হঠাৎ তৎপর জামায়াত, কী ভাবছে বিএনপি?
নিবন্ধন ও প্রতীক অনেক আগেই হারিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। ফাঁসি হয়েছে শীর্ষ নেতাদের। মধ্যম সারির নেতারা কারাগারে, নয়তো আত্মগোপনে। মাঠের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরেই কিছুটা নিষ্ক্রিয় দলের নেতাকর্মীরা। তবে সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে সামনে রেখে হঠাৎ ভোটের রাজনীতিতে ফিরতে মরিয়ে হয়ে ওঠেছে দলটি। আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এককভাবে প্রার্থী ঘোষণা করে জানান দিতে চায় তারা। ডিএনসিসিতে জামানত রক্ষা কঠিন এবং অন্যান্য সিটিতে জিততে পারবেনা জেনেও সব সিটিতেই ২০ দলের সিদ্ধান্তের বাইরে নিজেদের প্রার্থী ঘোষণা করে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগকেই সুবিধা করে দিতে চলেছে। একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে ৬সিটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে হঠাৎ জামায়াতের এই আত্মপ্রকাশ রহস্য নিয়ে চলছে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিশ্লেষণ। বিএনপির নেতারা এ নিয়ে এখনো মন্তব্য না করলেও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন পর্দার আড়ালে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের সুবিধা পাইয়ে দেয়ার কৌশল হিসেবে জামায়াত হঠাৎ জেগে উঠছে।
জামায়াতের এককভাবে নির্বাচনমুখী হওয়ায় ২০দলীয় জোটের নেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছেন, যে জোটের ছায়ায় রাজনীতির মাঠে অবস্থান গড়ে তুলেছিল জামায়াত; তারা এখন সেই জোটকে এড়িয়েই প্রতিপক্ষকে সুবিধা দিতে চলেছে! কেউ কেউ মনে করেন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সরকার তাদেরকে নানাভাবে টোপ দিচ্ছে ২০ দলীয় জোট থেকে দূরে সরিয়ে দেয়ার। ক্ষমতাসীনদের সেই ফাঁদে জামায়াত যদি পা দেয় তাহলে সেটা হবে তাদের জন্য আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।
জোটের নেতারা অভিযোগ করেন বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের শরীক হলেও জামায়াত এখন শুধু নিজেদের নিয়ে ভাবছে। এরই অংশ হিসেবে সব সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন হারানো দলটি। পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত দলটি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অন্তত ৫০টি আসনে প্রতিন্দ্বিতা করতে চাইছে। এরই মধ্যে আদালতের আদেশে স্থগিত ঢাকা উত্তর সিটিতে সেলিম উদ্দিন, সিলেটে এহসানুল মাহবুব জুবায়ের ও রাজশাহীতে সিদ্দিক হোসাইনকে প্রার্থী ঘোষণা করেছে জামায়াত। বরিশাল, খুলনা ও গাজীপুর সিটি নির্বাচনেও এককভাবে মেয়র প্রার্থী ঘোষণা প্রক্রিয়াধীন। রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাফরুল্লাহ চৌধুরী মনে করেন বিএনপির সঙ্গে দর কষাকষির ক্ষমতা বাড়াতেই এ কৌশল নিয়েছে জামায়াত। তবে আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি জোট ছাড়তে সরকার জামায়াতকে টোপ দিতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
‘ভোটের মাঠে সুবিধা করতে পারবে না জেনেও কেন প্রার্থী ঘোষণা’ এমন প্রশ্নে জামায়াতের একটি সূত্র জানিয়েছে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে জামায়াত সরকারকে দেখাতে চাইছে তারা বিএনপির সাথে জোটে আর নেই। জামায়াত আশা করছে এতে সরকারের তাদের প্রতি কঠোর অবস্থান থেকে সরে এসে কিছুটা নমনীয় হবে। কারণ সরকারের বিভিন্ন জরিপে মাঠ পর্যায়ের ভোটের চিত্র সরকারের হাতে রয়েছে। অন্যদিকে এককভাবে প্রার্থী ঘোষণা দিয়ে জামায়াত বিএনপিকে বার্তা দিতে চায় যে তাদের ব্যাপারে বিএনপির সাম্প্রতিক নিরাসক্ততা তারা পছন্দ করছে না; এবং সামনের সাধারণ নির্বাচনে শরীক হিসাবে তাদের যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে।
যদিও সিটি কর্পোরেশনগুলোতে জামায়াতের একক প্রার্থী ঘোষণা নিয়ে বিস্মিত জোটের নেতারাই। সর্বশেষ ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতাদের বৈঠকে প্রকাশ্যেই সে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন একাধিক নেতা। জামায়াতের কাছে ব্যাখ্যাও চেয়েছেন তারা। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন সরকারকে সুবিধা দিতেই জামায়াতের এই অবস্থান কিনা? তবে সেই বৈঠকে জামায়াতের প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত থাকা নেতা কোন সদুত্তোর দিতে পারেননি।
জামায়াতের প্রার্থী দেওয়ার খবরে অনেকটাই বিস্মিত জোটের শরিক বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি) চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিভ রহমান পার্থ বলেন, জামায়াতের একক প্রার্থী ঘোষণা আমাকে কিছুটা অবাক করেছে। আমার মনে হয় দর কষাকষি করতেই জামায়াতের এরকম অবস্থান নেওয়া। এটা করতেই হয়তো জামায়াত প্রার্থী দিচ্ছে। বাকিটা আমার জানা নেই।
বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে জামায়াত খুব ভাল করেই জানে এককভাবে নির্বাচনে তারা কোথাও জিততে পারবে না। অধিকাংশ সিটিতে তাদের প্রার্থীকে জামানত হারাতে হবে। কিন্তুই তারপরও বিভিন্ন জায়াগায় প্রার্থী ঘোষণা দিয়ে তারা কয়েকটি বিষয়কে স্পষ্ট করে দিচ্ছে। প্রথমত: পর্দার আড়ালে সরকারের সাথে তারা বিশেষ কোন সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। যার মাধ্যমে বিএনপি জোটকে ভোটের মাঠে বিপাকে ফেলতে চায়। অথবা এখনই সব কিছুর ফায়সালা করতে চায় জামায়াত। তাই তারা বলছে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নিবে। ৭০টি আসন তারা এখনই নিশ্চিত করতে চায়। এর মধ্যে বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের আসনও রয়েছে। বিশেষ করে সিলেট-১ আসনে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমানের ব্যাপারে তারা ছাড় দিতে নারাজ।
উল্লেখ সিলেট-১ আসন বাংলাদেশের রাজনীতিতে অন্যরকম গুরুত্ববহন করে। ১৯৯১ সালের নির্বাচন থেকে যারাই ওই আসনে জিতেছে তারাই সরকার গঠন করেছে। অন্যদিকে বিএনপির দায়িত্বশীল নেতাদের অনেকেই চাচ্ছেন যা হওয়ার এখনই হোক। সংসদ নির্বাচনের আগে ঝামেলা দলের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে।
এদিকে জোটের বৈঠকে একক প্রার্থী দেওয়ার সিদ্ধান্তের পরও জামায়াতের প্রার্থীরা ঢাকাসহ ছয়টি সিটি করপোরেশনে একাই নির্বাচনী তৎপরতা চালাচ্ছে। আদালতের আদেশে স্থগিত হওয়া ঢাকা সিটি করপোরেশনেও প্রার্থী ঘোষণা করে তারা। যদিও জামায়াতের নেতারা নিজেরাই স্বীকার করেছেন ঢাকা শহরে নির্বাচন করে জেতার মতো অবস্থান তাদের নেই। ভোটের ইতিহাসও তাই বলে। ঢাকায় ভোটের সংখ্যায় জামায়াতের অবস্থান কখনও শক্তিশালী ছিল না। ১৯৯৪ সালে ঢাকা সিটির প্রথম নির্বাচনে জামায়াত প্রার্থী যুদ্ধাপরাধের দায়ে বর্তমানে কারাবন্দী এটিএম আজহারুল ইসলাম ৩০ হাজার ভোট পেয়েছিলেন। ১৯৯৬ সালের সপ্তম সংসদ নির্বাচনে ঢাকা মহানগরের আটটি আসনের একটিতেও পাঁচ হাজারের বেশি ভোট পাননি জামায়াতের প্রার্থীরা। ’৯৬ সালের পর দীর্ঘদিন ঢাকায় সংসদ কিংবা স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নেয়ার সাহসই করেনি এই দলটি। দলটির নেতারাও স্বীকার করেছেন ভোটে ঢাকায় এবারও তাদের ভালো করার সম্ভাবনা নেই। জাতীয় পার্টি না থাকলে বড়জোর তৃতীয় স্থান অর্জন করতে পারবেন জামায়াত প্রার্থী। তারপরও প্রার্থী ঘোষণা ও তা নিয়ে অনঢ় অবস্থানে থাকাকে ভিন্নভাবেই দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা মনে করে জামায়াত জোটে থেকে নিজেদের সুবিধা আদায় কিংবা দর কষাকষি করতে চায়। অন্যদিকে সরকারের ঈশারায় ২০ দলীয় জোটের প্রার্থীকে বিপদে ফেলেতে চায়।
ঢাকায় নির্বাচন স্থগিত হলেও আগামী কয়েক মাসের মধ্যে সিলেট, রাজশাহী, গাজীপুর ও খুলনায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এসব সিটির মধ্যে ইতোমধ্যে সিলেট ও গাজীপুরে প্রার্থী ঘোষণা করে মাঠে নামিয়ে দিয়েছে দলটি। সিলেটে এহসানুল মাহবুব জুবায়ের ও রাজশাহীতে অধ্যক্ষ সিদ্দিক হোসাইনকে। আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এই বছরে স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে অংশ নিয়ে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট যেখানে বিজয়ী হয়ে জনপ্রিয়তার প্রমাণ দেখাতে চায়। সেখানে জামায়াতের এমন অবস্থানে সন্দেহের দানা বেধেছে ওইসব এলাকার নেতাকর্মীদের মধ্যেও। বিশেষ করে বিভিন্ন নির্বাচনের আগে পক্ষ বদল করা জামায়াতের অতীত চরিত্রের কারণেই তাদের মধ্যে বাড়ছে সন্দেহ ও সংশয়। তবে দলটির সূত্রে জানা যায়, শুধু দর কষাকষির জন্য মেয়র হিসেবে প্রার্থিতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এক্ষেত্রে মেয়র প্রার্থী হিসেবে জোটের মনোনয়ন না পেলেও কাউন্সিলর প্রার্থী নিয়ে এগোনো যাবে।
বিএনপি সূত্রে জানা যায়, সিলেটে মেয়র পদে জোটের সমর্থন পেতে ঢাকায় প্রার্থী দিয়ে বিএনপির ওপর চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করছে জামায়াতে ইসলামী। দলটির নেতারা নিশ্চিত করেছেন যে তাদের লক্ষ্য ঢাকা নয়, সিলেট।
বিএনপির নেতারা জামায়াত নিয়ে কথা বলতে একেবারেই নারাজ। তবে এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, এসব নিয়ে আমরা এখনো চিন্তা করছি না। সময় হলে আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। বিএনপি জোটকে চাপে রেখে দাবি আদায় করার চেষ্টা হচ্ছে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, সময় হলেই সব বোঝা যাবে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, জামায়াত আলাদা একটি রাজনৈতিক দল। সে হিসেবে তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত থাকতেই পারে। তবে জোটগতভাবে যখন সিদ্ধান্ত নেয়া হবে তখন সবাই মিলেই সেটা বাস্তবায়ন করা হবে।
বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম আজাদ কথা প্রসঙ্গে বললেন, জামায়াত যেহেতু ২০দলীয় জোটে আছে সেহেতু জোটের বাইরে কোন সিদ্ধান্ত নেবে না বলে আমরা বিশ্বাস করি। চলমান রাজনীতির বাস্তবতার আলোকেই জোট যে সিদ্ধান্ত নেবে সেটাই তারা বাস্তবায়ন করবে। আর সরকারের এই ডাউন পয়েন্টে আওয়ামী লীগকে ওভার দেওয়ার মতো কোন আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত জামায়াত নেবে বলে আমরা মনে করি না।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন