ছোট্র এক শহরে হঠাৎ করে সবাই যেভাবে ধনী হয়ে গেলো

রুমানিয়ার এক ছোট শহর বুজেস্কুতে বাস করত একদল পরিযায়ী মানুষ। কারাভাঁ নিয়ে শহর থেকে শহরে, দেশ থেকে ভিনদেশে ঘুরে ঘুরে ধাতব পণ্যসামগ্রী বিক্রিই ছিল তাদের জীবিকার উপায়। কমিউনিজমের পতনের পর সেই মানুষগুলো হঠাৎ বিপুল বিত্তের অধিকারী হয়ে গেল। কিভাবে বিদেশী পত্রিকা অবলম্বনে সে কাহিনী লিখেছেন ঐশী পূর্ণতা

তার হাত দুটো বিশাল বপুর ওপর আড়াআড়ি করে রাখা। মাথায় খড়ের তৈরি মুকুট ধরনের একটা কিছু। বসে ছিল একটা বেঞ্চের ওপর। বসে বসে সামনের দিকে তাকিয়ে কী যেন দেখছিল।

রুমানিয়ার রাজধানী বুখারেস্ট থেকে ৫০ মাইলের মতো দূরে এক গ্রামের দৃশ্য এটি। গ্রাম হলে হবে কী, তাতে নেই কোনো কুঁড়েঘর। বরং চার পাশে সব প্রাসাদোপম ভবন। ভবনের বহির্ভাগে তরঙ্গায়িত ব্যালকনি ও পিলার। প্রাসাদশৃঙ্গে হয় টাওয়ার নতুবা গম্বুজ। গ্রামের রাস্তা দিয়ে মাঝে মাঝেই ছুটে যাচ্ছে ঝাঁ-চকচকে নতুন গাড়ি। এই না-গ্রাম না-শহর এলাকাটির নাম বুজেস্কু। গোটা ইউরোপের মানচিত্রে এমন জায়গা আর একটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি। এখানে বসত করে ধনাঢ্য রোমা-রা।

শুরুতে যে লোকটার কথা বলেছি, তার নাম পারাচিভ। সেও একজন রোমা। রুমানীয় ভাষায় রোমা শব্দের অর্থ ‘মানুষ’। কিন্তু পারাচিভ বা তার স্বজাতির কেউই নিজেদের ‘রোমা’ বলে পরিচয় দেয় না। তারা নিজেদের বলে ‘সিগানি’। এর অর্থ যাযাবর বা জিপসি। দেশটির অন্যান্য গোত্রের লোকেরা ‘সিগানি’ বলতে বোঝে ভিখারী, চোর, অকর্মা এবং অন্য আরো কুৎসিত শব্দ। মনে করা হয় ‘জিপসি’ শব্দটি এসেছে ইজিপ্ট বা মিসর থেকে। এই গোত্রটির আদি বাসভূমি যেখানে। কিন্তু ভাষার দিক দেখলে বোঝা যায়, রোমারা এসেছে ইন্ডিয়া বা ভারত থেকে।

‘ধনাঢ্য রোমা’ এ কথাটিই একসময় ছিল এক নিষ্ঠুর কৌতুকের মতো। তারা ছিল গরিব ও নোংরা। বাস করত শহরের ধারে গড়ে ওঠা কোনো বস্তিতে; কার্ডবোর্ডের ঘরে। পূর্ব ইউরোপের অন্য সব দেশের মতো রুমানিয়ার রোমারাও চিরদরিদ্র। শিক্ষা-দীক্ষার সাথে তাদের কোনো সম্পর্কই ছিল না। যদিও দেশটির জনসংখ্যার এক-দশমাংশ অর্থাৎ ২০ লাখ তারা।

তবে ওই অবস্থা এখন আর বেশির ভাগ রোমা বা সিগানির জন্য প্রযোজ্য নয়। তাদের অনেকেই এখন বিলাসবহুল ও বহুতল ভবনের মালিক। এরকম একজন হচ্ছেন পারাচিভ। তার আছে একটি দোতলা ভবন। বেঢপ আকৃতির ভবনটির দেয়াল ধূসর ও সাদা মারবেল পাথরের। আর কোনায় কোনায় ব্যালকনি। ১৯৯৬ সালে যখন রোমারা ব্যাপক হারে ধনী হতে এবং ভবন বানাতে শুরু করে, সেই প্রথম দিককার ভবন এটি। এর চূড়ায় রয়েছে টিনে ছাওয়া একটি টাওয়ার। পারাচিভের দুই ছেলে লুইজি ও পেটুর কিন্তু বাবার তৈরি বাড়িটি একটুও পছন্দ নয়। তারা এটি ভেঙে ফেলে নতুন আরেকটি বাড়ি বানাতে চায়; হাল ফ্যাশানের বাড়ি। তাদের বাবা পারাচিভের এ নিয়ে তেমন মাথাব্যথা নেই। তার কথা : ছেলেরা যদি চায়, করুক!

দোতলা বাড়ি হিসেবে পারাচিভের বাড়িটি তো তবুও সাধাসিধে। শহরের দক্ষিণ ভাগের বাড়িগুলো দেখলে চোখে ধাঁধা লেগে যাওয়ার মতো। একেকটা একেক রকম। কোনোটা দেখলে মনে হবে বুঝি বা স্মৃতিসৌধ। কোনো আবার করপোরেট হেড কোয়ার্টারের মতো; কাচের দেয়ালশোভিত। কোনো প্রাচীন অভিজাতদের প্রাসাদের মতো। ছাদের চার পাশে দেয়াল, তাতেও ছিদ্র করা। প্রাচীনকালে আক্রান্ত হলে এ ধরনের ছিদ্র দিয়ে গুলি বা তীর নিক্ষেপ করা হতো।

এরকম প্রায় এক শ’ বাড়ি আছে ওই শহরতলীতেই। রোমারা সবাই যে ধনী তা নয়। তবে সবাই এতটুকু স্বচ্ছল অন্তত, যাতে তাদের জাতিগত অহঙ্কারটা ফুটে ওঠে।

এসব এলাকায় বাইরের কেউ গেলে তার মনে হবে, রোমারা বুঝি তাদের ঐশ্চর্য প্রদর্শনের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। আসলে ব্যাপারটা কিন্তু সেরকম নয়। ধনাঢ্য রোমারা এসবের খুব একটা পরোয়া করে না। বাইরের কেউ তাদের থামিয়ে কোনো প্রশ্ন করুক বা তাদের বাড়িঘরের ছবি তুলুক, শহরবাসী রোমারা এটা খুবই অপছন্দ করে এবং সেটা মুখের ওপর বলেও ফেলে। আমাকে দেখেই তো রোমা শিশুরা তারস্বরে চেঁচিয়েছে ‘প্লিকা, প্লিকা’ (চলে যাও, চলে যাও) আর যখনই আমি কথা বলতে গিয়েছি, বড়রা নিয়েছে মুখ ঘুরিয়ে। রোমা সমাজতত্ত্ববিদ গেলু ডুমিনিকা আমাকে সোজাসাপ্টা বলেছে, ‘এসব জায়গা তোমাদের জন্য নয়। (এখানে ‘তোমরা’ মানে রোমা নয় এমন যে কেউই)। এসব প্রাসাদ তারা বানিয়েছে নিজেদের দেখা ও দেখানোর জন্য।

প্রশ্ন হলো, চিরদরিদ্র রোমারা হঠাৎ এমন অঢেল সম্পদের মালিক হলো কিভাবে? স্থানীয় রোমা জনগোষ্ঠীর সরল জবাব : ‘ধাতু ব্যবসায়’। বুজেস্কু এলাকার বেশির ভাগ রোমাই বংশানুক্রমে কালদেরাশ (তাম্রকার)। তামার কাজই ছিল তাদের প্রধান বৃত্তি। ১৯৯০ সালের গোড়ার দিক পর্যন্ত এরা ঘোড়াচালিত কারাভাঁতে চড়ে চলে যেত দূর-দূরান্তে। পথে যত শহর পড়ত, সবখানে থামত আর বিক্রি করত কাজানে নামে। তামার তৈরি এক ধরনের পাতনযন্ত্র, যার সাহায্যে ফল থেকে মদ বানানো হয়। কাজানের দাম ছিল চড়া। ফলে পারাচিভের মতো কুশলী কারিগরদের কাছে এটা ছিল আকর্ষণীয় ব্যবসায়। একেকটা কাজানে বিক্রি হতো কয়েক শ’ ডলার দামে।তখন রুমানিয়ায় ছিল কমিউনিস্ট শাসন। সরকার রোমাদের দিকে কড়া নজর রাখত। এ কারণে টাকা-পয়সা থাকলেও তা প্রকাশ করত না ধনী রোমারা।

১৯৮৯ সালে রুমানিয়ায় কমিউনিস্ট শাসনের পতন ঘটে। আর তার পাশাপাশি রোমা কালদেরাশদের (তাম্রকার) ব্যবসায় বুদ্ধি হঠাৎ মুক্তির পথ খুঁজে পায়। এ সময় কাজানে কারিগর ও তাদের ছেলেপুলেরা ছড়িয়ে পড়ে রুমানিয়া এবং পূর্ব ইউরোপের সর্বত্র। বন্ধ হওয়া বিভিন্ন কারখানা থেকে বৈধ ও অবৈধ উপায়ে রুপা, তামা, অ্যালুমিনিয়াম, ইস্পাত ও মূল্যবান ধাতব যন্ত্রাংশ সংগ্রহ করতে থাকে দুই হাতে। এসব জিনিস চড়া দামে বিক্রি করে বুজেস্কুর একদল রোমা রাতারাতি বিপুল বিত্তের মালিক হয়ে যায়। এরকম একজনের নাম মেরিন নিকোলে। এক সময় কাজানে বানিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন তিনি। তার কথা : ওই সময় নানা ধরনের ধাতু কেনাবেচা করে নেহাত বোকারামও চার-পাঁচটি বাড়ির মালিক হতে পেরেছে।

বুজেস্কুর রাস্তায় রাস্তায় আমি এক সপ্তাহ ধরে অনবরত হেঁটেছি। চেষ্টা করেছি রোমাদের বাড়িতে যেতে এবং তাদের সাথে কথা বলতে। আমার সাথে ছিল দুই ফটোগ্রাফার কার্লা ও ইভান। তারা দুই মাস ধরে এখানে থেকে আসছে এবং সে কারণে কিছু মুখচেনা হয়ে গেছে। এই সূত্র ধরে তারা কখনো নাছোড়বান্দার মতো কোনো বাড়িতে ঢুকে পড়েছে, সেখানে বাড়ির লোকজনের ছবিও তুলতে পেরেছে। আর আমি অসহায়ের মতো বাড়ির সামনের গেটে দাঁড়িয়ে থেকেছি। কখনো কখনো কৌতূহল ও ভদ্রতাবশত বাড়ির মালিকেরা আমাকে ভেতরে ডেকে নিয়েছে।

বাড়ির ভেতরে আমি দেখেছি মারবেল পাথরের মেঝে ও দেয়াল। ছাদের সাথে ঝোলানো মূল্যবান ঝাড়বাতি। বেডরুমে যাওয়ার সিঁড়ি। নানা ধরনের খেলনা। কিন্তু এক ডজন বা তারও বেশি কক্ষবিশিষ্ট বাড়িগুলো প্রায়ই দেখেছি জনশূন্য। প্রায় বাড়িতেই বাস করে দাদা-দাদি ও জনাকয় ছোট ছেলেপিলে। তারাও থাকে বাড়ির পেছন দিককার রুমগুলোতে, খানাপিনা করে রান্নাঘরে। পরিবারের কর্তা-গিন্নি ও বড় ছেলেরা ব্যবসায় নিয়ে ব্যস্ত। তারা ছুটির দিনে, কারো ব্যাপ্টিজমের দিন কিংবা কেউ মারা গেলে তবেই বাড়ি আসে। এই বাড়িগুলো তাই ধনগর্বের শোরুম হয়েই দাঁড়িয়ে থাকে।

তাদের বাড়িগুলোর বহির্ভাগ এত কারুকার্যময় করার পেছনেও একটা কারণ আছে। তা হলো, বহুকাল ধরে চলে আসা তাদের সামাজিক প্রথা। আমি এক দিন ভিক্টর ফিলিসান নামে এক রোমার বাড়িতে ঢোকার সুযোগ পাই। তিনি আমাকে স্থানীয়ভাবে তৈরি দু’রকম মদ দিয়ে আপ্যায়ন করেন। কথাবার্তার এক ফাঁকে আমি টয়লেটে যেতে চাই। তিনি আমাকে বাড়ির বাইরে একটি টয়লেট দেখিয়ে দেন। গৃহকর্তা ও গিন্নি দু’জনেও এই টয়লেটই ব্যবহার করেন। অথচ তাদের বাড়ির ভেতরভাগে একটি সুসজ্জিত টয়লেট আমি দেখেছি। কিন্তু তারা সেটি ব্যবহার করেন না। কেন? জেনেছি, রোমা জনগোষ্ঠীর অনেকেই, বিশেষ করে প্রবীণেরা, ধর্মীয় বিধান অনুসারে পবিত্রতা রক্ষার স্বার্থে একই ছাদের নিচে রান্নাঘর ও টয়লেট থাকলে শেষেরটিতে যান না।

আর কয়েকটি বাড়িতে আমি দেখেছি বালক বয়সী স্বামী-স্ত্রী। পরে জেনেছি, রোমা অভিভাবকেরা তাদের ছেলেমেয়ে ১৩-তে পা দিলেই বিয়ে করিয়ে দেন। বিশেষ করে ধনাঢ্য পরিবারগুলোতে এটা খুবই সাধারণ ঘটনা।

এত কিছুর পরও এই সম্প্রদায়টি তাদের পরিযায়ী অতীত ভুলতে পারেনি। এই স্বভাবের কারণেই তাদের শহরটি সর্বদা থাকে মুখর। দেখা যায়, কোনো না কোনো পরিবার কারাভাঁ নিয়ে ছুটছে দেশান্তরেÑ স্পেন বা ফ্রান্সে, নিদেনপক্ষে বুখারেস্টের দিকে। প্রবীণের দল এখানে-ওখানে বসে সেই ফেলে আসা পরিভ্রমী দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করছে কী মধুর ও রোমাঞ্চকরই না ছিল সেসব দিন! আর ওদিকে শহরের প্রতিটি রাস্তার ধারে উঠছে নতুন নতুন ভবন। অথবা আরো মজবুত ও হালফ্যাশনের বাড়ি বানাতে পুরনোটা ভেঙে ফেলছে কেউ কেউ। এই শহরে, এই সম্প্রদায়ে কিছুই যেন স্থায়ী নয়, সবই যেন পরিভ্রমণশীল। শুধু তাদের পারিবারিক বন্ধনটাই অটুট, স্থায়ী।

ফ্লোরিন নামে এক রোমার সাথে কথা হচ্ছিল আমার। সে দম্ভভরে আমাকে বলল, ‘আমরা হচ্ছি রুমানিয়ার সবচেয়ে সভ্য জিপসি’। কিভাবে? সে বলে, ‘যদি আমরা সুন্দর কিছু দেখি, তবে আমরা তার চেয়েও সুন্দর কিছু পেতে চাই’।

কথাগুলো আমি বলেছিলাম রাডা নামে এক প্রবীণ বিধবাকে। এক সময় এই নারীও অট্টালিকায় বাস করতেন। এখন জীবনের শেষ দিনগুলো তাকে কাটাতে হচ্ছে একটি অপরিসর, অপরিচ্ছন্ন, পুরনো বাড়িতে। সেখানে তার চার পাশে মুরগিছানারা নির্ভয়ে ঘুরছে, সামনের দরজা দিয়ে ঢুকে রান্নাঘর পর্যন্ত চলে যাচ্ছে। আমার মুখে ফ্লোরিনের দাম্ভিক কথাগুলো শুনে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালেন রাডা। ভাবখানা, এই হাঁদারাম গাদজো (বহিরাগত) বলে কী! তারপর ধীর শান্ত গলায় বললেন, বাপু হে, কত উঁচু বিল্ডিং তুমি বানালে, সেটা তো কথা না। শেষ পর্যন্ত সবাইকে তো ওই কবরেই যেতে হবে।-নয়াদিগন্ত