অগ্নিঝরা মার্চ : স্বাধীনতা আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু

অগ্নিঝরা মার্চ : স্বাধীনতা আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু

প্রফেসর মো. আবু নসর

ইংরেজ রাজত্বে সিপাহি বিদ্রোহ, সৈয়দ আহমদ ব্রেলভীর ‘ওহাবী’ আন্দোলন, হাজী শরীয়াতুল্লাহর ফরায়েজী আন্দোলন, তিতুমীরের বাঁশের কেল্লার মাধ্যমে স্বাধীনতার আন্দোলন, মাওলানা মোহাম্মদ আলী ও মাওলানা শওকত আলীর নেতৃত্বে খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন, নেতাজী সুভাষ বোসের আন্দোলন, সূর্যসেনের সশস্ত্র আন্দোলন, আজাদ হিন্ধ ফৌজের আন্দোলন, মহাত্মা গান্ধীর অহিংস ও ভারত ছাড়ো আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্ত্ব আন্দোলনের ভিত্তিতে পাকিস্তান অর্জিত হয়।

১৯৪৭ সালের পূর্বতন ব্রিটিশ শাসিত ব্রিটিশ ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামে দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পাকিস্তান রাষ্ট্র অর্জিত হলেও অর্থনৈতিক মুক্তিসহ প্রকৃত স্বাধীনতা আসেনি। বিভিন্ন ক্ষেত্রে তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তানের প্রতি কেন্দ্রীয় শাসকগোষ্ঠীর বৈষম্যমূলক নীতি ও আচরণের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হয়ে পূর্বাঞ্চলের মুক্তিকামী জনগণ তিলে তিলে জর্জরিত হয়। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালে গণ-অভ্যুথান, সর্বশেষ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতা আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র পৃথিবীর মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করল।

ইতিহাসের পেছনে যেমন ইতিহাস থাকে, তেমনি ১৯৭১-এর স্বাধীনতা আন্দোলনের পেছনে ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুথান, তার পেছনে ১৯৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন, তার আগে ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত বিস্ফোরণ পর্ব, তার পশ্চাতে ১৯৪৮ সালে মহান ভাষা আন্দোলনের প্রথম সফল বিস্ফোরণ পর্ব, তার পশ্চাতে ১৯৪৭ সালে মহান ভাষা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিত ও সূচনা পর্ব।

তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা মূলত ভাষা আন্দোলনের ও একুশের চেতনারই স্বর্ণফসল। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এগিয়ে যায়। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী বিজয়, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯-এ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অবসান ও গণ-অভ্যুথান এবং ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরষ্কুশ বিজয় বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের বিভিন্ন পর্যায়ে ঐতিহাসিক ঘটনা। এ পথ ধরে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বিজয় লাভ করে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে। উল্লেখ্য, আমাদের পুরো মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে উৎসারিত।

স্বাধীনতার জন্য বাঙালি জাতি হাজার বছর ধরে সংগ্রাম করেছে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে যুগে যুগে এতদঞ্চলের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ সর্বস্তরের জনসাধারণকে সাথে নিয়ে স্বাধিকার, স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রাম করেছেন। ইতিহাসে ঈসা খাঁ থেকে তিতুমীর, শরীয়তুল্লাহ, ক্ষুদিরাম, বাঘা যতীন, মাস্টারদা সূর্যসেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার প্রমুখ তার জ্বলন্ত প্রমাণ। সময়ের ছকবদ্ধ গাঁথুনিতে সারিবদ্ধ হয় ইতিহাস। ইতিহাস মানবসভ্যতার অমূল্য দলিল। কোনো নির্দিষ্ট জাতি কিংবা গোষ্ঠী ইতিহাসের শিকড় ধরেই পৌঁছায় তার সমৃদ্ধ ও গৌরবময় অতীতের স্বপ্নঐতিহ্য ভাণ্ডারের সুবর্ণ দুয়ারে, যা থেকে মন্থন করে নেয় সে ভবিষ্য্যৎ পাথেয়। ইতিহাস একমাত্র তখনই মূল্যবান, যখন তার ভেতর থেকে ভবিষ্যতের উন্নতির রসদ খুঁজে পাওয়া যায়। যিনি ইতিহাসের গতিধারা বদলে দেন, তিনি নেতা। নেতা সৃষ্টি করেন ইতিহাস। ইতিহাস সৃষ্টি করে মানুষ। আর এ জন্যই ইতিহাসের পাতায় সংযোজিত হয়ে থাকে ‘এক সাগর রক্তের কাহিনী’। মানবসভ্যতার অমূল্য দলিল হিসেবেই স্বাধিকার, স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। বাংলাদেশের স্বাধীনতা তাই বাঙালি জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন। স্বাধীনতা আন্দোলন বাঙালি জাতির জীবনে ইতিহাস সৃষ্টিকারী ঘটনা। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় তাই ঐতিহাসিক বাস্তবতা।

স্বাধীনতার মহান স্থপতি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অপরিসীম আত্মত্যাগের বিনিময়ে ও নেতৃত্বে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশ একটি ঐতিহাসিক বাস্তবতা। তিনি বাঙালির মুক্তির সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা। ২৩ বছরের আন্দোলন সংগ্রামের যোগফল মুক্তিযুদ্ধ। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সাল আমাদের জাতীয় জীবনে চিরস্মরণীয় বছর। স্বাধীনতা অর্জনের উদ্দেশ্যে দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন প্রায় ৩০ লাখ মানুষ। অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের একসাগর রক্তের বিনিময়ে এই বাংলার স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। ১৯৭১ এর মার্চ জাতীয় জীবনে যেমন বেদনার মাস, তেমনি তা বিপুল গর্বেরও। সেই মাসটি যেমন ছিল রক্তঝরা, তেমনি ছিল তা অনন্য। বাংলাদেশ এখন স্বাধীন। স্বাধীনতা আমাদের জন্য একটি স্বর্ণদুয়ার খুলে দিয়েছে যে দুয়ার দিয়ে প্রবেশ করে আমরা যুগসঞ্চিত জঞ্জাল দূর করার অঙ্গীকার ও প্রত্যয় ব্যক্ত করতে পারি। আমাদের স্বাধীনতা আমাদের এ জাতির প্রেরণা। মুক্তিকামী মুক্তিযোদ্ধারা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান আর বাংলাদেশের স্বাধীনতা বাঙালি জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন।

মুক্তিযোদ্ধাদের মহিমান্বিত ও দুঃসাহসিক বীরত্বের অমরগাথা কোটি কোটি বাঙালি হৃদয়ের মণিকোঠায় চিরজাগরূক। বাঙালির যা কিছু বড় মাপের অর্জন, তা সম্ভব হয়েছে ঐক্য ও সংহতির ভিত্তিতে। স্বাধীনতা সংগ্রামের সুস্পষ্ট নির্দেশনামূলক ঘোষণায় তদানীন্তন রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণ ৭ মার্চ। জাতির প্রেরণার উৎস ৭ মার্চের ভাষণ। এই ভাষণ বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সাধনার বহিঃপ্রকাশ। বঙ্গবন্ধুর সে ভাষণ এখন সারা বিশ্বে ইউনেস্কো স্বীকৃতিপ্রাপ্ত বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য। এটা কালজয়ী মহাকাব্যের বিশ্বস্বীকৃতি। অমর কাব্যের অমর কবিতা এ ভাষণ।

২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। বরণীয়, চিরস্মরণীয়, অবিস্মরণীয় ও তাৎপর্যপূর্ণ দিন। ২৬ মার্চকে তাই এ জাতি স্মরণ করে আত্মশক্তির প্রতীক হিসেবে। স্মরণ করে আত্মমর্যাদার দিকদর্শনরূপে। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সূচনার মাস এই অগ্নিঝরা মার্চ। ’৭১-এর ২৬ মার্চে যার সূচনা, ১৬ ডিসেম্বরে তার পরিপূর্ণতা। ২৬ মার্চ যেহেতু এর সূচনা, তাই এই দিনটা আমাদের রক্তসিক্ত স্বাধীনতা দিবস।

 

 

লেখক :
প্রফেসর মো. আবু নসর
সাবেক অধ্যক্ষ, কলারোয়া সরকারি কলেজ, সাতক্ষীরা