অশ্রুতে, শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায় সিক্ত সুরস্রষ্টা বুলবুল

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বেলা ১১টায় মরদেহ আসার কথা ছিল সঙ্গীতজ্ঞ, মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের। শহীদ মিনারে প্রিয় শিল্পীর মরদেহ আসার অনেক আগে থেকেই ভিড় জমে যায় শহীদ মিনারে। কেউ ফুল হাতে দাঁড়িয়ে, কেউ অঝোরে কেঁদে চলেছেন। পৌনে ১১টায় বুলবুলের মরদেহ আসলে আড়ালে-আবডালে চোখ মুচ্ছিলেন অনেকে। আবার অনেকে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেন।

গার্ড অব অনার শেষে বুলবুলের মরদেহ শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য শহীদ মিনারের পাদদেশে রাখা হলে ফুল দিতে শুরু করেন সবাই। ফুল দিতে গিয়ে কেউ-ই যেন চোখের পানি ধরে রাখতে পারছিলেন না।

মরদেহের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন পরিবারের সদস্যরা। তাদের চোখের পানি যেন শুকাচ্ছিলই না। পরিবারের সদস্যদের বাইরে ঘনিষ্ঠজনদের অবস্থান ছিল। সব ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি তারাও যেন বারবার ভেঙে পড়ছিলেন, মুচ্ছিলেন চোখ।

এ সময় সঙ্গীত, চলচ্চিত্র, সংস্কৃতি জগতের পাশাপাশি সর্বস্তরের মানুষ তাকে শ্রদ্ধা ও বিদায় জানায়। এ ছাড়াও রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে তার সহকারী সচিব কাজী ইফতেখারুল, মাহবুবুল হক হানিফের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, নজরুল সঙ্গীতশিল্পী পরিষদ, বাংলাদেশ জাসদ, বিভিন্ন গণমাধ্যমসহ অসংখ্য সংগঠন ও ব্যক্তিরা শ্রদ্ধা জানান।

যারা এ সময় শহীদ মিনারে এসেছিলেন, তাদের সবার মুখে যেন একই বুলি, ‘এ ক্ষতি পূরণ হবার নয়।’

শ্রদ্ধা জানানো শেষে গণমাধ্যমের মুখোমুখি হন সঙ্গীতশিল্পী সালমা। কান্না সংবরণ করতে না পেরে একপর্যায়ে সালমা বলেন, ‘আমি কিছু বলতে পারছি না।’ কথা না বলেই বিনয়ের সঙ্গে বিদায় নেন তিনি।

কুমার বিশ্বজিৎ বলেন, ‘সঙ্গীত পরিচালক, গীতিকার হিসেবে কী মানের ছিলেন বুলবুল ভাই, তা ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই। আমাদের এই ক্ষতি পূরণ হবে কি না, তা আমি জানি না।’

সামিনা চৌধুরী বলেন, ‘মানুষ হিসেবে তিনি কেমন ছিলেন, তা আমরা সবাই জানি। তিনি আমাদেরকে যা দিয়ে গেছেন, তা আমরা সবাই চর্চা করে যাব।’

নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশিদ বলেন, ‘আমরা একজন পরিপূর্ণ মানুষকে হারালাম। মাত্র ৬৩ বছর বয়সে সে চলে গেল। এত অল্প বসয়ে তার লাশ বহন করতে হবে তা ভাবিনি। এই দুঃখ অনেক দিন আমাকে স্মৃতিগ্রস্ত করে রাখবে।’

সঙ্গীতশিল্পী, সুরকার ও মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের মরদেহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। দুপুর ১২টা ৪৫ মিনিটে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে তার মরদেহবাহী গাড়িটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশে রওনা দেয়।

জানাজা শেষে তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনে (বিএফডিসি)। সেখানেও তার জানাজা হবে। এরপর মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হবে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলকে।

মঙ্গলবার (২২ জানুয়ারি) ভোর ৪টার দিকে আফতাবনগরের নিজ বাসায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ৬৩ বছর বয়সী বরেণ্য এই সঙ্গীতশিল্পী।

আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘আমার গরুর গাড়িতে বউ সাজিয়ে’, ‘আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন শুনেছিলাম গান’, ‘আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি’, ‘পড়ে না চোখের পলক’, ‘আমার বুকের মধ্যখানে মন যেখানে হৃদয় যেখানে’, ‘তোমায় দেখলে মনে হয়’, ‘যে প্রেম স্বর্গ থেকে এসে’, ‘অনন্ত প্রেম তুমি দাও আমাকে’, ‘আম্মাজান’ প্রভৃতি।

তার সুর করা গানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘সব ক’টা জানালা খুলে দাও না’, ‘সেই রেললাইনের ধারে মেঠো পথটার পাড়ে দাঁড়িয়ে’, ‘একতারা লাগে না আমার দোতরাও লাগে না’, ‘ও মাঝি নাও ছাইড়া দে’, ‘সুন্দর, সুবর্ণ, তারুণ্য, লাবণ্য’, ‘মাগো আর তোমাকে ঘুম পাড়ানি মাসি হতে দেব না’ প্রভৃতি। এ ছাড়াও তার লেখা, সুর করা ও গাওয়া অসংখ্য গান রয়েছে।

কাজের স্বীকৃতি হিসেবে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মান একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং রাষ্ট্রপতির পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল।