সংসদে কওমী মাদরাসা সনদের স্বীকৃতি বিল পাস
‘আল হাইয়াতুল উলিয়া লিল জামিয়াতিল কাওমিয়া বাংলাদেশের অধীন কওমি মাদ্রাসাসমূহের দাওরায়ে হাদিস তাকমিলের সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রি (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবির সমমান প্রদান) বিল ২০১৮ সংসদে পাস হয়েছে।
বুধবার সংসদে পাসের জন্য তোলা হলে নানা প্রক্রিয়া শেষে বিলটি ভোটে দেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। পরে তা কণ্ঠভোটে পাস হয়। এর ফলে বর্তমান সংসদের শেষ অধিবেশনে কওমি ছাত্র শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ হলো।
এর আগে বিলের ওপর দেওয়া জনমত যাচাই, বাছাই কমিটিতে পাঠানো এবং সংশোধনী প্রস্তাবগুলো নাকচ করা হয়।
গত ১৩ আগস্ট মন্ত্রিসভার বৈঠকে এই আইনটি চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়। আর সেদিনই বর্তমান সংসদের শেষ অধিবেশনে বিলটি তোলার কথা জানানো হয়। এর আগে ২০১৭ সালের এপ্রিলেই এই স্বীকৃতি দেয়ার ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
গত ১০ সেপ্টেম্বরটি বিলটি সংসদে তোলার পর যাচাই বাছাই করে এক সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়।
জাতীয় পার্টির সাংসদ সেলিম উদ্দিন বিলটি নিয়ে জনমত যাচাইয়ের প্রস্তাব দিয়ে বলেন, ‘এটি ছোট বিল, কিন্তু গুরুত্ব অনেক বেশি। কওমি শিক্ষা ব্যবস্থাকে স্বীকৃতি দিলেও সরকারি কোনো নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। মনে হচ্ছে কোনো একটা চাপে এই বিল আনা হয়েছে। এটি বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে আলোচনা ও মতামতের প্রয়োজন আছে।’
বিলের উদ্দেশ্য ও কারণ সম্পর্কে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, ‘কওমি মাদ্রাসার বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে এবং কওমি মাদরাসার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট ও স্বকীয়তা বজায় রেখে ‘আল হাইআতুল উলয়া লিল জামি’আতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’ এর অধীন ‘কওমি মাদরাসমূহের দাওরায়ে হাদিস (তাকমীল) এর সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রি (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি) এর সমমান প্রদান বিল আনা হয়েছে।’
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, বর্তমানে ১৫ লাখের কাছাকাছি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করেন। বছরে তিন থেকে চার লক্ষ শিক্ষার্থী পাস করে আসেন। তাদের স্বীকৃতি দেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।’
জাতীয় পার্টির শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, ‘আইনে সরকার বা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণের কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। হয়ত এর কারণ দেওবন্দের কারিকুলাম অক্ষুণ্ন রাখার স্বার্থে এটি করা হয়েছে। সাধারণ শিক্ষায় মাস্টার্সের কারিকুলামের একটি কমা পরিবর্তন করতেও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অনুমোদন লাগে। হয়ত বাস্তবতার কারণেই ‘ব্ল্যাঙ্ক চেক’ দেওয়া হয়েছে।’
সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশিদ বলেন, এটি একটি ঐতিহাসিক বিল। আমরা সম্পূর্ণভাবে একমত।…আমি যাচাই বাছাইয়ের পক্ষে নই, আমি চাই বিলটি অবিলম্বে পাস করা হোক।’
কওমি সনদের স্বীকৃতির বিষয়টি এই মাদ্রাসার ছাত্র শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের দাবি। আর এই দাবি পূরণের আশ্বাস দেয়ার পর ১৯৯৯ সাল বিএনপি-জামায়াত ও জাতীয় পার্টির সঙ্গে জোট করে কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রীক রাজনৈতিক দল ইসলামী ঐক্যজোট।
জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে ধর্মভিত্তিক এই দলগুলোর আক্বিদাগত ব্যাপক পার্থক্য থাকলেও কেবল এই ইস্যুতে তারা ‘শত্রুর’ সঙ্গে হাত মেলাতে রাজি হয়। তবে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে এই স্বীকৃতির বাস্তবায়ন হয়নি।
তবে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর এ বিষয়ে উদ্যোগ নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে সময় কওমি আলেমদের গুরু আহমেদ শাহ শফিকে প্রধান করে একটি কমিটিও গঠন করা হয়। তবে সে সময় নিজেদের মধ্যে বিরোধের পাশাপাশি বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধ শক্তির বিরোধিতায় সেটা আর আগায়নি।
তবে ২০১৭ সালের ১১ এপ্রিল কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ সনদকে ইসলামিক স্টাডিজে স্নাতকোত্তর ডিগ্রির স্বীকৃতির ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেদিন গণভবনে উপস্থিত ছিলেন আহমেদ শাহ শফিও যিনি হেফাজতে ইসলাম নামে একটি সংগঠনের আমির।
এর দুই দিন পর কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ সনদকে সাধারণ শিক্ষার স্নাতকোত্তর ডিগ্রির স্বীকৃতি দিয়ে আদেশ জারি করে সরকার।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনের আলোকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) উচ্চপর্যায়ের আলেমদের সঙ্গে দফায় দফায় বসে এ সংক্রান্ত আইনের খসড়া চূড়ান্ত করে।
আইনে যা আছে
কওমি মাদরাসার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে এবং দারুল উলুম দেওবন্দের মূলনীতিগুলোকে ভিত্তি করে এই সমমান দেয়া হলো।’
প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, এই সমমান দেয়ার লক্ষ্যে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড বেফাকুল মাদারাসিল আরাবিয়া- বেফাক সভাপতি হিসেবে পদাধিকার বলে আল্লামা আহমেদ শাহ শফীর নেতৃত্বে কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এই কমিটি সনদবিষয়ক যাবতীয় কার্যক্রমের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী বিবেচিত হবে। এদের তত্ত্বাবধানে নিবন্ধিত মাদরাসাগুলোর দাওরায়ে হাদিসের সনদ মাস্টার্সের সমমান বিবেচিত হবে।
এই কমিটির অধীনে ও তত্ত্বাবধানে দাওরায়ে হাদিসের পরীক্ষা হবে। পাঠ্যক্রম প্রণয়ন, পরীক্ষা পদ্ধতি, পরীক্ষার সময় নির্ধারণ, অভিন্ন প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও উত্তরপত্র মূল্যায়ন, ফলাফল এবং সনদ তৈরিসহ আনুষঙ্গিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য এক বা একাধিক উপ-কমিটি গঠন করতে পারবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়গুলো অবহিত করবে কমিটি। এই কমিটি দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে থাকবে।
হঠাৎ সিদ্ধান্ত নয়
কওমি সনদের স্বীকৃতির বিষয়টি হঠাৎ কোনো সিদ্ধান্তে হয়নি। ২০০৯ সাল থেকেই প্রধানমন্ত্রী আলেমদের সঙ্গে যে আলোচনার সূত্রপাত করেন, সেটি ২০১০ সালে গ্রহণ করা শিক্ষানীতিতেও স্থান পায়।
সে সময়ই কওমি শিক্ষাকে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়। ২০১৩ সালে কওমি সনদের স্বীকৃতি বাস্তবায়নে আল্লামা শফীর নেতৃত্বে কমিশন গঠন করে সরকার। ১৭ সদস্য বিশিষ্ট ওই কমিটিতে সদস্য সচিব ছিলেন গওহারডাঙ্গা মাদরাসার মহাপরিচালক মুফতি রুহুল আমীন।
কওমি মাদরাসা মূলত ভারতের উত্তর প্রদেশের দেওবন্দ মাদরাসার আলোকে প্রণীত শিক্ষা ব্যবস্থা। এখানে কোরআন-হাদিসের মূলধারার শিক্ষার ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়। বাংলাদেশে প্রায় ২০ হাজার কওমি মাদ্রাসা রয়েছে।
এতদিন স্বীকৃতি না থাকায় কওমি মাদ্রাসার সদনধারীরা সরকারি, বেসরকারি কোনো চাকরিতে যোগ্য বলে বিবেচিত হতেন না। এখন তারা নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিয়ে তাদের যোগ্যতার প্রমাণ দিতে পারবেন।
অবশ্য এ বিষয়ে নতুন আইন পাস হওয়ার আগেই গত মার্চে ১০১০ জন কওমি আলেমকে মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম (ষষ্ঠ পর্যায়) প্রকল্পের আওতায় সরকারি চাকরিতে নিয়োগ দেওয়া হয়।
দাওরায়ে হাদিস কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ স্তর। কওমি শিক্ষায় ছয়টি স্তর রয়েছে। এগুলো হলো: ইবতেদাইয়্যাহ (প্রাথমিক), মুতাওয়াসসিতাহ (নিম্নমাধ্যমিক), সানাবিয়্যাহ আম্মাহ (মাধ্যমিক), সানাবিয়্যাহ খাসসাহ (উচ্চ মাধ্যমিক), মারহালাতুল ফজিলত (স্নাতক), মারহালাতুত তাকমিল বা দাওরায়ে হাদিস (মাস্টার্স সমমান)।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন