সাবেক রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীনের দ্বিতীয় জানাজা সম্পন্ন
সাবেক রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
রোববার (২০ মার্চ) জাতীয় ঈদগাহে তার এ জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
জানাজায় ইমামতি করেন সুপ্রিম কোর্ট জামে মসজিদের ইমাম আবু সালেহ মো. সলিমউল্লাহ।
সাবেক রাষ্ট্রপতির নামাজে জানাজায় প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, সাবেক প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতিরা, সাবেক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, বিএনপি নেতা আমান উল্লাহ আমান, সিনিয়র আইনজীবীরাসহ হাজারো মানুষ উপস্থিত ছিলেন।
পরে রাজধানীর বনানী কবরস্থানে তাকে দাফনের কথা রয়েছে।
এর আগে প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয় নেত্রকোনায় তার গ্রামের বাড়িতে। সেখানে শেষ শ্রদ্ধার পাশাপাশি জানানো হয় গার্ড অব অনার। পরে স্বজনরা অশ্রুসিক্ত বিদায় জানান।
শনিবার (১৯ মার্চ) সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ঢাকায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সাহাবুদ্দীন আহমদ।
হাসপাতালের হিমঘর থেকে বের করে আনা হয় সাবেক রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের মরদেহ। বরেণ্যের বিদায় কাঁদিয়েছে সবাইকে।
৯২ বছর বয়সী সাবেক রাষ্ট্রপতি দীর্ঘদিন ধরে ভুগছিলেন বার্ধক্যজনিত নানা রোগে। অবস্থা গুরুতর হলে মাসখানেক আগে তাকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় শনিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন সাহাবুদ্দীন আহমদ। এরপরই হাসপাতালে ছুটে যান স্বজনরা।
বর্ণাঢ্য কর্মময়জীবনের অধিকারী সাহাবুদ্দীন আহমদের স্বজনদের স্মৃতিচারণে সৃষ্টি হয় এক আবেগঘন পরিবেশের।
পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, বনানী কবরস্থানে মেয়ের কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হবেন সাবেক রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ।
শনিবার দুপুরে তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে হেলিকম্পটারে করে সাবেক এ রাষ্ট্রপতির মরদেহ নেওয়া হয় জন্মস্থান নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলায় পেময়ী গ্রামে। সেখানে অনুষ্ঠিত হয় তার প্রথম নামাজে জানাজা। শেষ শ্রদ্ধা জানান আত্মীয়স্বজন, জনপ্রতিনিধিসহ এলাকাবাসী।
ফিরে দেখা যাক তার কর্মময় জীবন:
মহকুমা প্রশাসক থেকে বিচার বিভাগ, পদোন্নতি পেয়ে হয়েছিলেন প্রধান বিচারপতি। বাংলাদেশের রাজনীতির ক্রান্তিকালে ঘটনাক্রমে উপরাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পান। পরে রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব পান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ।
এরপর বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে তিনি হয়ে ওঠেন গুরুত্বপূর্ণ এক ব্যক্তি। বর্ণাঢ্য জীবনের শেষভাগ তার কেটেছে ভীষণ একাকী। স্ত্রীর মৃত্যুর পর সড়ক দুর্ঘটনায় বড় মেয়ে ও তার এক জামাতা মারা গেলে তিনি নিজেকে ক্রমেই গুটিয়ে নেন। শেষ দিনগুলোতে পরিবারের সদস্যরা ছাড়া কেউ তার ছায়াটিও দেখেনি।
সাহাবুদ্দীন আহমদ তার কর্মজীবনে প্রথমে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন। ম্যাজিস্ট্রেট, মহকুমা প্রশাসক এবং অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক পদেও দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬০ সালের জুন মাসে তাকে বিচার বিভাগে বদলি করা হয়। তিনি ঢাকা ও বরিশালে অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ এবং কুমিল্লা ও চট্টগ্রামে জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি ঢাকা হাইকোর্টের রেজিস্ট্রার নিযুক্ত হন। ১৯৭২ সালের ২০ জানুয়ারি তাকে বাংলাদেশ হাইকোর্টের বিচারক পদে উন্নীত করা হয়।
১৯৮০ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি সাহাবুদ্দীন আহমদকে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারক নিয়োগ করা হয়। বিচারপতি হিসেবে বাংলাদেশ সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর ওপর তার দেওয়া রায় দেশের শাসনতান্ত্রিক বিকাশের ক্ষেত্রে এক অনন্য ঘটনা হিসেবে স্বীকৃত।
১৯৮৩ সালের মধ্য ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভরত ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণের ঘটনা তদন্তের জন্য গঠিত তদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। তৎকালীন সরকার তার সেই তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। ১৯৭৮ সালের আগস্ট থেকে ১৯৮২ সালের এপ্রিল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ রেডক্রস সোসাইটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৯০ সালের ১৪ জানুয়ারি তাকে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করা হয়। ওই বছরের ৬ ডিসেম্বর এরশাদবিরোধী গণ-আন্দোলনের মুখে তৎকালীন উপরাষ্ট্রপতি মওদুদ আহমদ পদত্যাগ করেন এবং বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে উপরাষ্ট্রপতি নিয়োগ করা হয়।
ওই দিনই রাষ্ট্রপতি এরশাদ পদত্যাগ করে উপরাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ফলে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি সরকার প্রধানের দায়িত্ব পান। ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তার নেতৃত্বে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
সাহাবুদ্দীন আহমদের চাহিদা অনুসারে দেশের সংবিধানের এগারোতম সংশোধনীটি আনা হয়। এর ফলে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনের পরও তিনি ১৯৯১ সালের ১০ অক্টোবর প্রধান বিচারপতির দায়িত্বে সুপ্রিম কোর্টে ফিরে যান এবং ১৯৯৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি প্রধান বিচারপতির পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
সাহাবুদ্দীন আহমদ আবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসেন ১৯৯৬ সালে। দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ওই বছর ক্ষমতায় এসে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি হিসেবে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করে। ১৯৯৬ সালের ৯ অক্টোবর তিনি নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন এবং ২০০১ সালের ১৪ নভেম্বর তিনি রাষ্ট্রপতির পদ থেকে অবসর নেন।
জীবনের শেষ দিনগুলো নীরবে, নিভৃতে কেটেছে সাহাবুদ্দীন আহমেদের। গুলশানের গ্র্যান্ড প্রেসিডেন্ট কনকর্ডে নিজের ফ্ল্যাটে উদয়াস্ত তার সময় কাটত খবরের কাগজ পড়ে। পরিবারের সদস্যদের বাইরে কারও সঙ্গে দেখা করতে চাইতেন না। করোনাকালে নিজেকে গুটিয়ে নেন তিনি। ছোট ছেলে, ছেলে বউ, নাতি আর ব্যক্তিগত সহকারী ছাড়া আর কেউ তার ছায়াটিও দেখতে পাননি।
২০১৩ সাল থেকে গ্র্যান্ড প্রেসিডেন্ট কনকর্ডে ছোট ছেলে সোহেল আহমদের সঙ্গে বসবাস করছিলেন সাহাবুদ্দীন আহমদ। সহধর্মিণী আনোয়ারা আহমদ গত ২০১৮ সালের ১৮ জানুয়ারি ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। সেই থেকে আরও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন ৯২ বছর বয়সী সাহাবুদ্দীন আহমদ।
সাবেক এ প্রধান বিচারপতির ছেলে-মেয়েদের মধ্যে বড় মেয়ে অধ্যাপক ড. সিতারা পারভিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। ২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোতে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। ওই দুর্ঘটনায় তার দ্বিতীয় মেয়ে শাহানা স্মিথের স্বামী গুরুতর আহত হয়ে পরের বছর মারা যান। শাহানা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রেই রয়েছেন। ছোট মেয়ে সামিয়া পারভীন একজন স্থপতি। বড় ছেলে শিবলী আহমদ একজন পরিবেশ প্রকৌশলী।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন