অনিয়মের অভিযোগ না উঠলে ডাকসুর ফল কী হতো?


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে ছাত্রলীগ ২৫টি পদের মধ্যে ২৩টিতে জয় পেয়েছে৷ তবে ভিপি নির্বাচিত হয়েছেন কোটা আন্দোলনের নেতা হিসেবে পরিচিত সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের প্রার্থী মো: নুরুল হক৷


তিনি ছাড়াও কোটা সংস্কার আন্দোলনের আরেক নেতা আখতার হোসেন ডাকসুর সমাজসেবা সম্পাদক পদে জয়ী হয়েছেন৷ এছাড়া ১৮টি হলের মধ্যে পাঁচটি ছাত্রী হলে কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতারা জয় পেয়েছেন৷ এর মধ্যে সিল দেয়া ব্যালটের জন্য আলোচিত কুয়েত মৈত্রী হল রয়েছে৷ এছাড়া শামসুন্নাহার হলের ভিপি, জিএসসহ ১৩ পদের আটটিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আটটিতেই জয় পেয়েছেন কোটা সংস্কার আন্দোলকারীরা৷

ছাত্রদের দু’টি হলেও ভিপি ও জিএস পদে কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতারা জয়ী হয়েছেন৷

সোমবার ডাকসু নির্বাচনের সময় কুয়েত মৈত্রী হলে ছাত্রলীগের প্রার্থীদের পক্ষে সিল মারা ব্যালট পেপার উদ্ধারসহ নানা অনিয়ম ও হামলার ঘটনা ঘটে৷ এই অভিযোগে শুধুমাত্র ছাত্রলীগসহ আর সবাই নির্বাচন বর্জন করেছিল৷

রাত সাড়ে তিনটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো: নুরুল হককে বিজয়ী ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়েন৷ তাঁরা ওই পদে নির্বাচন বাতিলের দাবি জানান৷ এরপর মঙ্গলবার সকালে তাঁরা উপাচার্যের বাসভবন ঘেরাও করেন৷ নবনির্বাচিত ভিপি নুরুল হক সকালে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করলে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় টিএসসি এলাকায় তাঁর ওপর হামলা হয়৷

দুপুরের পর সভাপতির অনুরোধে ছাত্রলীগ উপাচার্যের বাসভবনের সামনে থেকে সরে যায়৷ এরপর বিকেল চারটার দিকে টিএসসিতে এক মঞ্চে কোলাকুলি করেন নবনির্বাচিত ভিপি নুরুল হক এবং ভিপি পদে পরাজিত ও ছাত্রলীগ সভাপতি শোভন৷ তারা একসঙ্গে কাজ করার ঘোষণা দেন৷ ছাত্র ধর্মঘট প্রত্যাহারেরও ঘোষণা দেয়া হয়৷

জানা গেছে, ছাত্রলীগ ভিপি পদ না পাওয়ার পর থেকেই কঠোর অবস্থানে যায়৷ তারা কোনোভাবেই তাদের এই পরাজয় মানতে পারছিলনা৷ ছাত্রলীগের অনেক নেতা-কর্মীকে কাঁদতেও দেখা যায়৷ আর রাতেই নুরুল হকসহ ৪০ জনের বিরুদ্ধে মামলাও করা হয় শাহবাগ থানায়৷ তাদের বিরুদ্ধে রোকেয়া হলে ব্যালট পেপার ছিনতাই ও শিক্ষক লাঞ্ছনার অভিযাগ আনা হয়৷ বুধবার সকাল থেকেই ছাত্রলীগ আক্রমণাত্বক মনোভাব নিয়ে ক্যাস্পাসে আসে৷ উপাচর্যের বাসভবন ঘেরাও করে তারা নুরুলকে গ্রেপ্তার ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের দাবি জানায়৷ নুরুলকে গ্রেপ্তার করা হবে বলেও ঘোষণা দেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী৷

তবে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে ক্যাম্পাসে কোনো ধরণের বিশৃঙ্খলা না করতে ছাত্রলীগকে নির্দেশ দেয়া হয়৷ তারপরই ক্যাম্পাসে ছুটে আসেন ডাকসু ভিপি পদে পরাজিত ছাত্রলীগ সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন৷ ছাত্রলীগের বিক্ষোভ থামিয়ে দিয়ে নবনির্বাচিত ভিপি নুরুল হকের সঙ্গে এক মঞ্চে উঠে কোলাকুলি করেন, মিলেমিশে কাজ করার ঘোষণা দেন৷

‘সুষ্ঠু নির্বাচন হলে ছাত্রলীগ কোনো পদেই জয় পেতনা’

নবনির্বাচিত ভিপি মো: নুরুল হক মঙ্গলবার সকালে টিএসসিতে সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘সুষ্ঠু নির্বাচন হলে ছাত্রলীগ কোনো পদেই জয় পেতনা৷ কোটা সংস্কার আন্দোলন পূর্ণ প্যানেলে জয়ী হত৷ তারপরও সাধারণ শিক্ষার্থীরা যেভাবে পেরেছে ছাত্রলীগের নির্যাতন, নিপীড়ন, যৌন নিপীড়নের জবাব দিয়েছে৷’’

এদিকে, কোটা সংস্কার আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন বলেন, ‘‘শত প্রতিকূলতার মধ্যেও কোটা সংস্কার নেতারা ভিপিসহ ডাকসুতে দুটি পদে জয়ী হয়েছেন৷ বেশ কয়েকটি হলে আমরা পূর্ণ প্যানেলে জয়ী হয়েছি৷ নির্বাচনে অনিয়ম না হলে আমরা ডাকসুর সব পদে জয়ী হতাম৷’’

তিনি বলেন, ‘‘শুধু ছাত্রলীগ নয়, ছাত্রদল বা বামজোট কারোর প্রতিই সাধারণ শিক্ষার্থীদের এখন আর আগ্রহ নেই, তা এই নির্বাচনেই দেখা গেছে৷ কোটা সংস্কার আন্দোলনসহ শিক্ষার্থীদের কোনো আন্দোলনেই রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনগুলো ভূমিকা রাখেনি৷ আমরা সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা যখন নির্যাতনের শিকার হয়েছি তখন আমাদের পাশে কেউ ছিলনা৷ আমরাই সাধারণ ছাত্র-ছাত্রী অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ করে প্রতিবাদ করেছি, মাঠে থেকেছি৷ শিক্ষার্থীরা বুঝতে পেরেছে রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনগুলো তাদের মূল দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারেনা৷ তারা লেজুড়বৃত্তি করে৷ তারা এর জবাব পেয়েছে৷’’

সূত্র জানায়, ছাত্রলীগ সব পদে জয়ী না হতে পেরে হতাশ হলেও তাদের বোঝানো হয়েছে যে, এটি আসলে তাদের অনেক বড় জয়৷ কারণ ডাকসুতে অতীতে সরকার সমর্থক কোনো ছাত্র সংগঠন কোনো পদেই জয় পায়নি৷ সেক্ষেত্রে ছাত্রলীগের ডাকসুর ২৫ পদের ২৩টিতে এবং অধিকাংশ হল সংসদে জয় একটি রেকর্ড৷ আর সরকারের নীতি নির্ধারণ মহল থেকেও তাদের এতেই সন্তুষ্ট থাকতে বলা হয়৷

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং ডাকসুর নবনির্বাচিত এজিএস সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘‘আমরা আগেও বলেছি শিক্ষার্থীদের রায় আমরা মেনে নেব৷ আমরা ডাকসুর ফল মেনে নিয়েছি৷ তবে আমরা মনে করি আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হয়েছে৷ আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও গুজব ছড়ানো হয়েছে৷ সেটা না হলে আমরা নিরঙ্কুশ জয় পেতাম৷’’

তিনি দাবি করেন, ‘‘কুয়েত মৈত্রী হলে যে সিল মারা ব্যালট পেপারের কথা বলা হচ্ছে ওগুলো জাল ভুয়া ব্যালট পেপার৷ এটা করা হয়েছে আমাদের হারানোর জন্য৷ মৌলবাদী ও স্বৈরাচারী শক্তি এটা করেছে৷ ছাত্রদের সেন্টিমেন্টকে গুজব দিয়ে প্রভাবিত করা হয়েছে৷’’

‘ছাত্রলীগের প্রতি অনাস্থা’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ফাহমিদুল হক মনে করেন, ‘‘ নির্বাচনে অনিয়ম না হলে ছাত্রলীগ কোনো পদেই জয়ী হতনা৷ স্বতন্ত্র বা কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রার্থীরাই জয়ী হতো৷ তারপরও তারা ভিপিসহ হলগুলোতে বিশেষ করে ছাত্রী হলে অনেক পদে জয়ী হয়েছে৷ এর কারণ ছাত্রলীগের প্রতি অনাস্থা৷ আর সার্বিকভাবে তারা রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের প্রতি অনাস্থা জানিয়েছে৷’’

তিনি আরো বলেন, ‘‘ছাত্রী হলগুলোতে হল প্রশাসন রাজনৈতিক প্রভাবে চলেনা৷ তাই সবগুলো ছাত্রী হলে কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতারা জয়ী হয়েছেন৷ সেখানে তারা স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পেরেছেন৷’’

ফাহমিদুল হক আরো বলেন, ‘‘কুয়েত মৈত্রী হলে অনিয়মের চেষ্টা করা হলেও তা রুখে দেয়া হয়েছে৷ ছাত্রীরা প্রতিবাদ করেছেন৷ তারা প্রতিবাদের মাধ্যমে অনিয়ম ঠেকিয়ে দিয়েছেন, যা একটা আশার দিক৷ এখনও তরুণদের প্রতিবাদের ভাষা ও শক্তি শেষ হয়ে যায়নি৷’’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জনও মনে করেন, ‘‘ছাত্রী হলগুলোর প্রশাসন যতটা স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ ছাত্র হলগুলোতে সেরকম হলে ডাকসু নির্বাচনের ফল হয়ত ছাত্রী হলগুলোর ফলের মতই হতো৷’’