কল্পনা চাকমা অপহরণের ২৭বছর উপলক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রামে দুই পাহাড়ি নারী সংগঠনের সমাবেশ ও র‌্যালি

পার্বত্য চট্টগ্রামে দুই পাহাড়ি নারী সংগঠনের সমাবেশ ও র‌্যালি অনুষ্ঠিত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি নারী নেত্রী কল্পনা চাকমার চিহ্নিত অপহরণকারী লে. ফেরদৌস গঙদের বিচার ও সাজা নিশ্চিত করতে ‘নতুন সংবিধান’ ও ‘জনগণের সরকার’ দাবি করে চট্টগ্রাম নগরীতে সমাবেশ ও র‌্যালি করেছে পাহাড়ি দুই নারী সংগঠন হিল উইমেন্স ফেডারেশন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘ।

শুক্রবার(৯ই জুন ২০২৩) বিকেল ৪টায় নগরীর ডিসি হিল থেকে একটি র‌্যালি বের করা হয়। র‌্যালিটি প্রেস ক্লাব ঘুরে চেরাগি পাহাড় মোড়ে এসে সমাবেশের মধ্যে দিয়ে শেষ হয়। কল্পনা চাকমা অপহরণের ২৭বছর উপলক্ষে এই কর্মসূচির আয়োজন করা হয়।

সমাবেশে পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের সভাপতি কনিকা দেওয়ানের সভাপতিত্বে ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক রিতা চাকমার সঞ্চালনায় আরো বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ ট্রাস্ট এর চেয়ারম্যান ডা. মাহফুজুর রহমান, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল চট্টগ্রাম পূর্ব—৩ অঞ্চলের সভাপতি এডভোকেট ভূলন ভৌমিক, বাংলাদেশ নারী মুক্তি কেন্দ্রের সংগঠক আসমা আকতার, গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিল চট্টগ্রাম মহানগরের এ্যানি চৌধুরী, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর আবিদ ইসলাম এবং হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সভাপতি নীতি চাকমা প্রমুখ। এতে আরো সংহতি জানিয়েছেন বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ কেন্দ্রীয় সহ—সভাপতি সুনীল ত্রিপুরা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম চট্টগ্রাম মহানগরের নেতা শুভ চাক।

সমাবেশে ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন, আমরা স্বাধীন হয়েছি ঠিকই কিন্তু দেশের শাসন ব্যবস্থা, সরকার ব্যবস্থা এমনভাবে তৈরী করা হয়েছে যেখানে সকল সামরিক—বেসামরিক আমলারা রাজার মতো জনগণের ওপর যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। আজকে আপনারা কল্পনা চাকমা অপহরণের বিচারের দাবিতে সমাবেশ করছেন। এই জ্বলজ্যান্ত দেশে লক্ষাধিক লোককে বিনা বিচারে নিহত হতে হয়েছে। তাদের কোন বিচার হয় নাই। আজকে পার্লামেন্টের এমপি, মন্ত্রী, ডিসি, সেনা প্রধান থেকে শুরু করে সকলকেই জনগণের সেবা করার জন্যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, আমাদের উপর খবরদারি করার জন্য নয়। দেশের জনগণের উপর দমন—পীড়ন বন্ধ করতে হলে সকলকে একযোগে আন্দোলন সংগ্রাম করে যেতে হবে।

ভূলন ভৌমিক বলেন, বাংলাদেশ একটি লুঠতরাজ, চোর ও ডাকাতের দেশ হয়ে গেছে। বর্তমান শাসকগোষ্ঠী স্বাধীনতার কথা বলে, উন্নয়নের কথা বলে জনগণের সম্পদ লুটপাট করছে। কাজেই এই শাসকশ্রেণি যতক্ষণ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবে ততদিন পাহাড়ি জনগণ নিরাপত্তায় বসবাস করতে পারবে না। দেশের সমগ্র জনগণের গণতান্ত্রিক লড়াই—সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে এই স্বৈরাচারী শাসকশ্রেণিকে উৎখাত করতে হবে।

আসমা আকতার বলেন, ২৭বছরের মধ্যে অনেক সরকারের ক্ষমতার পালাবদল ঘটেছে কিন্তু কল্পনা চাকমা অপহরণের বিচার হয়নি। সেনা মদদপুষ্ট সেটলার বাঙালিদের দ্বারা পাহাড়ে আজ সর্বত্র পাহাড়ি জনগণ নিপীড়নের শিকার হচ্ছে।

তিনি আরো বলেন, পাহাড়ের সাধারণ মানুষের উচ্ছেদ করে, তাদের পূর্ব পুরুষদের ভিটেমাটি দখল করে সেনাশাসন চলতে দেয়া যাবে না। তিনি অবিলম্বে কল্পনা অপহরণকারী লে. ফেরদৌস গঙদের বিচারের কাঠগড়ায় নিয়ে আসার দাবি জানান।

এ্যানি চৌধুরী বলেন, পাহাড়িদের দমন—পীড়নে সেনাবাহিনী এতই তৎপর অথচ কল্পনা চাকমা অপহরণের ২৭বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো বিচারের কোন তৎপরতা দেখা যায়নি।

আবিদ ইসলাম বলেন, পাহাড়িদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদের ষড়যন্ত্র বজায় রেখে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাশাসন জারী রাখা হয়েছে। তিনি অবিলম্বে কল্পনা চাকমা অপহরণকারীদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসার দাবি করেন।

নীতি চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারাদেশে আজ নারীদের নিরাপত্তা বিঘি্নত হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে চলতি বছরে এ পর্যন্ত অন্তত: ১১জনের অধিক নারী ধর্ষণ ও ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছেন। গত ২৭শে মে রাঙামাটি জুরাছড়িতে এক পুলিশ সদস্য কর্তৃক চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী ধর্ষণের চেষ্টা ও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে। এছাড়া ২০১সালের ২১শে জানুয়ারি দিবাগত রাতে রাঙামাটির বিলাইছড়িতে সেনা সদস্য কর্তৃক দুই মারমা বোন ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির শিকার হয়। একইভাবে ২০১৬সালে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে তনু ধর্ষণ ও হত্যা, ২৭শে জুন/২২ খাগড়াছড়ির ভাইবোন ছড়ায় সেনা মদদপুষ্ট নব্যমুখোশ কর্তৃক এক নারীকে ধর্ষণ ও ১০ই মে ২৩ লক্ষীছড়িতে এসএসসি পরিক্ষার্থীকে ধর্ষণ করা হয়েছে। কোনটাই এখনো বিচার হয়নি।

সভাপতির বক্তব্যে কণিকা দেওয়ান বলেন, সরকার ও দুর্নীতিগ্রস্ত সেনা কর্মকর্তা লে. ফেরদৌসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার কারণে ১৯৯৬সালে ১২ই জুন ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাত্র ৭ঘন্টার পূর্বে কল্পনা চাকমাকে অপহরণের শিকার হতে হয়েছে। আজ কল্পনা চাকমা অপহরণের ২৭বছর অতিক্রান্ত হলেও এখনো অপহরণকারীদের বিচারের আওতায় আনা হয়নি। এই রাষ্ট্র ও ফ্যাসিবাদী সরকার—শাসকগোষ্ঠি কল্পনা চাকমার অপহরণকারীদের বিচার ও সাজা দেয়ার সাহস পায় না। তাই কল্পনা চাকমার চিহ্নিত অপহরণকারী লে. ফেরদৌস গঙদের বিচার ও সাজা নিশ্চিত করতে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের সাধারণ জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য দরকার নতুন সংবিধান ও জনগণের সরকার কায়েম করা।

তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের নারীসহ দেশের শ্রেণি, পেশাজীবী ও জাতিসত্তার জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ‘নতুন সংবিধান’ ও ‘জনগণের সরকার’ কায়েমের জন্য পাহাড় ও সমতলের সকল প্রগতিশীল শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানান।
সমাবেশ থেকে নিম্নোক্ত দাবিগুলো উত্থাপন করা হয়—১. শুনানির নামে কালক্ষেপণ না করে অবিলম্বে কল্পনা চাকমা অপহরণকারী লে. ফেরদৌসসহ তার সহযোগিদের গ্রেফতার, বিচার ও সাজা নিশ্চিত করতে হবে। ২. পার্বত্য চট্টগ্রামে এ যাবত সংঘটিত সকল নারী ধর্ষণ—নির্যাতনের বিচার করতে হবে। ৩. পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি বেদখল ও পাহাড়ি উচ্ছেদের ষড়যন্ত্র বন্ধ ও ১১বম খুনের ঘটনা নিরপেক্ষ তদন্ত করে খুনীদের গ্রেফতার ও বিচার করতে হবে। হিল উইমেন্স ফেডারেশন কেন্দ্রীয় সদস্য এন্টি চাকমা স্বাক্ষরিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।