উপজেলা নির্বাচন বর্জনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা বিএনপির
আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচন বর্জনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। তারা দলগতভাবে শুধু নির্বাচন বর্জনই করেনি, দলের কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হলে তাঁর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থাও নেবে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো উপজেলাও ‘একদলীয় ও ভোটারবিহীন’ নির্বাচন হিসেবে দেশ-বিদেশে প্রমাণ করতে চায় দলটি।
দলটির নেতারা জানিয়েছেন, মূলত পাঁচটি কারণে স্থানীয় পর্যায়ের এই নির্বাচন বর্জন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচনের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় শেষ হওয়ার পর সোমবার রাতে দলটির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভা থেকে উপজেলা নির্বাচনে বিএনপির কৌশল কী হবে তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনার ইতি টানে দলটি।
বৈঠকের সিদ্ধান্ত জানিয়ে গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী গণমাধ্যমে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠান।এতে দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটি বলেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে কোনো সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন হতে পারে না। তাই এই নির্বাচন বর্জন করবে বিএনপি।
বৈঠক সূত্র জানায়, শুধু নির্বাচন বর্জন করে ক্ষান্ত থাকছে না বিএনপি। এই নির্বাচনে প্রার্থী হতে দলের নেতাদের নিরুৎসাহ করা হবে।প্রথম ধাপের নির্বাচনে যাঁরা প্রার্থী হয়েছেন তাঁদের এরই মধ্যে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে দলের জ্যেষ্ঠ নেতারাও প্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলবেন। তার পরও যদি কেউ দলের নির্দেশ অমান্য করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন, তাঁর ব্যাপারে নমনীয় থাকবে না দল।
এত দিন দলগতভাবে নির্বাচন বর্জনের অবস্থানে থাকলেও নেতাদের মধ্যে যাঁরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে চান তাঁদের বিষয়ে নমনীয় থাকার পরামর্শ ছিল জ্যেষ্ঠ নেতাদের। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে পথে হাঁটেননি দলের নীতিনির্ধারকরা।
বিএনপির একাধিক দায়িত্বশীল নেতা জানান, উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে স্থায়ী কমিটির বৈঠকের আগে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দলের ভাইস চেয়ারম্যান, যুগ্ম মহাসচিব, সাংগঠনিক সম্পাদক, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যানসহ ২৬৮ জন নেতার সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁদের মধ্যে ২৫৮ জনই নির্বাচন বর্জনের পক্ষে মত দেন।
এ বিষয়ে দলের সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স কালের কণ্ঠকে বলেন, যাঁরা দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করবেন তাঁদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত পাঁচটি বিষয় সামনে রেখে নির্বাচন বর্জন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। প্রথমত, দলের নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আদলে উপজেলা নির্বাচন করবে সরকার। এ জন্য দলীয় নেতাদের প্রতীক দেয়নি আওয়ামী লীগ। উন্মুক্ত মাঠে আওয়ামী লীগ নেতারা সবাই স্বতন্ত্র প্রার্থী। মূলত দেশ-বিদেশে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখাতে এই আয়োজন করা হলেও নিয়ন্ত্রণ থাকবে সরকারের হাতে। সরকার যাঁকে ইচ্ছা তাঁকে নির্বাচিত করে আনবে। এই নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করলে তাতে ভোটের প্রক্রিয়াকে বৈধতা দেওয়া হবে।
দ্বিতীয়ত, মাত্র তিন মাস আগে জাতীয় নির্বাচন বর্জন করেছে বিএনপি। সেই নির্বাচনে বিএনপির ডাকে সাড়া দিয়ে দলের নেতাকর্মী, সমর্থক ও সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোটকেন্দ্রে যায়নি। সাধারণ মানুষের সেই সমর্থনে ‘আঘাত’ দিতে চায় না বিএনপি। জনগণের মাঝে বিএনপির নৈতিক অবস্থান সুদৃঢ় রাখতে বর্জনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
তৃতীয়, বিএনপি নির্বাচন বর্জন করার ফলে নির্বাচনে সাধারণ মানুষ ভোট দিতে যাবে না। ফলে উপজেলা নির্বাচনও নিষ্প্রভ হবে। দেশ-বিদেশে আবার বার্তা যাবে, বিএনপি ছাড়া নির্বাচন ও গণতন্ত্র অর্থহীন।
চতুর্থত, নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মুখোমুখি হবে আওয়ামী লীগ। ফলে মাঠ পর্যায়ে ব্যাপক সংঘর্ষ হতে পারে। আওয়ামী লীগের সেই সংঘর্ষে বিএনপি কোনো প্রতিপক্ষ হতে চায় না।
পঞ্চমত, সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দল ও যুগপৎ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর মধ্যে ঐক্য অটুট রাখার বিষয়টিও বিবেচনায় রাখছে বিএনপি। সরকারবিরোধী অন্য রাজনৈতিক দলও নির্বাচন বর্জনের পক্ষে ছিল। এ জন্য জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও বিএনপির অনুরোধে পরে অবস্থান বদল করেছে। তারা তাদের প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের নির্দেশ দিয়েছে বলে জানিয়েছেন জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল হালিম।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার বিষয়টি তাঁদের দলের আগের সিদ্ধান্ত। তাঁরা সেই অবস্থানেই অটল থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
তিনি বলেন, সরকারবিরোধী দীর্ঘ আন্দোলন ও ৭ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সারা দেশে তাঁদের লাখ লাখ নেতাকর্মী মামলায় জর্জরিত। ২৭ হাজারেরও বেশি কারাগারে গেছেন। ফলে তৃণমূলের কর্মীরা নতুন করে মামলা বা নির্যাতনের মুখোমুখি হতে চান না। উপজেলা নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে এই পরিস্থিতি অগ্রাধিকার পেয়েছে।
বিএনপির সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘স্থায়ী কমিটির সভায় নির্বাচন কমিশন ঘোষিত উপজেলা চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচনের বিষয়ে আলোচনা হয়। সভা মনে করে, এর আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন বিষয়ে দলের যে সিদ্ধান্ত সেটি পরিবর্তনের কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। সভা মনে করে, এই অবৈধ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হতে পারে না।
সুতরাং এই উপজেলা নির্বাচনে দলীয়ভাবে অংশগ্রহণের কোনো সুযোগ নেই। তাই সহিংস সন্ত্রাসের ব্যাপক বিস্তারের ফলে এই অবৈধ সরকারের অপরাজনীতি ও নির্বাচনী প্রহসনের অংশীদার না হওয়ার বিষয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বিএনপি আগামী ৮ মে থেকে শুরু হওয়া সব ধাপের উপজেলা পরিষদ নির্বাচন বর্জন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।’
বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তর থেকে গতকাল উপজেলা নির্বাচন বিষয়ে দলের অবস্থানের কথা চিঠি দিয়ে সারা দেশের জেলা কমিটিকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে খুলনা জেলা বিএনপির সদস্যসচিব এস এম মনিরুল হাসান বাপ্পী জানিয়েছেন, দলের পদবিধারী কেউ যাতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করেন এবং প্রথম ধাপের নির্বাচনে যাঁরা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন তাঁদের তা প্রত্যাহার করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
প্রথম ধাপের ১৫০টি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে কমবেশি বিএনপির ৪৫ জন নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের সময় শেষ হবে ২২ এপ্রিল। বিএনপি মনে করছে, প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচনে বিএনপির যে ৪৫ জন নেতা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন, এই সংখ্যাটা বেশি নয়। তাঁরা নির্ধারিত সময়ের আগেই মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেবেন।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন