কৃষক এজার আলী। তিনি ভাবছিলেন, শুষ্ক মৌসুমে যখন বন্যার ভয় নেই, তখন এমন কী ফসল ফলানো যায় যা এই মাটিতেই সোনালি আভা ছড়াবে? ভাবনা থেকেই খোঁজখবর শুরু। কাছের ভোটমারী এলাকা তরমুজ চাষের জন্য পরিচিত। সেখানকার আত্মীয়দের পরামর্শ আর নিজের দূরদর্শিতা মিলিয়ে ঝুঁকিটা নিয়েই ফেললেন তিনি।
‘গত বছর শীতের শেষের দিকে কালীগঞ্জ কৃষি অফিসের সাহায্য নিয়ে আগাম তরমুজের বীজ লাগাই’ স্মৃতিচারণ করেন এজার আলী, যার হাত ধরেই চরে এই মিষ্টি বিপ্লবের শুরু। ‘কয়েকজন মিলে এক একর জমিতে শুরু করি। সব মিলিয়ে খরচ হয়েছিল হাজার পনেরো টাকা। কিন্তু যখন তরমুজ বিক্রি করলাম, হাতে এলো ষাট হাজার টাকা! নিজের চোখকেই বিশ্বাস হচ্ছিল না।’
এজার আলীদের এই অভাবনীয় সাফল্য যেন আশার আলো ছড়িয়ে দিল পুরো চরে। যা দেখে গতানুগতিক চাষের নিরাশায় ভোগা অন্য কৃষকেরাও যেন নতুন পথের দিশা পেলেন। পরের বছর, অর্থাৎ এই মৌসুমে, জামির বাড়ী চরের আরও অনেক কৃষকই নেমে পড়লেন আগাম তরমুজ চাষে। এবার আবাদের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২ একরে।
রাকিব মিয়ার মুখেও এখন তৃপ্তির হাসি। ‘এজার ভাইদের লাভ দেখে আমরাও সাহস করে এবার এক একর জমিতে তরমুজ লাগিয়েছি। খরচ সেই ১৫ হাজার টাকার মতোই। আল্লাহর রহমতে ফলন খুব ভালো হয়েছে। এর মধ্যেই প্রায় ৫০ হাজার টাকার তরমুজ বিক্রি করেছি। ক্ষেতে যা আছে, তাতে আশা করি আরো ৫০ হাজার টাকা আসবে।’
এই বাড়তি আয় শুধু রাকিব বা এজার আলীর নয়, জামির বাড়ী চরের অনেক কৃষক পরিবারের জন্যই আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। যে হাতে একসময় থাকত অভাবের দীর্ঘশ্বাস, সে হাতে এখন নগদ টাকা। ছেলেমেয়ের পড়ার খরচ, সংসারের প্রয়োজন মিটিয়ে ভবিষ্যতের জন্য দুটো পয়সা জমানোর স্বপ্ন দেখছেন তারা।
গরমের আঁচ বাড়ার আগেই বাজারে চলে আসায় জামির বাড়ীর এই আগাম তরমুজের কদরই আলাদা। কালীগঞ্জের হাট-বাজার থেকে শুরু করে ভ্রাম্যমাণ ভ্যানগাড়ি সর্বত্রই দেখা মিলছে এর। ক্রেতারাও কেজি প্রতি ৬০ টাকা বা তার বেশি দাম দিয়ে সানন্দে কিনে নিচ্ছেন এই রসালো ফল।
তরমুজ ব্যবসায়ী রবিউল ইসলাম জানান, ‘চাহিদা প্রচুর। এই চর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় তিন লাখ টাকার তরমুজ কিনেছি। আগাম হওয়ায় দামও ভালো পাওয়া যাচ্ছে, কৃষকরাও লাভবান হচ্ছেন, আমরাও দুটো পয়সা পাচ্ছি।’
চরের কৃষকদের এই সাফল্যে খুশি স্থানীয় কৃষি বিভাগও। কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ তুষার কান্তি রায় বলেন, ‘চরের বেলে-দোঁয়াশ মাটি তরমুজ, বিশেষ করে ‘পাকিজা’ জাতের আগাম তরমুজ চাষের জন্য খুবই উপযোগী। আমরা কৃষকদের বীজ দেওয়া থেকে শুরু করে কারিগরি পরামর্শ দিয়েছি। তাদের পরিশ্রমে এবার ফলন চমৎকার হয়েছে। এখানে তরমুজ চাষ সম্প্রসারণের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।’

এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন