সৌদি সেনা-প্রশাসনে মধ্যরাতের ঝাঁকুনির নেপথ্যে কী?

শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাসহ সেনাপ্রধানকে বরখাস্ত ছাড়াও জনপ্রশাসনের বিভিন্ন পদে বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছে সৌদি আরব। দেশটির বাদশা সালমান বিন আবদুল আজিজ সোমবার মধ্যরাতে সিরিজ রাজকীয় ডিক্রি জারির মাধ্যমে এসব পরিবর্তন আনেন। বাদশা সালমান সেনাপ্রধান আবদুল রহমান বিন সালেহ আল বানিয়ানকে সরিয়ে ফায়াদ আল রুয়ালিকে সেনাপ্রধান নিয়োগ দিয়েছেন। বিমানবাহিনী ও স্থলবাহিনী প্রধানের পদেও পরিবর্তন আনা হয়েছে।

তামাদার বিনতে ইউসুফ আল রামাহ নামে এক নারীকে শ্রম ও সমাজ উন্নয়নবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের আসির প্রদেশে ডেপুটি গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে প্রিন্স তুর্কি বিন তালালকে। প্রিন্স তুর্কি বিন তালালের ভাই বিলিয়নিয়ার প্রিন্স আলওয়ালেদ বিন তালালকে কিছুদিন আগে আরও কয়েকজন প্রিন্সের সঙ্গে বন্দি করা হয়। দুই মাস পর অর্থের বিনিময়ে মুক্ত হন তিনি।

হঠাৎ করে সামরিক কর্মকর্তাদের বরখাস্ত কিংবা প্রশাসনে রদবদলের কোনো কারণ ব্যাখ্যা করেনি সৌদি সরকার। তবে এসব পদে যাদের আনা হয়েছে, তারা বয়সে অপেক্ষাকৃত তরুণ।

ধারণা করা হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘদিন ধরেই ইরান বিরোধী বলয় তৈরির প্রচেষ্টায় রয়েছে সৌদি আরব। মূলত ইরানকে কোণঠাসা করতেই তারা যুক্তরাষ্ট্র এবং গালফ দেশগুলোকে নিয়ে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। সৌদি রাজতন্ত্রের ভবিষ্যত উত্তরাধিকারী মোহাম্মদ বিন সালমানকে ক্রাউন প্রিন্স করার পর এই তৎপরতা আরও গতি পায়।

সৌদিতে সাম্প্রতিক কালের অনেকগুলো বরখাস্তের পেছনে ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের হাত রয়েছে বলে ধারণা করা হয়।

কয়েক মাস আগে হঠাৎ করে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের নামে বিপুল সংখ্যক প্রিন্স, মন্ত্রী ও ব্যবসায়ীকে আটক করা হয়েছিল ক্রাউন প্রিন্সের নির্দেশেই। পরে তাদের কাছ থেকে বড় ধরনের অর্থ নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়।

সেনা ও সিভিল প্রশাসনে নতুন এই বরখাস্ত এবং রদবদলেও মোহাম্মদ বিন সালমানের হাত রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট ইয়েমেনে প্রায় তিন বছর ধরে হুথি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। তাদের হামলায় দেশটিতে হাজার হাজার বেসামরিক মানুষ নিহত হচ্ছেন। বলা চলে, দুর্ভিক্ষের মুখে পড়েছে ইয়েমেন।

এরপরও সেখানে হুথিদের দুর্বল করতে পারেনি সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট। পাল্টা হামলার মুখে পড়ে সৌদি আরব। হুথিরা রিয়াদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছাড়াও বিভিন্ন এলাকায় রকেট হামলা চালায়। এতে সেখানে সৌদি জোট বেশ বেকায়দায় পড়েছে। ইরান হুথিদের সহায়তা করায়, এই যুদ্ধে সৌদি জোটের সফল হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।

সৌদি আরবের মদদপুষ্ট বাহিনী সিরিয়ায় প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ বাহিনীর কাছে বলা চলে পরাজিত হয়েছে। সেখানে রাশিয়া এবং ইরান আসাদকে সহায়তা দিয়ে আসছে।

গালফ দেশগুলোকে নিয়ে সৌদি আরব মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ কাতারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। কিন্তু, দীর্ঘদিনেও বশ্যতা স্বীকারের পরিবর্তে কাতার আঞ্চলিক কূটনীতির মাধ্যমে সৌদি আরবের ওপর পাল্টা চাপ তৈরি করে। ফলে আঞ্চলিক রাজনীতিতেও সৌদি আরব কোণঠাসা হয়ে পড়েছে।

এর বাইরে সৌদি বাদশা সালমান এবং তার ছেলে ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান রাজকীয় পরিবারের নিয়ন্ত্রণ নিজ মুঠোয় নিতে তৎপর রয়েছেন। তারা প্রশাসনের বিভিন্ন পদ থেকে অভিজ্ঞ রাজ পরিবারের সদস্যদের সরিয়ে অনুগত তরুণদের নিয়োগ দেন।

এমন পরিস্থিতিতে সেনাপ্রধানসহ শীর্ষ সেনা কর্মকর্তাদের সোমবার মধ্যরাতে বরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত নিল সৌদি আরব। সঙ্গে আরও কিছু পদে নতুন নিয়োগ দেয়া হলো।

এসব বিষয়কে সামনে রেখে ওয়াশিংটনের জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির সৌদি আরব বিশেষজ্ঞ পল সুলিভাস বলেন, ‘বাদশা এবং তার ছেলে মোহাম্মদ বিন সালমান (এমবিএস বলে পরিচিত) নতুন কিছু করতে চাইছেন। এরই অংশ হিসেবে ইরান, সিরিয়া ও ইয়েমেনের ওপর চাপ তৈরির কৌশল হিসেবে তরুণ এবং সক্রিয়দের বেশি বেশি নেতৃত্বে আনছেন।’

আখেরে এসব কতটা কাজে দেবে, তা সময়ই বলে দেবে। তবে সৌদি বাদশা এবং তার ছেলে মিলে তেলভিত্তিক অর্থনীতির নির্ভরতা কমিয়ে অভ্যন্তরীণ শিল্প বাড়াতে চাইছেন। আর এসব করতে হলে নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জই সবার আগে আসছে। ফলে ‘ভিশন অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজি’র অংশ হিসেবে সৌদি বাদশা সালমান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে ঢেলে সাজাচ্ছেন বলে মনে করা হচ্ছে।

তথ্যসূত্র: এএফপি, রয়টার্স, বিবিসি, আলজাজিরা, সৌদি গেজেট, মিডিলইস্ট মনিটর, আল আরাবিয়্যাহ।