রাজধানীর বস্তিতে চাঁদাবাজি আর আওয়ামী লীগের কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বে খুন
রাজধানীর কড়াইল বস্তিতে প্রায় ৪০ হাজার অবৈধ ঘর রয়েছে। এসব ঘর থেকে প্রতি মাসে ভাড়া, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানির জন্য ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা করে নিয়ে থাকে। সেই টাকা সরকারি কোষাগারের বদলে চলে যায় বিভিন্ন রাজনৈতিক গ্রুপের কাছে।
মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি কাদের খান ও ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিল মফিজুর রহমান গ্রুপের মধ্যে এই বস্তির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দ্ব থেকেই যুবলীগকর্মী আলামিন খুন হন।
খুনের মামলা তদন্ত করতে গিয়ে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) গুলশান বিভাগ এসব তথ্য জানতে পেরেছে।
গত ১৭ আগস্ট বস্তির মসজিদে ঢুকে আল আমিনকে (৩৪) হত্যায় জড়িত পাঁচজনকে গ্রেফতার ও ঘটনার তদন্ত নিয়ে বৃহস্পতিবার (২৫ আগস্ট) দুপুরে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন করেন ডিবির প্রধান মোহাম্মাদ হারুন অর রশীদ।
তিনি বলেন, কড়াইল বস্তিতে কমিটি গঠন এবং বিভিন্ন বিষয়ে চাঁদাবাজিতে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে খুনাখুনির ঘটনা ঘটছে। আলামিন হত্যায় পাঁচজনকে ২২ ও ২৩ আগস্ট রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। তারা পাঁচদিনের রিমান্ডে রয়েছে।
আল আমিন হত্যায় জড়িত গ্রেফতার পাঁচজন হলেন- মোহাম্মদ আলী, মো. খাজা, মো. আমজাদ হোসেন, মো. হুমায়ুন কবির রাসেল ও মাসুদ আলম। মারামারির কাজে ব্যবহৃত বড় ছোরা, চাপাতি ও ডিস্ক কুড়াল, লোহার রডসহ দেশি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে।
ডিবি জানিয়েছে, কড়াইল বস্তির বিভিন্ন ইউনিট আওয়ামী লীগের কমিটি গঠন এবং এর মাধ্যমে বস্তির ঘরভাড়াসহ অবৈধভাবে বিভিন্ন ইউটিলিটি সেবার অর্থ আদায় নিয়ন্ত্রণে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গত ১৭ আগস্ট রাতে বস্তির এরশাদ মাঠ এবং নূরানী মসজিদ এলাকায় নুরু-কবির-আলী গংয়ের সঙ্গে রিপন-জুয়েল-শুভ গংয়ের মারামারির ঘটনায় আলামিন মারা যায়। এছাড়া এই সংঘর্ষে উভয় পক্ষের প্রায় ১০ জন গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। আরও অনেকে আহত হয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা নেন।
ডিবি জানিয়েছে, মূলত টিঅ্যান্ডটি, গণপূর্ত ও ওয়াসার জমিতে অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে প্রায় ৪০ হাজার ঘর। এসব ঘর অবৈধভাবে নির্মাণ, বরাদ্দ এবং হস্তান্তরে মোটা অংকের চাঁদাবাজি হয়ে থাকে। ঘরগুলোতে অবৈধভাবে পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংযোগ দিয়ে লাখ লাখ টাকা চাঁদাবাজি চলে আসছে দীর্ঘদিন।
এছাড়া ডিস সংযোগ, ইন্টারনেট সংযোগ, ময়লা-বাণিজ্য প্রভৃতির নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেও টাকা তোলা হয়। রাজনীতির নাম ভাঙিয়ে বিভিন্ন ইউনিট কমিটি স্থানীয় নেতৃবৃন্দের ছত্রচ্ছায়ায় এ চাঁদার টাকা তোলে এবং ভাগ-বাটোয়ারা হয়।
ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদ বলেন, দুটি গ্রুপ এই চাঁদাবাজি করে থাকে। এই চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ নিয়েই প্রায় প্রতি বছর খুনাখুনি হচ্ছে। এসব হত্যাকাণ্ডে যাদেরই সম্পৃক্ততা পাওয়া যাবে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।
কড়াইল বস্তি মূলত ঢাকা মহানগর উত্তর সিটির ১৯ ও ২০ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যে অবস্থিত। যার ৯০ শতাংশ পড়েছে ১৯ নম্বর ওয়ার্ড এলাকার মধ্যে। মফিজুর রহমান এই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। কড়াইল বস্তির ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের সাতটি ইউনিটে আওয়ামী লীগের কমিটি গঠন নিয়ে দুইটি গ্রুপের বিবাদ চলে আসছে।
এই সাতটি কমিটির বেশিরভাগ পদে মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি কাদের খানের গ্রুপের প্রাধান্য থাকায় স্থানীয় কাউন্সিলর মফিজের গ্রুপের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়। কাউন্সিলর মফিজ গ্রুপের অনুসারীদের মধ্য থেকে শুধু একটি ইউনিটের সভাপতি এবং আরেকটি ইউনিটের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদ পেয়েছে। বাকিরা সব অন্য গ্রুপের।
ডিবি জানায়, নুর আলম নুরু কড়াইল উত্তর-২/দক্ষিণ ইউনিটের সহ-সভাপতি হওয়ায় এই এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করে এবং মফিজ গ্রুপের জসীমউদ্দীন রিপনকে সেক্রেটারি পদ না দিয়ে রফিকুল ইসলাম ওরফে রাজুকে সেক্রেটারি করায় কাউন্সিলর মফিজ গ্রুপের লোকজন ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।
দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় কাউন্সিলর মফিজ গ্রুপের নেতারা চাঁদাবাজির টাকা হাতিয়ে নেওয়ার প্রেক্ষাপটে নবগঠিত কমিটির নেতারা নতুন করে মাঠ দখলের অংশ হিসেবে নিয়মিত মহড়া করতে থাকে। গত ১৭ আগস্ট এশার নামাজের আগে কাদের খান গ্রুপের নুরু-আলী-কবির গ্রুপের মহড়ার এক পর্যায়ে তারা রিপন-জুয়েল গ্রুপের আওলাদকে সামনে পেয়ে মারধর করে।
অল্প সময়ের মধ্যে উভয় গ্রুপের লোকজন দেশীয় অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ব্যাপক সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এশার নামাজ চলাকালে নুরু গ্রুপের আমজাদ এবং ভাইস্তা মাসুদ নূরানী মসজিদে নামাজ পড়াকালীন রিপন-জুয়েল গ্রুপের লোকেরা মসজিদে গিয়ে তাদের প্রথমে জিআই পাইপ ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে পিটিয়ে, কুপিয়ে হাত ভাঙাসহ মাথা ও শরীরের বিভিন্ন জায়গায় জখম করে।
নুরুর নেতৃত্বে ভাইগ্না আলী, মোহাম্মদ আলী, কবির, আজিজুল, খাজা, আমজাদ গং আরও হিংস্র হয়েও উঠে একাধিক ঘর ও দোকান ভাঙচুর করে। নুরু ও কবির ছোরা এবং চাপাতি নিয়ে আলামিন এবং নাসিরকে হত্যার উদ্দেশ্যেই কুপিয়ে জখম করে। নাসির এবং আলামিন দৌড়ে মসজিদে প্রবেশ করলে সেখানেও তাদের আক্রমণ করে।
গুরুতর আহত আলামিন প্রথমে ভাঙারির দোকান এবং পরে এরশাদ মাঠের একটি ফার্মেসিতে ঢুকলে সেখানেও তাকে কুপিয়ে জখম করা হয়। হাসপাতালে যাওয়ার জন্য একটি রিকশায় উঠলে সেন্টু রিকশাচালককে মারধর করে। এ সময় খাজা এবং আমজাদ এসে আলামিনকে আবারও মারধর করে এবং হাসপাতালে যেতে বাধা দেয়। পরবর্তী সময়ে আলামিনকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাওয়ার পথে আলামিন মারা যায়।
লাখ লাখ টাকার চাঁদাবাজির এ নিয়ন্ত্রণ এবং আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ফিরে ফিরে একের পর এক সহিংসতা এবং হত্যার মতো ঘটনা ঘটে আসছে কড়াইল বস্তিতে। ২০১২ সালে কড়াইল বস্তির পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস সংযোগের অর্থ উত্তোলনের ক্যাশিয়ার বশির হত্যাকাণ্ড, ২০১৪ সালে একই কার্যক্রমে নিয়োজিত দুলাল সরদার হত্যাকাণ্ড, ২০১৮ সালে অবৈধ সংযোগের বিরুদ্ধে কথা বলতে যাওয়ার কারণে তিতুমীর কলেজের মাস্টার্সের ছাত্র রাকিব হোসাইন হত্যাকাণ্ড, ২০১৮ সালে একই ইস্যুতে নিহত হন রাশেদ কাজী নামে একজন। সর্বশেষ ২০২২ সালে আল আমিন হত্যার ঘটনা ছাড়াও আরও একাধিক হত্যাকাণ্ড এবং সহিংস ঘটনা ঘটে।
এসব বিষয়ে স্থানীয় কাউন্সিলর মফিজুর রহমান বলেন, আমার কোনো গ্রুপ নেই। সবাই আমার গ্রুপ। বস্তিতে এ ধরনের সমস্যা ছিল না। কাদের খান কমিটি দেওয়াকে কেন্দ্র করে এসব কাণ্ড ঘটেছে।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন