শুধু ২ ব্যাংক থেকেই আত্মসাৎ করেছেন ৩৬ হাজার কোটি টাকা সালমান এফ রহমান


অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ৫৩ হাজার কোটি টাকা লুট করেছেন বেক্সিমকো গ্রুপের কর্ণধার সালমান এফ রহমান। এর মধ্যে জনতা ব্যাংক থেকেই নিয়েছেন ২৩ হাজার কোটি টাকা। আইএফআইসি ব্যাংক থেকে নেন ১৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। বাকি টাকা অন্যান্য ব্যাংক থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন।
এসব ঋণের প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা ইতোমধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে। বাকি টাকাও খেলাপি হওয়ার পথে। আর এ লুটের টাকার বড় অংশই ইতোমধ্যে বিদেশে পাচার করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বেক্সিমকো গ্রুপের ওপর বিশেষ পরিদর্শন পরিচালনা করে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। সম্প্রতি সংস্থাটি এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে পাঠিয়েছে। এতে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আর্থিক খাতের রাঘববোয়াল হিসাবে পরিচিত সালমান এফ রহমান আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে ছিলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। এখন তার বিরুদ্ধে যথাযথ কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার সময় এসেছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ড. মইনুল ইসলাম বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, পুরো টাকাই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। এসব টাকা আর ফেরত আসবে না।
জনতা ব্যাংক: রাষ্ট্রায়ত্ত এ ব্যাংকের লোকাল অফিস থেকে ২৫টি প্রতিষ্ঠানের নামে ২৩ হাজার ৫৫৭ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন সালমান এফ রহমান। এর মধ্যে ২২ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকা এখন খেলাপি। প্রতিবেদনে কয়েকটি লুটের ঘটনা উল্লেখ করা হয়। এর মধ্যে ভয়ংকর এক লুটের ঘটনা ছিল এমন-জনতা ব্যাংকের লোকাল অফিসের মাধ্যমে বেক্সিমকো গ্রুপের ৩৩ হাজার ৮৩১টি ব্যাক টু ব্যাক কাঁচামাল আমদানির এলসি খোলা হয়।
যার মূল্য প্রায় ৩.৬১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। গ্রাহকের অনুকূলে পুরো টাকাই পরিশোধ করেছে ব্যাংক। বিপুল অঙ্কের আমদানির বিপরীতে মাত্র ১.৫০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করা হয়। বাকি ২.১০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানির কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
এর ব্যাখ্যায় বলা হয়, এখানে অধিকাংশ লোকাল ব্যাক টু ব্যাক এলসির ক্ষেত্রে আমদানিকারক (আবেদনকারী) ও রপ্তানিকারক (বেনিফিশিয়ারি) একই গ্রুপ অর্থাৎ বেক্সিমকো গ্রুপের প্রতিষ্ঠান হওয়ায় এবং একই শাখার মাধ্যমে তা সম্পাদিত হওয়ায় আদৌ কোনো পণ্য আমদানি বা রপ্তানি হয়েছে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
অর্থাৎ একোমোডেশন বা পাতানো বিল হতে পারে। এ থেকে বোঝা যায়, ২.১০ বিলিয়ন ডলার সরাসরি লুট করেছে বেক্সিমকো গ্রুপ। ঘটনাটি ঘটে ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে। শুধু তাই নয়, জনতা ব্যাংকের একই শাখার মাধ্যমে আরও ৩৫.০৩ কোটি মার্কিন ডলার বা ৪ হাজার ১৯৯ কোটি টাকা সংযুক্ত আরব আমিরাতে পাচার হতে পারে বলে সন্দেহ করছে বিএফআইইউ-এর তদন্ত দল। এসব টাকা পাচারে ব্যবহার করা হয় ‘আরআর গ্লোবাল ট্রেডিং এফজেডই’ নামক একটি প্রতিষ্ঠানকে। প্রতিষ্ঠানটিকে কখনো আমদানিকারক আবার কখনো দেখা গেছে রপ্তানিকারকের ভূমিকায়।
আইএফআইসি ব্যাংক : এ ব্যাংক থেকে ১৩ হাজার ৪৬১ কোটি টাকার ঋণ নেন সালমান। এ ব্যাংকের চেয়ারম্যানও ছিলেন তিনি নিজেই। ২৮টি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এ টাকা হাতিয়ে নেন তিনি। এর মধ্যে ১৫টি প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধিত ঠিকানায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। অস্তিত্বহীন এসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে বিতরণ করা ঋণের অর্থ লেয়ারিংয়ের মাধ্যমে সালমান ও বেক্সিমকো গ্রুপের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন হিসাবে জমা হয়েছে।
এছাড়া এসব ঋণের অর্থ জাকিয়া তাজিন, মো. মনিরুল ইসলাম, সারওয়াত সুলতানা মোনামীসহ ২৪টি প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন হিসাবেও পাঠানো হয়। শুধু তাই নয়, আইএফআইসি ব্যাংকের মাধ্যমে প্রায় ৫৭৯ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। সার আমদানির আড়ালে ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে এই অর্থ পাচার হয়।
ন্যাশনাল ব্যাংক: বেসরকারি খাতের এ ব্যাংক থেকেও নামে-বেনামে টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন সালমান। ৯টি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ৩ হাজার ১৮২ কোটি টাকার ঋণ নেন তিনি। এর মধ্যে ১ হাজার ৫৯২ কোটি টাকাই এখন খেলাপি।
এবি ব্যাংক : এ ব্যাংকে সালমানের ছয় প্রতিষ্ঠানের ঋণ এখন ১ হাজার ৮৩৮ কোটি টাকা। তবে তিনি ব্যাংকে টাকা ফেরত না দিয়েও খেলাপিমুক্ত হয়েছেন।
সোনালী ব্যাংক: ব্যাংকটি থেকে চার প্রতিষ্ঠানের নামে ১ হাজার ৭৬৭ কোটি টাকার ঋণ বের করেন সালমান। ব্যাংকটির মূলধনের ৩৯ শতাংশ ঋণ পেয়েছেন তিনি। যদিও ঋণ পাওয়ার সুযোগ ছিল মাত্র ২৫ শতাংশ। পুরো টাকাই এখন খেলাপি।
এক্সিম ব্যাংক: ৫টি প্রতিষ্ঠানের নামে এ ব্যাংক থেকে ১ হাজার ৪৬৮ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন সালমান। এসব ঋণের ৩২৭ কোটি টাকা এখন খেলাপি।
অগ্রণী ব্যাংক: এ ব্যাংক থেকেও চার প্রতিষ্ঠানের নামে সালমান লুট করেছেন ১ হাজার ৯ কোটি টাকা।
রূপালী ব্যাংক: এ ব্যাংক থেকে ৯৪৪ কোটি টাকার ঋণ নেন সালমান। এর মধ্যে খেলাপি ৩০০ কোটি টাকা। বাকি টাকাও খেলাপি হওয়ার পথে। রূপালী ব্যাংক একক ঋণগ্রহীতার যে সীমা ছিল, তা অতিক্রম করে ঋণ বিতরণ করেছে। ব্যাংকটির মূলধনের প্রায় ৪২ শতাংশ ঋণ পেয়েছে বেক্সিমকো।
ডাচ্-বাংলা ব্যাংক: এ ব্যাংক দুটি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ১৭০ কোটি টাকার ঋণ দেয়। এর মধ্যে ৯৩ কোটি টাকাই খেলাপি।
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক: এ ব্যাংক থেকে ১৪৬ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়।
ঢাকা ব্যাংক: ব্যাংকটি থেকে ১৩৭ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছেন সালমান।
গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক: এ ব্যাংক থেকে ঋণ দেওয়া হয় ৮৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ৫২ কোটি টাকা। এছাড়া পদ্মা ব্যাংকের ২৪ কোটি, উত্তরা ব্যাংকের ৪ কোটি এবং ব্যাংক এশিয়ার ১ কোটি টাকা ঋণের পুরোটাই এখন খেলাপি।

এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন