‘স্পর্শকাতর’ সীমান্তে ২৪ ঘণ্টা কমান্ড নজরদারি চায় সরকার
ভারত ও মিয়ানমার সীমান্তের ৫১১ কিলোমিটার এলাকা ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশ। স্পর্শকাতর এই এলাকায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ‘কমান্ড’ স্তরের নজরদারি নিশ্চিত করতে চাইছে সরকার। এজন্য নেয়া হয়েছে ‘সার্ভেইলেন্স সিস্টেম’ স্থাপনের উদ্যোগ। সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থাও শক্তিশালী করা হয়েছে। দেয়া হয়েছে স্বতন্ত্র এয়ার উইংয়ের অনুমোদন। তারপরও কমপক্ষে আরেক বছর অরক্ষিতই থাকবে সীমান্তের ১৩৭ কিলোমিটার এলাকা।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ গত সপ্তাহে জাতীয় সংসদকে এসব তথ্য দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে মঙ্গলবার (২৩ জানুয়ারি) কথা হয় নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আবদুর রশিদের। সরকারের এসব উদ্যোগ ‘যুক্তিযুক্ত’ ও ‘কৌশলগতভাবে গ্রহণযোগ্য’ মন্তব্য করে সীমান্ত এলাকার সাধারণ মানুষের জীবন-মান উন্নয়নের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
মন্ত্রণালয় সংসদকে জানিয়েছে, পরিকল্পনা অনুযায়ী ঝুঁকিপূর্ণ ৫১১ কিলোমিটার সীমান্তকে তিন বছরের মধ্যে ‘সার্ভেইলেন্স সিস্টেমের’ আওতায় আনা সম্ভব হবে। ড্রোন, রাডার, থার্মাল ক্যামেরা, ভিডিও ক্যামেরাসহ বিভিন্ন সেন্সরসমৃদ্ধ এই সিস্টেমের মাধ্যমে বিজিবির বিভিন্ন ‘কমান্ড’ স্তর থেকে ওইসব এলাকায় ২৪ ঘণ্টাই নজরদারি করা যাবে।
ইতোমধ্যে যশোরের পুটখালীর ৭ কিলোমিটার স্পর্শকাতর এলাকায় এই সিস্টেম বসানো হয়েছে। টেকনাফ সীমান্তের ৯ কিলোমিটার এর আওতায় আনার কাজ চলছে। টেকনাফের আরো ১৮ কিলোমিটার এবং নওগাঁর হাপানিয়ার ১৪ কিলোমিটারের জন্য সার্ভেইলেন্স সিস্টেম বসানোর কাজও শিগগির শুরু হবে। বর্তমানে সদর দফতরসহ বিজিবির ৫টি আঞ্চলিক সদর দফতর, ১৪টি সেক্টর সদর দফতর, বর্ডার গার্ড ট্রেইনিং সেন্টার অ্যান্ড স্কুল, ৫টি বর্ডার গার্ড হাসপাতাল এবং ৮টি ব্যাটালিয়ন সদরসহ ৩৩টি ইউনিটে ভিডিও কনফারেন্স সুবিধা রয়েছে। শিগগিরই বাকি ইউনিটগুলো এ সুবিধা পাবে। এছাড়া বিজিবির সব আইসিপি ও ল্যান্ডপোর্ট সিসিটিভি নেটওয়ার্কে আনার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক আবদুর রশিদ বলেন, ‘আমি মনে করি, এ ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া গেলে স্পর্শকাতর সীমান্তগুলোর যেকোনো মুভমেন্ট ডিটেক্ট করা এবং সে অনুযাযী কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া সহজ হবে। বিষয়টি যুক্তিযুক্ত ও কৌশলগতভাবে গ্রহণযোগ্য।’ তিনি বলেন, ‘অনেক দেশেই বর্ডার সার্ভেইলেন্সের (নজরদারি) জন্য বিশেষ ইলেকট্রনিক্স (বৈদ্যুতায়িত) ব্যবস্থা রয়েছে। এটা অনেক বেশি কার্যকর হয়। কারণ এটি সার্বক্ষণিক।’
অবসরপ্রাপ্ত এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের বিওপি প্যাট্রোলিংয়ের যে সিস্টেম তাতে গার্ডরা কোনো এলাকায় একটা নির্দিষ্ট সময় টহলে যাচ্ছে। তারা ফেরার পর সে এলাকা আর তাদের দৃষ্টিসীমায় থাকছে না। ইলেকট্রনিক সার্ভেইলেন্স সিস্টেম বসানো গেলে ২৪ ঘণ্টাই পুরো এলাকায় নজরদারিটা রাখতে পারবেন-এটিই সবচেয়ে বড় সুবিধা।’
জননিরাপত্তা বিভাগ জানিয়েছে, বিজিবির গোয়েন্দা সংস্থাকে শক্তিশালী করে বর্ডার সিকিউরিটি ব্যুরো স্থাপন করা হয়েছে। ৪টি সেক্টর ও ৪টি রিজিয়নাল ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো স্থাপন করা হয়েছে। নতুন অনুমোদিত ১৫টি ব্যাটালিয়ন স্থাপনের মাধ্যমে বিজিবি পুনর্গঠনের ১ম পর্ব শেষ হয়েছে। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত পরিস্থিতি ও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের বিষয়টি বিবেচনায় বিজিবির বিদ্যমান জনবল দিয়ে কক্সবাজারে ১টি অ্যাডহক রিজিয়নাল সদর দফতর করা হয়েছে। বিজিবিকে আধুনিক শক্তিশালী বাহিনীতে রূপান্তরে অপারেশনাল সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে স্বতন্ত্র এয়ার উইংও অনুমোদন দিয়েছে সরকার, যা গঠনের কাজ পূর্ণগতিতে চলছে। চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় ওই এয়ার উইংয়ের হেলি বেইজ নির্মাণ কাজ চলছে।
মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বিজিবির অপারেশনাল কার্যক্রম গতিশীল করতে শিগগির দুটি হেলিকপ্টার ক্রয় প্রক্রিয়া শুরু হবে। ইতোমধ্যে আধুনিক স্ক্যানার মেশিন কেনার কাজ শুরু হয়েছে। সীমান্তে মাদক, অবৈধ অস্ত্র এবং অন্যান্য চোলাচালান প্রতিরোধে ডগ স্কোয়াড গঠন করা হয়েছে। বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তায় চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেও বিজিবির ৮টি ডগ স্কোয়াড মোতায়েন রয়েছে।
অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল রশিদ বলেন, ‘দেশ যখন এগুবে তখন বাহিনীগুলোও এভাবে আরো গতিশীল হবে, এটাই স্বাভাবিক। বিশ্বের মোটামুটি সব দেশেই যারা সীমান্ত রক্ষা করেন তাদের এমন গতিশীলতা রয়েছে। বাংলাদেশের ছিল না।’ হেলিকপ্টার যুক্ত হলে বিজিবির সামর্থ্য বাড়বে সন্দেহ নেই মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘এটাও মোবিলিটি অ্যাড করবে অর্থাৎ গতিশীলতা। ফলে কোনো দুর্গম সীমান্তে ঝুঁকি তৈরি হলেও সেখানে দ্রুত পৌঁছানো যাবে।’
নথির একাংশে জননিরাপত্তা বিভাগ বলেছে, সংসদ ২০০৯ সালে বিজিবি পুনর্গঠনের রূপরেখা অনুমোদনের পর ভারত ও মিয়ানমার সীমান্তে ৪টি ব্যাটালিয়ন ও ৬০টি বিওপি করা হয়েছে। ফলে ৫৩৯ কিলোমিটার অরক্ষিত সীমান্তের মধ্যে ৪০২ কিলোমিটার নজরদারিতে এসেছে। নতুন বিওপি স্থাপনের মাধ্যমে ১ বছরের মধ্যে বাকি ১৩৭ কিলোমিটারও নজরদারির আওতায় আনা সম্ভব হবে। নথির আরেক অংশে বলা হয়েছে, বিজিবি পুনর্গঠনের আওতায় সীমান্ত এলাকায় ১৫টি সাইক্লোন শেল্টার টাইপ বিওপি, ৭৫টি এ-টাইপ বিওপি ও ১২৮টি বর্ডার সেন্ট্রি পোস্ট (বিএসপি) নির্মাণ করা হয়েছে। দুটি বিওপির দূরত্ব কমাতে নতুন বিএসপিগুলো স্থাপন করা হয়েছে। নতুন করে ৬০টি বিওপির কাজ শুরু হয়েছে, যার ৪৫টির কাজ শেষ পর্যায়ে।
জানা গেছে, ২০১৬ সাল থেকে ৩৩৭ জন মহিলা সদস্য নিয়োগ করেছে বিজিবি, যাদের ৫০ জন প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। চলতি বছর আরো ৫০ নারীকে নিয়োগ দেওয়া হবে। মন্ত্রণালয় বলছে, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ ভিশন-২০৪১-এর আওতায় সাংগঠনিক কাঠামোয় ১৫ হাজার নতুন পদ সৃষ্টির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
অনুমোদিত জনবল দিয়ে ১টি রিজিয়নাল সদর দফতর, ৩টি সেক্টর সদর দফতর, ৮টি বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়ন, ১টি ডগ স্কোয়াড ইউনিট এবং ট্রেনিং সেন্টার, ২টি বর্ডার গার্ড ট্রেনিং স্কুল, ২টি রিজিয়ন রিজার্ভ ব্যাটালিয়ন, বঙ্গবন্ধু ট্রেনিং একাডেমি, ৫টি লজিস্টিক বেইজ, ১টি রিজিয়নাল ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো, ১টি কুইক রি-অ্যাকশন ফোর্স ইউনিট, ১টি গার্ড পুলিশ ব্যাটালিয়ন এবং ১টি স্টেশন সদর দফতর স্থাপন করা হবে। টেকনাফ ও সুন্দরবন এলাকার নদীসীমা রক্ষায় ২টি রিভারাইন ব্যাটালিয়ন গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। সুন্দরবনের নীলডুমুরের কাঁচিকাটা ও আঠারোবেঁকী খালে ইতোমধ্যে ২টি ভাসমান বিওপি করা হয়েছে। কৈখালী-কাঁচিকাটা জলপথের মাঝেও এমন ২টি বিওপি হবে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক রশিদ বলেন, ‘বিজিবির পাশাপাশি বর্ডারের মানুষদের জীবন-মান উন্নয়নে মনোযোগ দিতে হবে। অবৈধভাবে জীবিকা নির্বাহের প্রবণতা ঠেকানো গেলে তা-ই আমাদের সীমান্তকে সবচেয়ে নিরাপদ করবে।’
নথি সূত্রে জানা গেছে, বিজিবি গত বছর ১ হাজার ২১৭ কোটি ৫৫ লাখ ৭৪ হাজার ৪৮৭ টাকা মূল্যের অবৈধ পণ্য ও ২ হাজার ৫০৬ জনকে আটক করে। এসব ঘটনায় মামলা হয় ২৫ হাজার ১৫২টি।
সংসদে সম্প্রতি এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানান, সীমান্ত অঞ্চলে চোরাচালানের দায়ে আটকদের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে চোরাকারবারিদের তালিকা করা হয়। বিজিবি এই তালিকা সংরক্ষণ ও হালনাগাদ করে। একইসঙ্গে তারা গোপনে সীমান্তের ওপারের চোরাকারবারিদের তালিকা সংগ্রহ ও হালনাগাদ করে।
আরেক প্রশ্নে মন্ত্রী ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের সঙ্গে যৌথ টহলের কথাও সংসদকে জানান। সীমান্ত হত্যা বন্ধে সরকারের সার্বিক প্রয়াস অব্যাহত রয়েছে বলেও জানান তিনি।
প্রসঙ্গত, দুই শতাধিক বছরের ঐতিহাসিক পরম্পরা বয়ে নিয়ে চলা বিজিবি এর আগে বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর) নামে পরিচিত ছিল। রাজধানীর পিলখানায় বাহিনীর সদর দফতরে ২০০৯ সালের ফেব্র“য়ারির বিদ্রোহে জওয়ানদের হাতে নিহত হন ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন। এর এক বছর পর ২০১০ সালের মার্চে বদলে যায় বাহিনীর নাম। বিদ্রোহের ঘটনায় সারা দেশে ৫৭টি মামলায় ৫ হাজার ৯২৬ জনের সাজা হয়। হত্যাকাণ্ডে জড়িত অপরাধে নিম্ন আদালতের রায় পুনর্বিবেচনা করে ১৫২ জনের মধ্যে ১৩৯ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছেন উচ্চ আদালত।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন