অগ্নিদগ্ধ নুসরাত : বিবেকপোড়া বাংলাদেশ

ইয়াসিন মাহমুদ : আমরা যেসময়ে নারীর ক্ষমতায়ন ও নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার নানান সুবচন,উন্নয়নের বুলি শুনছিলাম ঠিক তখনি কানে বাজলো নুসরাতের বেঁচে থাকার আকুতি। নুসরাতের কান্নার শব্দ আমাদের কর্ণকুহরে কি পৌছেনি? নাকি আমরা না শোনার ভান করে বসেছিলাম নতুন কোন নাটক কিংবা সিনেমার স্যুটিংয়ের নিয়তে, তা দেখার জন্য হয়তো আরো একটু অপেক্ষা করতে হবে। নুসরাত জাহান রাফি এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হসপিটালের বার্ণ ইউনিটে অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। আপনাদের হৃদয়ে সত্যিই কি নুসরাত নাড়া দিতে পারেনি?

বুদ্ধিজীবীমহল, নারীবাদী নেত্রীদের কাউকে নুসরাতের পাশে দেখা যাচ্ছে না। আসলে ঘটনাটা কি? এই পৃথিবীর জন্য কি একজন নুসরাত বড় অনুপোযুক্ত? কেউ তাঁর পক্ষে কথা বলছে না। বিষয়টা আশ্চর্যজনক। গত ৬ এপ্রিল থেকে ‘টক অব দ্যা কান্ট্রি’ নুসরাত জাহান রাফির অগ্নিদগ্ধের খবর। নুসরাতের শরীরের ৮০ শতাংশ পুড়িয়ে গেছে। কর্তব্যরত ডাক্তারেরাও বলেছেন- নুসরাতের অবস্থা আশঙ্কাজনক। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হসপিটালে বার্ণ ইউনিটে নুসরাতকে দেখতে আসেন তাঁর বড় ভাই রাশেদুল। রাশেদুলের সাথে নুসরাত বলে- আমি বুঝতে পারছি- মনে হয় আর বাঁচব না। যদি আমার কিছু হয়ে যায়, মাকে খেয়াল রাখবি। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমাকে বাঁচাও…। নুসরাত আরো বলে-ভাই, আমার যা কিছু হয় হোক, তবুও ওদের যেন বিচার হয়।’ নুসরাতকে পানি খেতে ডাক্তার নিষেধ করেছেন। চরম তৃঞ্চায় ওষ্ঠাগত নুসরাত আকুতি করে তাঁর বাবাকে বলে- বাবা আমার গলাটা শুকিয়ে যাচ্ছে। চুরি করে হলেও দুই ফোঁটা পানি দাও। ওদিকে নুসরাত চোখ খুলতে পারছে না। মৃতের মতো শুয়ে আছে। মেয়ের এমন দৃশ্যে নুসরাতের বাবা বলেন- ঘুমাসনে মা, চোখ খোলা রাখ। সময়ই যেন নুসরাতদের বিপক্ষে। আমরা সবাই কি বিবেকহীনতার সংসারে বসবাস করছি! আমরা কেউই মুখ খুলছি না। মেয়েটি কি মারা যাবার পরে আমরা সরব হবো। দিনদিন কি নুসরাতদের পৃথিবী হিংস্র পশুর ভয়াল অরণ্যে পরিণত হবে?

গত ৬ এপ্রিল থেকে সকল মিডিয়ার শিরোনামে এখন নুসরাত। সাংবাদিকদের এখন খাওয়া ঘুম নেই। নুসরাতের বর্তমান অবস্থার কথা জানানোই সবার একান্ত কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমজনতা সর্বশেষ খবরের অপেক্ষায় তবে নুসরাতের ভালো কোন খবরের প্রত্যাশা সবারই। আর সন্ত্রাসীদের উপযুক্ত শাস্তির দাবি ওঠেছে সারাদেশ ব্যাপী। নুসরাতের ওপর যারা নৃশংস হামলা চালিয়েছে আদৌ তাদের বিচার হবে, নাকি জজ মিয়া নাটক হবে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে সাধারণ মানুষের। ইতোপূর্বের ঘটনাগুলোর থেকে এমন অনুমানই বুঝি সবার বিশ্বাসের ঘরে বসবাস করছে।

নুসরাতের উপর এই বর্বর ও নিষ্ঠুর নির্যাতনে হতবাক পুরো দেশবাসী। নুসরাতের উপর এমন পাশবিকতার নেপথ্যের ঘটনা কি ছিলো? নুসরাতেরই পিতৃতুল্য এক নরপশু তাঁরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলার যৌন লালসা পূরণে রাজি না হওয়া। বিভিন্নভাবে সিরাজ উদদৌলা নুসরাতকে হয়রানি করার অভিযোগে নুসরাতের মা শিরিন আক্তার বাদী হয়ে অধ্যক্ষ ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে মামলা করে। গত ২৭ মার্চ পুলিশ সিরাজ উদদৌলাকে আটক করে জেলহাজতে প্রেরণ করে। এঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে সিরাজ উদদৌলা ও তাঁর দোসররা। ৬ এপ্রিল শনিবার, অন্যদিনের মতো পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলো নুসরাত। আরবি প্রথমপত্রের পরীক্ষা ছিলো তার। পরীক্ষার ঠিক আধাঘণ্টা আগে সোনাগাজী ফাযিল মাদরাসার ছাদে নিয়ে যাওয়া হয় নুসরাতকে। বোরকা ও হাতমোজা পরিহিত চারজন মহিলা ওড়না দিয়ে হাত বেঁধে তাঁর গায়ে কেরোসিন দিয়ে উল্লাস করতে থাকে। নুসরাত দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করলে তারা হেসে কুটিকুটি হয়ে বলে- এবার পালা। আগুনে পুড়ছিলো নুসরাত। কেউ এগিয়ে আসলো না। সোনাগাজী মাদরাসার অন্যসকল শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরাদের ভেতরেও কি অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলার উত্তরসুরিতের মতো জিঘাংসার প্রতিশোধ জেগেছিলো? একজন জীবন্ত মানুষকে দিবালোকে প্রকাশ্য পুড়িয়ে হত্যার দৃশ্য আমরা আর কত দেখেই চলবো? বিচারহীনতার সংস্কৃতি বরাবরই অপরাধীদেরকে উৎসাহ জোগাবে আর কুঁরে কুঁরে নিঃশেষ করবে স্বজনহারাদের হৃদয়। অচিরেই নুসরাত জাহান রাফি সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসুক এই কামনা। নুসরাতের প্রতি যারা জঘন্যভাবে পেশিশক্তি প্রয়োগ করে মানবতার প্রতি ধৃষ্ঠতা প্রদর্শন করলো তাদেরকে উপযুক্ত শাস্তির মাধ্যমে দৃষ্টান্ত হোক সুবিচারের।

লেখক : কলামিস্ট ও গবেষক