সাংবাদিকতার পরিস্থিতি : নিজ দেশ নিয়ে মাথাব্যথা নেই, যুক্তরাষ্ট্র লেগেছে বাংলাদেশের পেছনে
দ্রব্যমূল্য বিষয়ে প্রথম আলোর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নেতিবাচক প্রতিবেদন নিয়ে সারা দেশেই সমালোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। কেবল দেশ নয়, দেশের বাইরেও বিষয়টি নিয়ে চর্চা হচ্ছে। বিশেষ করে মার্কিন দূতাবাস প্রথম আলোর অবস্থান রক্ষায় উঠেপড়ে লেগেছে। দেশটি বাংলাদেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয় নিয়ে কথা বললেও, বাস্তবে তাদের চিত্র কেমন? দেশটিতে সাংবাদিকরা কেমন আছে?
প্রথম আলো-ঢাকা ট্রিবিউনসহ বাংলাদেশের কয়েকটি গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের সাম্প্রতিক ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা ১২টি দেশের সমন্বয়ে গঠিত মিডিয়া ফ্রিডম কোয়ালিশনের (এমএফসি) ১২ সদস্য।
এমএফসি বলছে, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সুপ্রিম কোর্ট বার কাউন্সিলের নির্বাচনের সংবাদ সংগ্রহের সময়ে সাংবাদিকদের ওপর হামলা, কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল জাজিরার সাংবাদিকের ভাইয়ের ওপর হামলা, ঢাকা ট্রিবিউনের আলোকচিত্রী সাংবাদিকের ওপর হামলা এবং সম্প্রতি প্রথম আলোর সাংবাদিক আটকের খবরে তারা উদ্বিগ্ন। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে প্রতিটি ঘটনার দ্রুত ও নিরপেক্ষ তদন্তের অনুরোধ জানিয়েছে মিডিয়া ফ্রিডম কোয়ালিশন।
এমএফসির সদস্য হিসেবে এ বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারী দেশ হচ্ছে: অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র।
কিন্তু যে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সাংবাদিকদের অধিকারের বিষয়ে এতটা সরব তারা নিজের দেশে সাংবাদিকদের নিয়েও কি ততটা সরব? নিজ দেশের সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় কি তারা নিবেদিতপ্রাণ?
সাদা দৃষ্টিতে যুক্তরাষ্ট্রকে সাংবাদিকদের জন্য নিরাপদ মনে করা হলেও বিষয়টি সেরকম নয়। বাস্তবতা বলে, যুক্তরাষ্ট্রে সাংবাদিকদের পরিস্থিতি অনেকটাই নাজুক। বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায় মার্কিন সংস্থা প্রেস ফ্রিডম ট্র্যাকারের দেয়া পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে। ২০২৩ সালের প্রথম তিন মাসে দেশটিতে ১৪ জন সাংবাদিক বিভিন্ন ধরনের বৈষম্য, নিপীড়ন ও হুমকি-ধমকির শিকার হয়েছেন। এই ১৪ জনের মধ্যে ৫ জনকে শারীরিকভাবে আক্রমণ করা হয়েছে। দুজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে কিংবা গ্রেফতার করা হয়েছে। হুমকি দেয়া হয়েছে একজনকে। তথ্য দিতে অস্বীকার করা হয়েছে দুজনকে। কাজে বাধা দেয়া হয়েছে দুজনকে।
আরও পেছনের দিকে তাকালে দেখতে পাওয়া যাবে, ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ১৫ জন সাংবাদিককে গ্রেফতার করা হয়েছে কিংবা তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। সরাসরি আক্রমণের শিকার হয়েছেন অন্তত ৪০ জন, কাজে বাধা দেয়া হয়েছে ১০ জনকে। আদালতের মুখোমুখি হতে হয়েছে ৩০ জনকে।
যুক্তরাষ্ট্রে সাংবাদিকদের গ্রেফতার কিংবা তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে ২০২০ সালে। সেবছর মোট ১৪৫ জন গ্রেফতার কিংবা মামলার মুখোমুখি হয়েছেন। সে বছর আক্রমণের শিকার হয়েছেন ৬৩১ জন। ২০২১ সালেও মামলা কিংবা গ্রেফতারের মুখোমুখি হয়েছেন ৫৯ জন। এর মধ্যে গ্রেফতার হন ৫৬ জন।
২০১৭ সাল থেকে ২০২৩ সালের প্রথম তিন মাসের হিসাব আমলে নিলে বিগত ছয় বছরে মামলা কিংবা গ্রেফতারের শিকার হয়েছেন ২৮৩ জন। সরাসরি হামলার শিকার হয়েছেন প্রায় ১ হাজার তথা ৯৬৪ জন। তথ্য দিতে অস্বীকার করা হয়েছে ৭৬ জন সাংবাদিককে। হামলার কারণে সাংবাদিকতার কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়েছে ২০৩ জনের। আদালতের নোটিশের মুখোমুখি হয়েছেন ১৬৭ জন। দেহ তল্লাশি এবং যন্ত্রপাতি কেড়ে নেয়া হয়েছে ৮৩ জনের।
পরিসংখ্যান বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে সাংবাদিকদের অবস্থা যতটা ভালো ভাবা হয় বাইরে থেকে, ভেতরে ততটা ভালো নয়। এই অবস্থায় নৈতিকভাবে বাংলাদেশের মতো দেশের বেলায় যুক্তরাষ্ট্র সাংবাদিকতার নীতি-নৈতিকতা শেখানোর সবক দিতে আসতে পারে কি-না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা।
যুক্তরাষ্ট্রে সাংবাদিকদের গ্রেফতারের বিষয়ে ২০২১ সালে কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস বা সিপিজে’র নির্বাহী পরিচালক জোয়ের সাইমন বলেছিলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের হাতে সাংবাদিকদের গ্রেফতার ও আটক করার জন্য সম্যক কোনো কারণ নেই। তারপরও ২০২১ সালে এ ধরনের ৫৬টি ঘটনা নথিভুক্ত করা হয়েছে। এ থেকে বোঝা যায় যে, সমস্যাটি বিশাল আকার ধারণ করেছে।’
বিশ্লেষকদের মতে, যে দেশটি নিজেই সাংবাদিকদের গ্রেফতারে সিদ্ধহস্ত তারা প্রকৃতপক্ষে অন্য কোনো দেশকে সে বিষয়ে সরাসরি অভিযুক্ত করার নৈতিক অধিকার রাখে কি-না তা নিয়ে প্রশ্ন তুললে বোধহয় অযৌক্তিক হবে না। সাংবাদিকতার মানদণ্ড এবং মানবাধিকারের মানদণ্ড সবদেশেই সমান হওয়া উচিত। যদি তাই হয়, তবে নিজ দেশের পরিস্থিতি এতটা নাজুক রেখে মার্কিন দূতাবাস বাংলাদেশের সাংবাদিকদের অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তোলে কোন যুক্তিতে।
এখানে আরেকটি বিষয় পরিষ্কার করা দরকার। প্রথম আলো যে সংবাদটি প্রকাশ করেছে, তা নিয়ে যে কারো সংক্ষুব্ধ হওয়ার অধিকার রয়েছে। এ নিয়ে তার মামলা দায়েরেরও অধিকার রয়েছে। তবে রাষ্ট্র বা সরকার এতে জড়িত নয় বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তিনি বলেছেন, ‘আইন কিন্তু নিজস্ব গতিতে চলে। কেউ যদি সংক্ষুব্ধ হয়ে বিচার চায় বা সংক্ষুব্ধ হয়ে থানায় মামলা করেন, সে অনুযায়ী পুলিশ ব্যবস্থা নিতেই পারে।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, ‘স্বাধীনতা দিবসে, আমরা এতোদূর এগোনোর পর এ ধরনের একটা ভুয়া খবর যদি কেউ দেয় তাহলে যে কেউ সংক্ষুব্ধ হতে পারে, আপনিও হতে পারেন।’ এক পর্যায়ে রাষ্ট্রের আপত্তি আছে সে কারণে কি সাংবাদিককে তুলে নিয়েছে- এমন প্রশ্নের জবাবে আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘রাষ্ট্রের আপত্তি নয়।’
যাই হোক, যুক্তরাষ্ট্র মূলত বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে দ্বিমুখী মনোভাব পোষণ করছে। নিজ দেশেই যখন সাংবাদিকদের জন্য অনুকূল পরিস্থিতি নেই তখন অন্য দেশ নিয়ে মন্তব্য করাটা অসমীচীন। যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিমুখী নীতির আরও প্রমাণ পাওয়া যায় ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক ও আল জাজিরার সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহের হত্যাকাণ্ড নিয়ে দেশটির অবস্থান আমলে নিলে।
শিরিন আবু আকলেহ ২০২২ সালের ১১ মে বিনা উসকানিতে ইসরাইলি বাহিনীর গুলিতে ফিলিস্তিনের জেনিনের জেনিন ক্যাম্পে মারা যান। তারপর ১০ মাস পেরিয়ে গেলেও যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে এ বিষয়ে কোনো জবাবদিহিতার আওতায় আনেনি। এমনকি শিরিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হওয়ার পরও দেশটির পক্ষ থেকে তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। কেবল দেশটির স্টেট ডিপার্টমেন্ট একটি বিবৃতি দিয়েই দায় সেরেছে। উচ্চকিত হওয়া তো দূরে থাক, আর কোনো আওয়াজই চোখে পড়েনি।
কিন্তু বাংলাদেশের বেলায় যুক্তরাষ্ট্র তার অন্যান্য মিত্র দেশগুলোকে সঙ্গে নিয়ে উচ্চকিত। কিন্তু কেন? ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডেতে প্রকাশিত এক নিবন্ধে মার্কিন মানবাধিকার প্রতিবেদন বিষয়ে আলোকপাত করে সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত লিখেছেন, ‘স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রতিবেদনে জামায়াতের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রবল সমর্থন বাংলাদেশে পাকিস্তানপন্থি শক্তিকে সমর্থন করার মার্কিন নীতির একটি উল্লেখযোগ্য ধারাবাহিকতাকে প্রমাণ করে।’
স্বাধীনতার অর্ধ শতাব্দী পেরিয়ে এসেও যখন একটি ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র নিরপেক্ষ অবস্থান না নিয়ে মানবাধিকার প্রতিবেদনে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে সমর্থন করে, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার বিষয়ে পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করে; তখন প্রশ্ন উঠে যুক্তরাষ্ট্র আসলে কী চায়।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন