সুপেয় পানির সমস্যায় জর্জরিত সাতক্ষীরার পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী
সাতক্ষীরা জেলার কয়েকটি ইউনিয়নের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর হাজার হাজার মানুষ জলাবদ্ধবার কারণে ভুগছেন সুপেয় পানি, নিরাপদ পায়খানা এবং হাইজিন সংকটে। নিরাপদ পানি এবং স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানার অভাবে নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন তারা। সাতক্ষীরা সদর উপজেলার বল্লী ইউনিয়নের ১৭টি, ঝাউডাঙ্গার ২১টি ও আগরদাড়ি ইউনিয়নের ২৩টি গ্রাম মিলে মোট ৩ ইউনিয়নের ৬১ গ্রাম এবং সাতক্ষীরা পৌরসভার ৩৩টি গ্রামের শত শত পরিবার এখনো নিরাপদ পানি, স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা এবং হাইজিন সমস্যায় আক্রান্ত। এরমধ্যে বল্লী ইউনিয়নে ৩,৮২৬ পরিবার, আগরদাড়ি ইউনিয়নে ৮,৮৮৮ পরিবার, ঝাউডাঙ্গা ইউনিয়নের ৭,৯২২ পরিবার, সাতক্ষীরা পৌরসভার ২৬,৮৯৬ পরিবার,কলারোয়া পৌরসভার ৬,৫৭০ পরিবার এবং বরগুনা পৌরসভার ৭,৩৫৩ পরিবার মিলে সর্বমোট ৬১,৪৫৫ পরিবারের মোট ৩ লক্ষ ৭ হাজার ২৭৫ জন মানুষের এ সমস্যা প্রকট।
বল্লী ইউনিয়নের কাঁঠালতলায় ৯৪ পরিবার, মুকুন্দপুর গ্রামে ৫১৩ পরিবার ও রায়পুরে ৫২১ পরিবার মিলে ১,১২৮ পরিবারের মোট ৫,৬৪০ জন মানুষ নিরাপদ পানি, স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা এবং হাইজিন থেকে বঞ্চিত হয়ে ভুগছেন নানা রোগে। আগরদাড়ি ইউনিয়নের বাবুলিয়া গ্রামে ৪৬৫ পরিবার, ইন্দ্রিরায় ৪৭২ পরিবার, চুপড়িয়া গ্রামে ৮৫০ পরিবার, রামেরডাঙ্গায় ৫৮৭ পরিবার ও কাশিমপুর গ্রামে ১২৮৯ পরিবার সর্বমোট ৩,৬৬৩ পরিবারের নারী, শিশু, বয়স্ক, প্রতিবন্ধী এবং পুরুষ মিলে প্রায় ১৮,৩১৫ জন নিরাপদ পানি, স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ও হাইজিন সুবিধা থেকে বঞ্চিত। ঝাউডাঙ্গা ইউনিয়নের ছয়ঘরিয়ায় ৬৯৬ পরিবার, বলাডাঙ্গায় ৬৮৬ পরিবার, মাধবকাটি গ্রামে ১৮০ পরিবার, আখড়াখোলায় ২৯৮পরিবার ও ওয়ারিয়া গ্রামে ৫৯৬ পরিবার মিলে সর্বমোট ২,৪৫৬ পরিবারের মোট ১২,২৮০ জন সদস্য ভুগছেন নানা রোগে। পুষ্টিহীনতার পাশাপাশি তারা ডায়রিয়া, আমাশয়, গ্যাস্ট্রিক, আলসার, চুলকানি, পাচড়া, উচ্চ রক্তচাপ, হাপানীসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। এসব এলাকায় অধিকাংশ মানুষ অগভীর নলকূপের পানি ব্যবহার করেন। নলকূপগুলোর অধিকাংশই আর্সেনিক ও আয়রন যুক্ত। ৩টি ইউনিয়ন ও ৩টি পৌরসভার প্রায় লক্ষাধিক মানুষ ব্যবহার করছেন আর্সেনিক ও আয়রনযুক্ত পানি। এসব পাড়ার অধিকাংশ নলকূপের গোড়া এখনো পাকা নয়। নলকূপের গোড়া ময়লা আবর্জনায় ভরা। এসব পরিবারের অধিকাংশ সদস্যরা স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ব্যবহার করেন না। এক সময় খোলা আকাশের নিচে বনে-বাদাড়ে ঝোঁপের আড়ালে তারা মলত্যাগ করতো। এখন সে অবস্থা না থাকলেও যে পায়খানা ব্যবহার করেন তা আদৌ স্বাস্থ্যসম্মত নয়। ৪/৫টি রিং এবং ১টি স্লাব বসিয়ে তা বস্তা কিংবা কাপড় দিয়ে ঘিরে সেখানেই মলত্যাগ করেন প্রতিবন্ধী, বয়স্ক, নারী, পুরুষ ও শিশুরা। একটি পায়খানা ৩/৪টি পরিবার ব্যবহার করছেন। পায়খানা ব্যবহারের পরে সাবান কিংবা ছাঁই দিয়ে হাত পরিস্কার করা নাকি এদের কাছে বিলাসিতা। পরিস্কার পরিচ্ছতা সম্পর্কে এখনো অনেকেই সচেতন নয়।
বল্লী ইউনিয়নের মুকুন্দপুর গ্রামের মেছের গাজীর স্ত্রী লাইলী বেগম, ঝাউডাংগা ইউনিয়নের বলাডাংগা গ্রামের কাশেম সরদারের স্ত্রী শরবানু বেগম, আগরদাড়ি ইউনিয়নের বকচরা গ্রামের শহিদুল্লাহ সরদার, সাতক্ষীরা পৌরসভার ২ নং ওয়ার্ড মুনজিতপুর গ্রামের নাছিরউদ্দিন মুন্সির স্ত্রী মোছাঃ সালমা আক্তার, ৩ নং ওয়ার্ড বদ্দিপুর কলোনির মৃত ইমাম হোসেনের স্ত্রী হোসনেয়ারা আক্তার ময়নাসহ অনেকেই বিশুদ্ধ খাবার পানি, স্বাস্থ্যসম্মত ল্যাট্রিন ও হাইজিন সমস্যার কথা তুলে ধরে বলেন, তাদের এলাকা জলাবদ্ধতা (বৃষ্টির সময় ৭/৮মাস জলাবদ্ধ থাকে) এবং লবণাক্ত থাকায় খাবার পানির কোন ব্যবস্থা নেই। প্রায় ২/৩ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে এক কলস খাবার পানি আনতে হয়। আবার এক ড্রাম পানি ৩০ টাকা দিয়ে কিনে খাওয়া লাগে। বর্ষা মৌসুমে ভিটেবাড়িতে পানি জমে থাকায় ল্যাট্রিন করার মতো জায়গাও থাকেনা। আর লবণাক্ত পানি ব্যবহারের ফলে উচ্চ রক্তচাপ, চুলকানী, পাচড়া, পেটের পীড়াসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন তারা।
তারা আরও বলেন, বেতনা নদী ভরাট হওয়ায় এবং এলাকায় শত শত মাছের ঘেরের কারণে পানি সঠিকপথে নিষ্কাশন হতে না পারায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এ সময় তারা নিরাপদ খাবার পানি, স্বাস্থ্যসম্মত ল্যাট্রিনসহ বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
এ ব্যাপারে বল্লী ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ বজলুর রহমান জানান, এলাকায় খাবার পানির সমস্যা প্রকট। খাবার পানি ও স্বাস্থ্য সম্মত ল্যাট্রিনের ব্যবস্থা করতে সরকারি বেসরকারি সংস্থার সমন্বিত উদ্যোগ জরুরী। উত্তরণ দীর্ঘদিন ধরে অত্র এলাকায় হতদরিদ্র ও সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিতে মানুষকে সচেতন করার পাশাপাশি বিভিন্ন এ্যাডভোকেসী কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। উত্তরণসহ বিভিন্ন বে-সরকারি সংস্থার কার্যক্রম আরও জোরদার করা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।
সাতক্ষীরা সদর উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সহকারী প্রকৌশলী মোঃ মনিরুজ্জামান জানান, বল্লী, ঝাউডাঙ্গাসহ কয়েকটি এলাকায় লেয়ার না পাওয়ায় ডিপটিউবওয়েল বসানো সম্ভব হয়ে উঠছেনা। তবে নিরাপদ পানি ও পয়:নিষ্কাশন ব্যবস্থা আগের চেয়ে বর্তমানে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। খোলা স্থানে মলত্যাগের হারও প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে।
সাতক্ষীরা পৌর সভার মেয়র তাজকিন আহমেদ চিশতি বলেন, সুপেয় পানির জন্য দু’টি পাওয়ার ট্রিটমেন্ট প্লান রয়েছে তা পর্যাপ্ত নয়। পানির লেয়ার নিচে নেমে যাওয়ায় পানি উত্তোলন সম্ভব হচ্ছে না।
উত্তরণ এর ওয়াই ওয়াশ প্রকল্পের প্রকল্প সমন্বয়কারী হাসিনা পারভীন জানান, ২০১৮ সালের বেইজলাইন রিপোর্ট অনুযায়ী সাতক্ষীরা সদর উপজেলায় নিরাপদ পানির ব্যবস্থা ছিল ৪১%, স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ছিল ৫৪%, হাইজিন ছিল ৪৮% এবং সাতক্ষীরা পৌরসভায় নিরাপদ পানির ব্যবস্থা ছিল ৬৪%, স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ছিল ২৮% হাইজিন ছিল ৯৬%। সাইক্লোন বুলবুল এবং সাইক্লোন আম্ফানে এলাকা ল-ভ- এবং বৃষ্টিজনিত জলাবদ্ধতার কারণে সেই অবস্থার কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
তিনি বলেন, উল্লেখিত এলাকায় ওয়াশ বাজেট পূর্বের তুলনায় বৃদ্ধি পেলেও চাহিদার তুলনায় তা যথেষ্ট নয় এবং এসডিজির ৬নং গোল অর্জনের জন্য এই বাজেট অপ্রতুল। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ পানি ও স্যানিটেশন সেক্টরের জন্য দরিদ্র সহায়ক কৌশল অনুমোদন করেছে। এলাকার মানুষের নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য আরও বাজেট বৃদ্ধির পাশাপাশি এসডিজির ৬ নং গোল অর্জনের জন্য সরকারী পদক্ষেপ জরুরী বলে তিনি মনে করেন।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন