হামলা আতঙ্কে শোলাকিয়া ময়দানে এবার ‘সর্বোচ্চ নিরাপত্তা’
এক বছর আগের জঙ্গি হামলার কারণে এবার দেশের সবচেয়ে বড় জামাত স্থল কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় ময়দানকে ঘিরে ব্যাপক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী একে ‘সর্বোচ্চ নিরাপত্তা’ বলছে। শহরজুড়ে সন্দেহভাজন এলাকায় চলছে তল্লাশি ও নজরদারি। ঈদের দিন শহরে যান্ত্রিক যানবাজন বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
২০১৬ সালের ঈদুল ফিতরের জামাতের আগে আগে ময়দানের বাইরে পুলিশের তল্লাশি চৌকিতে হামলা করে দুই জঙ্গি। তারা ময়দানের ভেতরে ঢুকে নাশকতার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু দুই পুলিশ সদস্য জীবন দিয়ে ঠেকিয়ে দেন সে চেষ্টা।
এর এক বছর পরও রয়ে গেছে সেই হামলার রেশ। নিরাপত্তা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ এখনও স্পষ্ট। তবে এর মধ্যেই মাঠকে বর্ণিল সাজে সাজিয়েছে জেলা প্রশাসন ও পৌরসভা। শহরের বিভিন্ন সড়কে বড় বড় তোরণ নির্মাণ ও সড়কদ্বীপগুলো বর্ণিল ব্যানারে সাজানো হয়েছে। ঈদ উদযাপন উপকমিটি, পৌর কর্তৃপক্ষ, বিভিন্ন সরকারি সংস্থা ও প্রশাসনের উদ্যোগে মাঠ পরিষ্কার, মাঠের মেহরাবের চুনকাম, মাঠে দাগ কাটা, অজুখানা পরিষ্কার, নলকূপ বসানোসহ আনুষঙ্গিক কাজ শেষ করা হয়েছে।
স্থানীয়রা বলেন, প্রায় দুইশ বছর আগে শোলাকিয়া ময়দানের জামাতে সোয়া এক লাখ মানুষ ঈদের জামাত আদায় করেছিলেন বলে ময়দানের নাম হয় শোয়ালাখিয়া। পরে এক পর্যায়ে নাম হয় শোলাকিয়া।
আধুনিক যুগে এই ময়দানে জামাত আদায়ের খবর ছড়িয়েছে আরও, সেই সঙ্গে বাড়ছে মুসল্লির সংখ্যা। ময়দান ছাড়িয়ে আশেপাশের কয়েক কিলোমিটার সড়ক ও খোলা জায়গায় প্রতি বছর জামাত আদায় করে মুসল্লিরা।
ময়দান ও এর আশপাশের এলাকায় বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। ছুটি বাতিল করা হয়েছে জেলার সব পুলিশ সদস্যের।
মাঠে তৈরি করা হয়েছে র্যাব ও পুলিশের জন্য নয়টি পর্যবেক্ষণ চৌকি, মাঠের ভেতর ও বাইরে স্থাপন করা হয়েছে ৫০টি সিসি ক্যামেরা, খোলা হয়েছে অস্থায়ী নিয়ন্ত্রণ কক্ষ।
গত বুধবার থেকে কিশোরগঞ্জ শহরের আবাসিক হোটেল, ছাত্রাবাসসহ স্পর্শকাতর স্থানগুলোতে পুলিশি তল্লাশি ও বিশেষ নজরদারিতে রাখা হচ্ছে। শুক্রবার শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানে অস্থায়ী তাঁবু (ক্যাম্প) করে মাঠের সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়েছে পুলিশের একটি দল।
এবার ময়দানে ১৯০তম জামাতে ইমামতি করবেন বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ফরিদউদ্দীন মাসউদ। সকাল ১০টায় হবে জামাত। এতদিন জামাত শুরুর সাত, পাঁচ ও এক মিনিট আগে ফাঁকা গুলির মাধ্যমে সংকেত দেওয়া হলেও মুসুল্লিরা যেন আতঙ্কিত না হয়, সে জন্য এবার আর গুলি ছোড়া নাও হতে পারে।
জেলা প্রশাসক আজিমুদ্দিন বিশ^াস বলেন, ‘দেশের বৃহত্তম এ জামাত শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠানে যাবতীয় প্রস্ততি শেষ হয়েছে। ঈদের আগের দিন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা মুসল্লিদের থাকা-খাওয়া ও ইফতারের ব্যবস্থা থাকছে। এরই মধ্যে মাঠের সার্বিক নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। ২৫ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে সবক’টি চেকপোস্টে মোবাইল টিম নিয়োজিত করবে।’
জেলা প্রশাসক বলেন, ‘গত ঈদের দিনে জঙ্গি হামলার বিষয়টি প্রশাসন সাহসিকতা ও দক্ষতার সাথে মোকাবেলা করেছে। এবার ঈদে মাঠের নিরাপত্তার বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। প্রস্তত রয়েছে ১২০০ পুলিশ বাহিনী, পাঁচ প্লাটুন বিজিবি, শতাধিক র্যাব, ডিবি ও সিআইডির সাদা পোশাকধারী সদস্য।
পুলিশ সুপার আনোয়ার হোসেন খান বলেন, নিরাপত্তার জন্য বোমা শনাক্ত ও নিষ্ক্রিয়করণ দল শোলাকিয়া মাঠে মেটাল ডিটেক্টরের সাহায্যে বিশেষ অনুসন্ধান চলবে। নিরাপত্তা বলয় তৈরির জন্য পাঁচ প্লাটুন বিজিবি সদস্যের পাশাপাশি মাঠে আর্মড পুলিশ সদস্যরা প্রস্তুত থাকবে। এ ছাড়া নিরাপত্তা কর্মীরা মাঠের ২৮টি প্রবেশপথে হ্যান্ড মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে তল্লাশি করে মুসল্লিদের মাঠে প্রবেশ করতে দেবে।
ঈদের আগের দিন থেকে শহরে সব ধরনের যান্ত্রিক যান চলাচল বন্ধ রাখা হবে বলেও জানান পুলিশ সুপার। জানান, ডিবি পুলিশ ও র্যাব সদস্যরাও বিশেষ নজরদারি করবে।
গত বছরের জঙ্গি হামলার অপচেষ্টায় কান না দিয়ে দেশবাসীকে আগের মতই ময়দানে এসে জামাতে শরিক হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন কিশোরগঞ্জের পৌর মেয়র মাহমুদ পারভেজ। তিনি বলেন, মাঠে মাটি ভরাট, কাতারের জন্য দাগকাটা, আলোকসজ্জা, দৃষ্টিনন্দন তোরণসহ যাবতীয় প্রস্তুতি শেষ করেছে পৌরসভা।
রেলওয়ে জানিয়েছে, শোলাকিয়ায় মুসল্লিদের আসা-যাওয়ার সুবিধায় দুটি বিশেষ ট্রেন চলবে। শোলাকিয়া স্পেশাল সার্ভিস নামে একটি ট্রেন ময়মনসিংহ থেকে ঈদের দিন ভোর ৫টা ৫৫ মিনিটে ছেড়ে সকাল ৯টা ৫ মিনিটে কিশোরগঞ্জ পৌঁছবে। অন্যটি ভৈরব থেকে সকাল ৬টায় ছেড়ে সকাল পৌনে ৯টায় কিশোরগঞ্জ পৌঁছাবে। দুটি ট্রেনই দুপুর ১২টায় কিশোরগঞ্জ ছেড়ে যাবে।
সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও মাঠ পরিচালনা কমিটির সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল মাসউজ বলেন, মুসুল্লিদের যেন অসুবিধা না হয় সেদিক বিবেচনা করেই সকল প্রস্ততি আমরা শেষ করেছি। বাকিটুকু নির্ভর করছে প্রকৃতির ওপর।
গত বছরের ৭ জুলাই শোলাকিয়ার জামাতের প্রবেশপথ আজিমউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশের এলাকায় পুলিশের তল্লাশি চৌকিতে হঠাৎ হামলা হয়। দুই জঙ্গিরা গ্রেনেড ছুঁড়ে ও চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে আনসারুল ও জহিরুল নামে দুই পুলিশ সদস্যকে হত্যা করে। এ সময় পুলিশের পাল্টা গুলিতে প্রাণ হারান হামলাকারী আবির রহমান।
গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পিস্তলসহ পুলিশের হাতে আটক হন আরেক জঙ্গি শফিউল ইসলাম। চিকিৎসা শেষে তাকে কিশোরগঞ্জে আনার পথে ময়মনসিংহের নান্দাইলে জঙ্গিরা তাকে ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলে গোলাগুলিতে শফিউল ইসলাম ও তার সহযোগীর মৃত্যুর কথা জানিয়েছে পুলিশ।
জঙ্গি-পুলিশ গোলাগুলির সময় নিজ ঘরে গুলিবিদ্ধ হযে মারা যান গৃহবধু ঝরনা রাণী ভৌমিক। তার পরিবার ও এলাকাবাসীর মধ্যে এখনও রয়ে গেছে শোকের রেশ।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন