লোভের আগুনে পুড়ে ছাই শত প্রাণ : নিউইয়র্ক টাইমস
পুরনো ঢাকায় গত বুধবার রাতে প্রথম বিস্ফোরণের সময় রাস্তা লোকজনে ভর্তি ছিল। মার্কিন পত্রিকা নিউইয়র্ক টাইমসকে একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, সিএনজিচালিত একটি গাড়ি ঢাকার একটি বাজারের মধ্যদিয়ে যাওয়ার সময় সেটির পেছনে থাকা গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়।
বিস্ফোরণে গাড়িটি উল্টে যায়। এরপর রাস্তার পাশে থাকা কয়েকটি রেস্তোরাঁর সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়। তারপর কাছাকাছি একটি ভবনের নিচতলায় থাকা প্লাস্টিকের দোকানে আগুন ধরে যায়। এরপর অবৈধভাবে কেমিক্যাল মজুদ করে রাখার একটি গুদামে বিস্ফোরণসহ আগুন ধরে।
আগুনের দেয়াল রাস্তার এপার থেকে ওপার পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে সাইকেল, রিকশা, গাড়ি, মানুষ সব গিলে নেয়। বাংলাদেশের অন্যতম ঐতিহাসিক একটি এলাকায় অগ্নিকাণ্ডে নিহত হয় কমপক্ষে ৭০ জন।
একটি রেস্তোরাঁর ম্যানেজার মোহাম্মদ রাকিব নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, ‘অনেক মানুষ ওখান থেকে পালাতে চেষ্টা করছিল।’
তিনি একজন রিকশাচালককে আগুনের লেলিহান শিখার সঙ্গে পাল্লা দেয়ার চেষ্টা করে জীবন্ত পুড়তে দেখেন।
‘আমি এমন ভয় পেয়েছিলাম। আমি রেস্তোরাঁর ভেতর সব টাকা রেখেই বের হয়ে চলে আসি,’ যোগ করেন রাকিব।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এশিয়ার অন্যতম দরিদ্র দেশ বাংলাদেশ আয়তনে যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া রাজ্যের সমান। কিন্তু, ১৭ কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশের জনসংখ্যা আইওয়ার চেয়ে ৫০ গুণ বেশি। তবে, এই তথ্য থেকে কেবল আংশিক চিত্র পাওয়া যায়।
‘এটা আসলে দারিদ্র্যের বিষয় নয়,’ উল্লেখ করে ঢাকার একজন আর্কিটেক্ট নিজামুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আবাসিক ভবনে কেমিক্যাল মজুদ রাখছেন যারা তারা ধনী মানুষ, এদের গাড়ি আছে, সুন্দর বাড়ি আছে, এদের ছেলে-মেয়ে বিদেশে লেখাপড়া করে।’
‘এদের দরজায় কড়া নেড়ে এখন এখান থেকে দূর হয়ে যেতে বলা উচিত সরকারের। কিন্তু, ওরা তা করেনি,’ যোগ করেন তিনি।
বৃহস্পতিবার সকালে ফায়ার ব্রিগেড যখন আগুন নেভাতে থাকে, চকবাজার এলাকা দেখতে একটা যুদ্ধক্ষেত্রের মতো হয়ে যায়।
সব রঙ উবে গেছে, দরজা আধা খোলা অবস্থায় রয়েছে— এমন দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া গাড়ি পড়ে থাকতে দেখা যায়। পুড়ে যাওয়া ধাতুর টুকরো মাটিতে গেঁথে ছিল। দমকল বাহিনী ও স্বেচ্ছাসেবকরা মৃতদেহ পরিষ্কার সাদা ব্যাগের ভেতর বহন করে নিয়ে যায়।
তবে, দুঃখজনকভাবে এটা নতুন কোনো ঘটনা নয়। বাংলাদেশে আগুন ও নিরাপত্তাজনিত দুর্ঘটনা একটার পর একটা ঘটছেই।
২০১০ সালে ঢাকায় (পুরনো ঢাকার নিমতলী) একটি ট্রান্সফরমার বিস্ফোরিত হলে অবৈধভাবে কেমিক্যাল মজুদ করে রেখেছিল এমন কয়েকটি দোকানে আগুন ধরে যায়। ওই দোকানগুলোও ছিল একটি আবাসিক ভবনের নিচতলায়। বুধবার রাতেও একই রকম পরিস্থিতিতে অগ্নিকাণ্ড ঘটে।
বুধবার রাতে যেমন, নয় বছর আগের ওই অগ্নিকাণ্ডের সময়ও তেমনই দমকল বাহিনী দুর্ভেদ্য যানজটের কারণে দ্রুততম সময়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছতে পারেনি।
২০১০ সালের অগ্নিকাণ্ডের পর কর্মকর্তারা ভবনের নিয়ম-নীতি ভঙ্গের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ঢাকায় স্পষ্ট একটি ‘জোনিং রুল’ অর্থাৎ, কোন জিনিস কোথায় রাখা যাবে, তার নিয়ম রয়েছে। যেমন: প্লাস্টিক তৈরিতে ব্যবহৃত বিপজ্জনক সব জিনিস বা কেমিক্যাল আবাসিক ভবনে মজুদ করা নিষিদ্ধ।
কিন্তু, আইনের দুর্বল প্রয়োগ ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুর্নীতির কারণে এসব আইন উপেক্ষা করা হয়।
বিশ্লেষকরা বলেন, ধনী ব্যবসায়ীরা নিয়মিত সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়ে থাকেন অথবা তাদের ব্যবসা কেন্দ্র আসলে কোথায় অবস্থিত সেটি নিয়ে নির্জলা মিথ্যা বলেন।
২০১২ সালে ঢাকার শহরতলীর একটি কারখানায় আগুন ছড়িয়ে পড়ে। বিপুল পরিমাণ সুতা আর কাপড়ের ধরে যাওয়া আগুন ১৭ ঘণ্টা ধরে জ্বলে।
পরে জানা যায়, কারখানার (জরুরি বহিঃগমন পথ) ফায়ার এসকেপ খুব সঙ্কীর্ণ ছিল, যেখানে কয়েক ডজন মানুষ আটকা পড়ে। শেষ পর্যন্ত সেখানে মারা যায় ১১৫ জন, যাদের বেশিরভাগই কারখানার দরিদ্র শ্রমিক।
এর এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে আরও ভয়াবহ এক বিপর্যয় গার্মেন্টস সেক্টরে আঘাত হানে। ঢাকার শহরতলিতে (সাভারের রানা প্লাজা) আটতলা একটি ভবন ধসে পড়ে নিহত হয় ১,১০০ জন।
বৃহস্পতিবার অগ্নিনির্বাপণ কর্তৃপক্ষ নিউইয়র্ক টাইমসকে জানায়, চকবাজারে এই অগ্নিকাণ্ডের সময় আসলে কি ঘটেছিল, সেটা তারা তদন্ত করে দেখছে।
সরকারি একটি হাসপাতালের একজন চিকিৎসক বলেন, কয়েক ডজন মানুষ বীভৎসভাবে পুড়ে গেছে। বিষাক্ত গ্যাস, সম্ভবত পোড়া কেমিক্যালের ধোঁয়ায় নিঃশ্বাস নেয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কারও কারও ফুসফুস।
পুরনো ঢাকার চকবাজারের রাস্তা-ঘাট সব সরু সরু পেঁচানো অলিগলিতে ভর্তি, যেখানে বড় ট্রাক ঢুকতে পারে না। বুধবার রাতে ফায়ার সার্ভিসের গাড়িকেও সেখানে ঢুকতে বেগ পেতে হয়েছে।
‘ওই সময়ে প্রচুর ভিড় ছিল,’ টাইমসকে বলেন রেস্তোরাঁ মালিক রাকিব। ‘রাস্তার আতঙ্কিত লোকজন প্রাণ বাঁচানোর জন্য যে যেদিকে পারেন, পালানোর চেষ্টা করছিলেন।’
স্থপতি আহমেদ বলেন, কয়েক বছর আগে ঢাকার কর্তৃপক্ষ ঢাকার কেন্দ্র থেকে ট্যানারি স্থানান্তরিত করে শহরের বাইরে নিয়ে যায়।
তিনি মনে করেন, দাহ্য কেমিক্যাল মজুদ করে রাখে এমন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকেও এখন একইভাবে শহরের বাইরে নিয়ে যাওয়া উচিৎ।
‘আমরা জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে পেরেছি। আমরা এটাও করতে পারি,’ যোগ করেন স্থপতি আহমেদ।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন