সংলাপের ভেতর-বাহির : প্রস্তুতির অভাব ছিল ঐক্যফ্রন্টের
![](https://ournewsbd.net/wp-content/uploads/2018/11/pm-2-20181101200435.jpg)
![](https://ournewsbd.net/wp-content/uploads/2025/02/475351977_1256003665483861_2959209934144112011_n.jpg)
রাত প্রায় সাড়ে ১১টা। বৃহস্পতিবার (১ নভেম্বর) সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে সংলাপ করে একে একে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা প্রবেশ করছেন ড. কামাল হোসেনের বাড়িতে। রাজধানীর বেইলি রোডের এই বাড়িতে আগে থেকেই বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের কর্মীরা উপস্থিত। বাড়ির আঙ্গিনায় সংবাদকর্মীরা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য শোনার অপেক্ষায় থাকলেও ভেতরে নেতারা বসেন পরবর্তী অবস্থান নিয়ে আলোচনায়।
বাড়ির বৈঠকখানার সঙ্গে লাগোয়া বসার স্থানে বসেছেন ঐক্যফ্রন্টের নেতারা। আক্ষেপ করেই বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বললেন, ‘আপনারা ম্যাডামের জন্য একটুও বললেন না!’ তার কথার উত্তর নেই; সেকেন্ডের মধ্যেই গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি সুব্রত চৌধুরী বলেন, ‘পারলে আন্দোলন করেন।’ মন্তব্য চলেছে কয়েক মিনিট, প্রতিক্রিয়া-পাল্টা প্রতিক্রিয়া। মির্জা ফখরুল আবার বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী তার জায়গা থেকে একইঞ্চিও নড়েননি।’ আ স ম আবদুর রব উচ্চ স্বরে বলে ওঠেন, ‘তাহলে কী বলবো সাংবাদিকদের, বলেন?’ পাশ থেকে একজন বললেন, ‘একেবারে নেতিবাচক বললে হবে না।’ আ স ম রব আবার বললেন, ‘আপনারা কে কী বলবেন, বলেন?’
নিজেদের মধ্যে মিনিট বিশেক আলোচনা করে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন নেতারা। কথা বলেন ড. কামাল হোসেন, মির্জা ফখরুল এবং সুব্রত চৌধুরী। খালেদা জিয়ার বিষয়ে মির্জা ফখরুল সংবাদকর্মীদের বলেন, ‘বিষয়টি আমরা তুলে ধরেছি। প্রধানমন্ত্রী সরাসরি কিছু বলেননি। তবে তিনি বলেছেন, ‘বিষয়টি আইনি ব্যাপার’।”
বৈঠকে অংশ নেওয়া একজন নেতা জানান, বৈঠকে খালেদা জিয়ার বিষয়টি সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিষ্কার করেই বলেছেন, ‘এটা তো আইনি বিষয়। আমার হাতে নেই।’ বৈঠকসূত্র বলছে, ‘এই বক্তব্যের পরই ফ্রন্টের আর কেউ মন্তব্য করেননি।’ কিন্তু কেন, প্রশ্ন ছিল বৈঠকে অংশ নেওয়া এক নেতার কাছে। উত্তরে বললেন, ‘আমাদের ঐক্যফ্রন্টের প্রস্তুতি নিয়ে সমস্যা ছিল। প্রধানমন্ত্রী বা আওয়ামী লীগের নেতারা তো প্রস্তুতি নিয়ে সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন, আমাদের কেউ তো দিতে পারেননি।’
সংলাপে অংশ নেওয়া একজন নেতা জানান, বৃহস্পতিবারের সংলাপে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কয়েকটি বিষয় উত্থাপন করেন। তিনি ২০১৫ সালে খালেদা জিয়ার সন্তান আরাফাত রহমান কোকো মারা যাওয়ার পর গুলশানে গিয়েছিলেন, সে সময় তাকে গুলশানে কার্যালয়ে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। তিনি সংলাপে উপস্থিত মওদুদ আহমদের প্রতি ইশারা করে বলেন, ‘মওদুদ সাহেব তো ওই সময় ছিলেন। কিন্তু আসেননি।’
বৈঠকসূত্র জানায়, নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন হবে কিনা, এ বিষয়ে কথা হলেও ইভিএম নিয়ে কোনও কথাই ওঠেনি। এ নিয়ে মির্জা ফখরুল অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন বলেও সূত্র জানায়।
সংলাপে যাওয়ার আগে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সিদ্ধান্ত ছিল ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী কোনও কথা বলবেন না। কিন্তু সংলাপে ফ্রন্টের সবাই বক্তব্য দেওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আপনি কিছু বলেন।’ ওই সময় জাফরুল্লাহ চৌধুরী জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সাত দফার সপ্তম দফা থেকে তার বক্তব্য শুরু করেন।
তিনি জাতীয় সংসদ ভেঙে দেওয়ার কথা বলামাত্র আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি শেখ ফজলুল করিম সেলিম জবাব দেন। তিনি উল্টো জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে প্রশ্ন করেন, ‘সংসদ ভেঙে দিলে পিএম থাকবে না, তাহলে দেশ চালাবেন কে?’
তোফায়েল আহমদ বলেন, ‘প্রতিবারই নির্বাচনের জন্য আলোচনার দরকার হবে কেন, এটা নিয়ে স্থায়ী সমাধানের দিকে যাওয়া দরকার।’
জাফরুল্লাহ চৌধুরী এর উত্তরে বলেন, ‘সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার কীভাবে গঠন করা যাবে, এর প্রক্রিয়া নিয়ে প্রয়োজনে একটি কমিটি করে দেন। আমরা শাহদীন মালিক ও আসিফ নজরুলকে দিই, আপনারা কাদের দেবেন, দিয়ে একটা সমাধান করা যেতে পারে।’
জাফরুল্লাহ চৌধুরী প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আপনি একটা সুষ্ঠু নির্বাচন দেন, আপনি নোবেল প্রাইজ পাবেন।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও পাল্টা-প্রসঙ্গ তুলে কথা বলেন। তিনি সম্প্রতি সেনাবাহিনী সম্পর্কে জাফরুল্লাহর দেওয়া বক্তব্য সম্পর্কে বলেন, ‘আপনি তো যেভাবে বক্তব্য দিয়েছেন, খালেদা জিয়া হলে তো জেলেই যেতেন।’ এসময় জাফরুল্লাহ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে পাওয়া ৩১ একর জমি এবং শেখ হাসিনার আমলে পাওয়া ১৪ একর জমির প্রসঙ্গ তুলে অভিনন্দিত করেন। সংলাপে তিনি বলেন, ‘আপনার বাবার দেওয়া জমি ব্যবহার করতে পারলেও আপনার দেওয়া জমি কিন্তু এখনও দখলে পাইনি।’
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের চারজন নেতার ভাষ্য, ‘সংলাপে আওয়ামী লীগের বাইরে তিনজন শরিক দলের নেতার বক্তব্য ছিল অনেক বেশি উত্তেজিত। হাসানুল হক ইনু বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময় সারাদেশে খুন-খারাবি নিয়ে কথা বলেছেন। উচ্চস্বরে বক্তব্য দিয়েছেন মইন উদ্দীন খান বাদল। কথা বলেছেন রাশেদ খান মেননও। তিনি অভিযোগ করেছেন, বাইরে বিএনপি ও ফ্রন্টের নেতারা বর্তমান সরকার বিনা ভোটের সরকার বলে প্রচার করে। ফ্রন্টের ওই চার নেতার ভাষ্য, তোফায়েল আহমদ, আমির হোসেন আমুর বক্তব্য অনেক সোভার ছিল।
সংলাপ সম্পর্কে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের ভাষ্য অনেকটাই পরস্পরবিরোধী, বিভক্ত। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর পরিষ্কার করেই বলেছেন, ‘সন্তুষ্ট নই।’ ড. কামাল হোসেন সাংবাদিকদের বললেন, ‘প্রধানমন্ত্রী বেশ লম্বা বক্তব্য দিয়েছেন। তবে আমরা সে বক্তব্যে বিশেষ কোনও সমাধান পাইনি।’
তবে জাফরুল্লাহ চৌধুরী বললেন চারটি প্রাপ্তির কথা। তিনটি বিষয় ফ্রন্টের নেতারা জানিয়েছেন, একটি হচ্ছে বিনা বাধায় সভা-সমাবেশ করতে পারা, রাজনৈতিক মামলার তালিকা চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী, নতুন কোনও মামলা না দেওয়ার আশ্বাস এবং জাতীয় নির্বাচনে অবাধে পর্যবেক্ষক নিয়োগের পথ খোলা রাখা।
নিজের বক্তব্য দিতে গিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ সংবিধান বিষয়ে আলোচনা করেন। একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অভিযোগের প্রেক্ষিতে তিনি বলেন, ‘ওই সময় তো আমি দোতলায় ছিলাম।’ (২০১৫ সালে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুতে শোক জানাতে শেখ হাসিনার গুলশানে যাওয়া)
মাহমুদুর রহমান মান্না সংলাপে দুটো বিষয় উত্থাপন করেন। দুটো বিষয়ই আওয়ামী লীগ আমলে নেয়নি। একটি হচ্ছে, যে সংলাপ শুরু হয়েছে, পরিস্থিতি নিষ্পত্তির আগে এই সংলাপ চালু রাখা। দ্বিতীয়ত, সংলাপ শেষ হওয়ার আগে পর্যন্ত তফসিল ঘোষণা না করা।
পরে মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘দুটো প্রস্তাবই আওয়ামী লীগ মেনে নেয়নি।’
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের গুরুত্বপূর্ণ একনেতা বলেন, ‘সংলাপে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের প্রস্তুতির অভাব ছিল নিঃসন্দেহে। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনসভা করা, মামলা না করার প্রতিশ্রুতি দিলেও পাল্টা ফ্রন্টের নেতা ড. কামাল হোসেন বিষয়গুলোকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে কোনও বিষয় উত্থাপন করেনি। এক্ষেত্রে এই নেতার ভাষ্য, ‘প্রধানমন্ত্রী জনসভা, মামলা না করার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, সেটার কী মূল্য আছে? তিনি কি সার্কুলার জারি করার কথা বলেছেন? বলেননি। তাহলে?’
ঐক্যফ্রন্টের আরেক নেতা বলেন, ‘কামাল হোসেন নেগোসিয়েশন করতে পারেননি এবং পয়েন্ট মেক করতে পারেননি, যেটা সাফল্যের সঙ্গে আওয়ামী লীগ পেরেছে।’
জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংলাপে একাদশ জাতীয় নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার দাবি জানালেও ক্ষমতাসীনরা তাতে সায় দেননি। সংলাপ শেষে ফ্রন্টের নেতা আবদুল মালেক রতন বলেন, ‘আমরা বলেছি, যে সময় আছে তাতে নির্বাচন করা যাবে না। সময় দরকার। কিন্তু তারা কোনও উত্তর দেননি।’
সংলাপের বিষয়ে জানতে চাইলে জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘সংলাপ একেবারেই বৃথা গেছে, তা নয়। আলোচনা শুরু হয়েছে। এটা কন্টিনিউ করতে হবে।’
যদিও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা পরিষ্কার করেই বলছেন, আলোচনার পাশাপাশি তাদের ফ্রন্টের কর্মসূচিও চলবে।
নৈশভোজের বিষয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমরা নৈশভোজে অংশ নিইনি। চা-নাস্তা-স্ন্যাকস দেওয়া হয়েছিল, ঐক্যফ্রন্টের নেতারা তা গ্রহণ করেছেন।’
নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘চা, স্ন্যাকস দিয়েছে, আমরা সেগুলো গ্রহণ করেছি। নৈশভোজে অংশ নিইনি আমরা। এখন হয়তো স্ন্যাকসকেই নৈশভোজ হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলতে পারে।’ সৌজন্যে : বাংলা ট্রিবিউন।
![](https://ournewsbd.net/wp-content/uploads/2024/12/469719549_122234398946008134_2936380767280646127_n.jpg)
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন