উদ্ধার না করে পালালো পুলিশ
দুর্ঘটনার পর আহত শিশুটিকে রাস্তায় ফেলেই চলে যান পুলিশের কর্মকর্তারা। যাওয়ার আগে গাড়িটিকেও চলে যেতে দেন। স্বজনেরা তখন ব্যস্ত শিশুটিকে নিয়ে, বাঁচাতে হবে। ছোটাছুটি করে স্থানীয় দুটি হাসপাতালে নিলেও কেউই চিকিৎসা দিতে রাজি হয়নি। অবশেষে তাঁরা যখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছান, ততক্ষণে সব শেষ। পরে জানা গেল, শিশুটিকে ধাক্কা দেওয়া গাড়িটি আসলে পুলিশেরই।
গত শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর দয়াগঞ্জ এলাকায় ঘটনাটি ঘটে। একটি সাদা ল্যান্ড ক্রুজার গাড়ির (ঢাকা মেট্রো-ঘ-১১-০৩৫৮) ধাক্কায় নিহত হয় মো. রাজ নামে ৯ বছরের এক স্কুলছাত্র। এ সময় ঘটনাস্থলে যাত্রাবাড়ী থানার এক উপপরিদর্শক পুলিশের একটি পিকআপসহ সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনিই ল্যান্ড ক্রুজার গাড়িটিকে সেখান থেকে চলে যেতে সাহায্য করেন। রাজের পরিবার যাত্রাবাড়ী থানায় ল্যান্ড ক্রুজার গাড়িটির নম্বর দেয়। কিন্তু পুলিশ এ ঘটনায় কোনো মামলা নেয়নি।
পুলিশের দায়িত্ব ও কর্তব্য যেখানে দুর্ঘটনাকবলিত মানুষকে উদ্ধার করা এবং দুর্ঘটনার তদন্ত করা, সেই পুলিশই দুর্ঘটনার পর শিশুটিকে উদ্ধার না করে পালানোয় তাদের দায়িত্বশীলতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। রাজের স্বজন ও এলাকাবাসী বলছেন, ঘটনাস্থলে পুলিশের দুটি গাড়ি ছিল। দুর্ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে তারা শিশুটিকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে হয়তো সে প্রাণে বেঁচে যেত।
গাড়ির নম্বরটি ধরে সড়ক যোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থায় (বিআরটিএ) যোগাযোগ করে প্রথম আলো। গাড়িটি পুলিশের মহাপরিদর্শকের (আইজি) নামে রেজিস্ট্রেশন করা। এরপর পুলিশ সদর দপ্তরের পরিবহন শাখা থেকে জানা গেল গাড়িটি ব্যবহার করছেন ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) গোলাম আজাদ খান। আর রাজের স্বজনেরা জানিয়েছেন, দুর্ঘটনার সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন যাত্রাবাড়ী থানার উপপরিদর্শক মো. রেদওয়ান খান।
ঘটনার দিন প্রথম আলোর পক্ষ থেকে যাত্রাবাড়ী থানায় যোগাযোগ করা হলে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনিসুর রহমান কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। পুলিশের ডেমরা অঞ্চলের সহকারী কমিশনার ইফতেখায়রুল ইসলাম গাড়িটি পুলিশের ছিল না বলে দাবি করেন। তিনি এ-ও জানান, পরিবার মামলা না করায় তাঁরা ঘটনাটি তদন্তও করবেন না।
গত বুধবার দয়াগঞ্জের বটতলা এলাকায় রাজদের নিজেদের বাড়িতে গিয়ে তার বাবা উন্নয়নকর্মী মো. হানিফকে পাওয়া যায়নি। ছেলে হারানোর শোকে মুহ্যমান তার মা-ও কোনো কথা বলতে রাজি হননি। পাঁচতলা বাড়িটির পুরোটাতেই রাজের আত্মীয়স্বজনেরা থাকেন। কিন্তু পুলিশের গাড়ির ধাক্কায় রাজের মৃত্যু নিয়ে তাঁরা কথা বলতে ইতস্তত করছিলেন। একধরনের আতঙ্ক কাজ করছিল তাঁদের মধ্যে।
রাজের দুর্ঘটনাটি হয়েছে তাদের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে। সায়েদাবাদ থেকে যে রাস্তাটি দয়াগঞ্জের দিকে চলে গেছে তার ওপর। সেখানে কথা হয় আহত অবস্থায় রাজকে উদ্ধার করে হাসপাতালের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ানো তার চাচা মো. সালামের সঙ্গে। প্রথম আলোকে সালাম বলেন, রাজকে নিয়ে তাঁরা প্রথমে স্থানীয় মদিনা মেডিকেলে যান। দুর্ঘটনা শুনে তারা কোনো চিকিৎসা দিতে রাজি হয়নি। এরপর সালাউদ্দিন স্পেশালাইজড মেডিকেলে নিয়ে গেলে সেখানেও একই কথা জানানো হয়। অনেকক্ষণ পর গাড়ির জ্যাম ঠেলে রাজকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। চিকিৎসকেরা ইসিজি করতে পাঠান। সেখান থেকে জানিয়ে দেওয়া হয় রাজ মারা গেছে।
মো. সালাম বলেন, দুর্ঘটনার পর আশপাশের লোকজন গাড়িটিকে থামান। এ সময় সেখানে উপস্থিত যাত্রাবাড়ী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. রেদওয়ান খান ‘বিষয়টি তিনি দেখছেন’ বলে এগিয়ে যান। গাড়িতে চালক ছাড়াও সাদাপোশাকের এক ব্যক্তি ছিলেন, যাঁর হাতে ওয়াকিটকি ছিল। রেদওয়ান তাঁর সঙ্গে কথা বলার পর গাড়িটি সেখান থেকে চলে যায়। এর কিছুক্ষণ পর রেদওয়ানও তাঁর থানার গাড়ি নিয়ে সেখান থেকে চলে যান।
সালামের সঙ্গে এই প্রতিবেদক যখন ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন, তখন এলাকার আরও কিছু লোক সেখানে জড়ো হন। তাঁরা সবাই একটা কথাই বলছিলেন, দুর্ঘটনা হতেই পারে। কিন্তু পুলিশ কর্মকর্তারা সঙ্গে সঙ্গে যদি শিশুটিকে নিয়ে হাসপাতালে যেতেন, তাহলে হয়তো শিশুটি বেঁচে যেত। কিন্তু তাঁরা তা না করে নিজেরাই পালিয়ে গেলেন।
রাজের আরেক চাচা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, থানায় পুলিশের গাড়ির নম্বর দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা গাড়িটি শনাক্ত করেনি। মামলা না করার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘উনারা বড় মানুষ। মামলা করেই-বা কী হবে। আমরা আর কোনো মামলা করব না।’
ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার শাহ মিজান শাফিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনাটি তদন্ত করতে ট্রাফিকের অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি বিষয়টি খতিয়ে দেখবে।
এ বিষয়ে কথা বলতে গতকাল দুপুরে যাত্রাবাড়ী থানায় গিয়ে উপপরিদর্শক রেদওয়ান খানকে পাওয়া যায়নি। থানা থেকে তাঁর মুঠোফোন নম্বর জোগাড় করে বহুবার যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তিনি ফোন ধরেননি। গত সোমবার রাতে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার গোলাম আজাদ খানকে ফোন করলে তিনি বলেন, ‘সেদিন আমি গাড়িতে ছিলাম না, এটা নিশ্চিত থাকতে পারেন।’ তবে গাড়িতে কারা ছিলেন এবং তাঁরা কেনই-বা শিশুটিকে হাসপাতালে নিয়ে যাননি, সে বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘আমি একটা মিটিংয়ে আছি। আপনাকে পরে ফোন দিচ্ছি।’ তবে পুলিশের এই কর্মকর্তা পরে আর কখনো ফোন দেননি। চেষ্টা করলেও তিনি ফোন ধরেননি।
জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক আইজি নূর মোহাম্মদ বলেন, দুর্ঘটনা কেউ ইচ্ছাকৃত করে না। তবে দুর্ঘটনা ঘটলে তার জন্য দেশে আইন আছে, পুলিশি ব্যবস্থা আছে। সেই আইনে ব্যবস্থা নিতে হবে। আর যদি পুলিশের দ্বারাই কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, তবে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি কিছু নৈতিক দায়দায়িত্বও এসে পড়ে। সমাজের মানুষ হিসেবে সে দায় কোনোভাবেই এড়ানো যায় না।
সৌজন্যে : প্রথম আলো
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন