সংস্কৃতি ও শিকড়ের টানে বাংলাদেশে বাড়ছে পশ্চিমবঙ্গের পর্যটক
দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক এখন আগের থেকে ভালো৷ বিমান ও সড়কপথের পাশাপাশি জলপথেও যোগাযোগ বাড়ছে৷ সর্বোপরি রয়েছে সাংস্কৃতিক অভিন্নতা৷ তাই বাংলাদেশে পশ্চিমবঙ্গের পর্যটকের সংখ্যা ক্রমশই বাড়ছে৷
পশ্চিমবঙ্গের মানু্ষের বিদেশ ভ্রমণের অন্যতম প্রিয় গন্তব্য বাংলাদেশ৷ ব্যাংকক, পাটায়ার পাশাপাশি ঘরের কাছে বিদেশ সফরের স্বাদ নিতে অনেকেই বাংলাদেশ যাচ্ছেন৷ কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতা ও জঙ্গি হামলার জেরে এতদিন বেশ মন্দাই ছিল বাংলাদেশের পর্যটন ব্যবসা৷ ধীরে ধীরে পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করেছে৷ জঙ্গি আতঙ্ক কাটিয়ে অন্যান্য দেশের পর্যটকদের মতো ফের পশ্চিমবঙ্গের মানুষও বাংলাদেশমুখী৷ এমনটাই বলছিলেন কলকাতার ‘তিরুপতি স্পেশ্যাল’ নামে একটি বেসরকারি পর্যটন সংস্থার কর্মচারী গোপাল পাল৷ প্রতি বছর তাঁর সংস্থা একুশে ফেব্রুয়ারি, পয়লা বৈশাখ ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ দিনে কলকাতার পর্যটকদের বাংলাদেশ ভ্রমণে নিয়ে যায়৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘নেপাল-ভুটানের মতো প্রতিবেশী রাষ্ট্রের তুলনায় বাংলাদেশে কলকাতার পর্যটকরা বেশি যায়৷ রাজনৈতিক সুস্থিতি থাকায় অনেকেই বাংলাদেশকে বেছে নিয়েছেন৷ তাছাড়া এখন ভিসা পাওয়া সহজ হয়েছে৷ ভারতের অন্যান্য প্রদেশে ঘুরতে যেতে যে খরচ হয়, তাতে সহজেই বাংলাদেশে ঘুরে আসা যায়৷ এই ভাবনাতেই পর্যটকের সংখ্যা আগের বছরগুলির তুলনায় ২৫ শতাংশ বেড়েছে৷”
শুধু খরচ কম বলে এই বাংলার পর্যটকরা ওপার বাংলায় যাচ্ছেন, এ কথা বললে প্রকৃত তথ্যটি আড়ালে থেকে যায়৷ দেশভাগের ফলে দুই বাংলার মধ্যে কাঁটাতারের বেড়া উঠলেও রবীন্দ্রনাথ-নজরুলকে কে ভাগ করতে পেরেছে? কবি অন্নদাশঙ্কর রায়ের সেই বিখ্যাত পংক্তি — ‘সব কিছু ভাগ হয়ে গেছে, ভাগ হয়নিকো নজরুল’৷ দুই দেশের ভাষা, সংস্কৃতির বন্ধন কোনো রাজনৈতিক গণ্ডীতে দ্বিখণ্ডিত হওয়ার নয়৷ তাই বাংলাদেশের শিলাইদহ, সাজাদপুর, পতিসরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পদধূলির খোঁজে এই বাংলার অজস্র মানুষ উপস্থিত হন৷ এর সঙ্গে রয়েছে ভাষা শহিদদের জন্য অন্তরের টান৷ প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারিতে কত মানুষ বিশেষ দিনটির সাক্ষী হতে, শহিদদের শ্রদ্ধা জানাতে বাংলাদেশে উপস্থিত হন৷ সংস্কৃতি যে দুই দেশের যোগসূত্র, এ কথা মনে করিয়ে পর্যটক গোপাল দাস বলছিলেন, ‘বাংলাদেশের স্থান মাহাত্ম্য আছে তো বটেই’৷ শিলাইদহ, কুষ্টিয়ার ইতিহাসের পাশাপাশি একুশের ভাষা দিবস ও বইমেলার মাহাত্ম্য কম নয়৷ তাছাড়া এখন অনলাইনে পাসপোর্ট পরিষেবা পাওয়া যাচ্ছে, বাংলাদেশের ভিসার জন্য পয়সা লাগছে না৷
পর্যটনকে চাঙ্গা করে লাগাতার প্রচারের পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকার পর্যটন পরিষেবার মান বাড়াতেও জোর দিয়েছে৷ কলকাতা-ঢাকা রুটের বিমান পরিষেবা উন্নত হয়েছে৷ বেড়েছে উড়ানের সংখ্যাও৷ ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে চালু হয়েছে মৈত্রী এক্সপ্রেস৷ শুরু হয়েছে জলপথে যোগাযোগ৷ স্থান মাহাত্ম্যের সঙ্গে সফর সহজতর হয়ে ওঠায় বাংলাদেশে যাওয়ার ঝোঁক বেড়েছে, এমনটা মনে করছে বিভিন্ন পর্যটন সংস্থা৷ ভ্রমণসঙ্গী নামক একটি সংস্থার তরফে নির্মলেন্দু বসু বলেন, ‘বাংলাদেশের জন্য টান রয়েইছে’৷ অন্যদিকে রাজনৈতিক অচলাবস্থা দূর হয়েছে৷ তাই বাংলাদেশে যাওয়ার আগ্রহ আরও বেড়েছে৷ এর সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় পর্যটকরা দূরের জায়গার থেকে বাংলাদেশই পছন্দ করছেন৷
বাংলা সংস্কৃতির অন্যতম পীঠস্থান ঢাকা ভ্রমণের পাশাপাশি পৃথিবীর দীর্ঘতম সৈকত কক্সবাজার, সেন্ট মার্টিন, কুয়াকাটা, সুন্দরবন, পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতি বছর যাচ্ছেন বহু পর্যটক৷ কলকাতার বাংলাদেশ উপ দূতাবাসের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর যে সমস্ত ভিসা অনুমোদন হয়েছে, তার ৮০ শতাংশই ছিল পর্যটন ভিসা৷ এই প্রবণতা চলতি বছরেও অব্যাহত থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে৷ কিন্তু সব ক্ষেত্রে সংস্কৃতির টানটাই বড়, প্রকৃতির নয়৷ এমনটাই মনে করেন পরিচালক লীনা গঙ্গোপাধ্যায়৷ তাঁর পরিচালিত বাংলা ছবি ‘মাটি’-তে দেখানো হয়েছিল, এপার বাংলা থেকে শুধুমাত্র শিকড়ের খোঁজে ওপার বাংলায় যাওয়ার কাহিনি৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘আমি মনে করি, পশ্চিমবঙ্গের প্রকৃতি দর্শন করতে কেউ বাংলাদেশ যান না, সংস্কৃতির স্বাদ নিতে যান৷ অনেকে খোঁজেন নিজের শিকড়৷ ছিন্নমূল মানুষ নিজের অতীতের খোঁজ করতে ওপারে যান৷”
বাংলাদেশে সারা বছর যত পর্যটক আসেন, তার প্রায় ৪০ শতাংশ ভারতীয়৷ এর মধ্যে অবশ্যই সিংহভাগই বাঙালি৷ সংস্কৃতির টান তো আছেই, দেশভাগের যন্ত্রণায় এপার বাংলার বহু মানুষের হৃদয়ে বাংলাদেশের স্থান অন্য রকমের৷ ভারত ভাগের পর যখন ওপার বাংলা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হল, সেই সময় অসংখ্য মানুষ সীমান্ত পার করেছিল৷ অনেকের পূর্ব পুরুষের ভিটেমাটি নাটোর, রাজশাহী, পাবনা, বরিশাল, কুষ্টিয়ার গ্রামে গ্রামে৷ বাংলা চলচ্চিত্রের মহানায়িকা সুচিত্রা সেন থেকে পশ্চিমবঙ্গের প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু, এমন অসংখ্য মানুষের শিকড় বাংলাদেশে৷ কয়েক দশক পার হয়ে গেলেও যা আদতে বিচ্ছিন্ন হয়নি৷ হুগলির ঝরনা সরকার বলেন, ‘‘ছোটবেলা থেকে বাংলাদেশের কথা শুনেছি বয়োজ্যেষ্ঠদের মুখে৷ তাঁদের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে ওপার বাংলার মাটির সঙ্গে৷ সেগুলি মিলিয়ে দেখার জন্যও বাংলাদেশ যেতে ইচ্ছে করে৷ তাই এবার একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ গিয়েছিলাম৷ কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রাম কিছুই বাদ রাখিনি৷”
ভ্রমণ সংস্থাগুলির মধ্যে ‘ভয়েজার্স ক্লাব’ সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে পর্যটক নিয়ে যায়৷ এই সংস্থার কর্ণধার ইন্দ্রজিৎ সরকার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আগের থেকে বাংলাদেশের পর্যটন ব্যবস্থা অনেক ভালো হয়েছে৷ তবে যানজটের মতো সমস্যাও রয়েছে৷ পরিবহণের দিকটা আরও উন্নত করলে ভালো হবে৷”
এপারের পর্যটকরাও বাংলাদেশের পর্যটন পরিকাঠামো নিয়ে একাধিক সমস্যার কথা তুলছেন৷ ভদ্রেশ্বরের প্রবীণ পর্যটক জীবানন্দ চক্রবর্তী বলেন, ‘‘বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থানে ঘুরতে গিয়ে গাইডের অভাব বোধ করেছি৷ গাইড থাকলে ইতিহাস জানতে সুবিধা হতো৷ এছাড়া যোগাযোগের ক্ষেত্রে রেল পরিষেবাকে আরো উন্নত করা দরকার৷”-ডয়চে ভেলে
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন