আজীবন সৎ থেকে দায়িত্ব পালন করতে চান তারিক সালমন

ছোট্ট এক শিশুর আঁকা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি ছবি স্বাধীনতা দিবসের আমন্ত্রণপত্রে ব্যবহার করে আলোচনার কেন্দ্রে আসা গাজী তারিক সালমন জানিয়েছেন, যত বাধাই আসুক না কেন আজীবন সৎ থেকেই তিনি তার দায়িত্ব পালন করে যাবেন।

এক সাক্ষাতকারে বর্তমানে বরগুনা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ২৮ বিসিএস-এর এ কর্মকর্তা স্বপ্ন দেখেন দুর্নীতিমুক্ত সুন্দর এক বাংলাদেশের।

গাজী তারেক সালমন বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকাকালে ২৬ মার্চের অনুষ্ঠানের একটি আমন্ত্রণপত্র প্রকাশ করেন। ওই আমন্ত্রণপত্রের পেছনের পাতায় পঞ্চম শ্রেণী পড়ুয়া একজন শিশুর আঁকা বঙ্গবন্ধুর ছবি ছাপানো হয়।

ওই ছবিতে বঙ্গবন্ধুকে বিকৃত করে উপস্থাপন করে মানহানী করা হয়েছে এমন অভিযোগে গত ৭ জুন ৫ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে সালমনের বিরুদ্ধে মামলা করেন বরিশাল জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও জেলা আওয়ামী লীগের ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক সৈয়দ ওবায়েদুল্লাহ সাজু।

গত বুধবার ওই মামলায় জামিন চাইতে গেলে বরিশালের চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্টেট্র আদালতের বিচারক মো. আলী হোসাইন প্রথমে তাকে কারাগারে পাঠান। তবে কয়েক ঘণ্টা পর তাকে আবার জামিন দেন।

পারিবারিকভাবে অয়ন নামে পরিচিত সালমনকে নিয়ে এসব ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঝড় তুলেছে। এরই মধ্যে মামলার বাদী সাজুকে আওয়ামী লীগ থেকে বহিস্কার করা হয়েছে।

সরল জীবন-যাপনে অভ্যস্ত এ কর্মকর্তার জন্ম সাতক্ষীরা জেলার মুন্সীপাড়ায়। ১৯৯৯ সালে যশোর জিলা স্কুল হতে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি, ২০০১ সালে যশোর ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে ২য় বিভাগ নিয়ে এইচএসসি পাশ করেন। ছোট থেকেই চাইতেন বড় হয়ে একজন সাংবাদিক হবেন। এ জন্য বিজ্ঞান বিভাগে পড়তে আগ্রহী ছিলেন না কখনোই। তবে বাব-মায়ের ইচ্ছাতেই তার বিজ্ঞান বিভাগে পড়া। আর অনিচ্ছা নিয়ে পড়ার কারণে ফলাফলও হয় না আশানুরূপ।

এইচএসসিতে দ্বিতীয় বিভাগ পাওয়ায় পড়া হয়নি মেডিকেল কলেজ বা ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারপরও ভর্তি পরীক্ষায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেন। নিজের স্বপ্ন পূরণের পথে এগিয়ে যান একধাপ। ছাপার অক্ষরে নিজের নামটা দেখতে খুব ভালবাসতেন তিনি। ছোটবেলা থেকে লেখালেখি করতেন বিভিন্ন পত্রিকার শিশু সাহিত্য পাতায়। তবে বাবা-মায়ের একান্ত অনুগত হিসেবে সালমনের পিতা-মাতা কখনোই চাইতেন না ছেলে সাংবাদিকতার মতো একটি ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় যাক। তাই বাবা মায়ের ইচ্ছেতেই ভর্তি হন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে।

বইপাগল এই সরকারী কর্মকর্তা গল্প, উপন্যাস ও কবিতার বই পড়তে পছন্দ করেন। আর তাই ইংরেজি সাহিত্যের গল্প ও চরিত্রগুলোর সাথে খুব সহজেই পরিচিত হতে থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স -মাস্টার্সের ফলাফলে ছিলেন প্রথম পাঁচজনের মধ্যে। বাবা মো. আবদুর রহমান ছিলেন সিলেট বিভাগের প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের বিভাগীয় উপ-পরিচালক । বাবা সরকারি কর্মকর্তা হওয়ায় তার ইচ্ছেতেই মূলত সালমনের বিসিএস-এ অংশ নেয়া। তবে সারাজীবন একাডেমিক পড়াশোনা খুব একটা না করলেও বিসিএস পরীক্ষার সময় পড়াশোনা করেছেন বিস্তর। সময় বেঁধে সিলেবাস ধরে পড়াশোনা করতেন। এপিয়ার্ড (অবতীর্ন) সার্টিফিকেটে অংশ নেন ২৮ তম বিসিএসে। যদিও পরীক্ষা আশানুরূপ না হওয়ায় খুব একটা খুশি হতে পারেনননি সেসময়। এরই মাঝে প্রকাশিত হয় পরীক্ষার ফলাফল। সেখানে প্রশাসন ক্যাডারে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা হয় তাকে।

অবশ্য সেদিন ফলাফল দেখে নিজেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না অয়ন। প্রশাসন ক্যাডারে নিজের রোল নম্বরটি দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যান।

২৯ তম বিসিএসেও লিখিত পরীক্ষায় সফল হন এ কর্মকর্তা। পরবর্তীতে বুনিয়াদি প্রশিক্ষণে যোগ দেন পিএটিসিতে। সেখানে যেয়ে প্রথম দিন একেবারে হতভম্ব হয়ে যান। কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলার মাঝে হাসফাস লাগতে শুরু করে। ‘পান থেকে চুন খসলেই করা হয় শো কজ । তবে মাস দেড়েকের মধ্যেই মধ্যেই অভ্যস্ত হয়ে যাই। ভাল লাগতে শুরু করে সবকিছু। সেসময় সকালটা শুরু হতো ভোর ৫ টায়। সকালে উঠে শরীরচর্চা করা। বিকেলে বাধ্যতামূলক খেলাধূলা করা, সময়মতো নামায পড়া, খাওয়া-দাওয়া করা একময় সবকিছুই ভাল লাগতে শুরু করে। একপর্যায়ে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয় যে ট্রেনিং শেষ হয়ে গেলেও সেখান থেকে আসতে ইচ্ছা করে না।’

প্রশিক্ষণ শেষে যোগ দেন বরিশাল বিভাগে সহকারি কমিশনার হিসেবে। এরপর পটুয়াখালীতে ছিলেন, এসিল্যান্ড হিসেবে কর্মরত ছিলেন কুষ্টিয়ার মিরপুরে। ২০১৬ সালের আগস্টে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন বরিশালে আগৈলঝড়ায়। ২০১৭ সালের ৪ ঠা জুন যোগ দেন বরগুনা জেলার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে।

তিনি জানান, সরকারী দায়িত্ব পালন করতে যেয়ে বিভিন্ন সময় মুখোমুখি হতে হয়েছে ঝুঁকির। প্রতি পদে নিতে হয়েছে চ্যালেঞ্জ। অন্যান্য সরকারী চাকুরির মতো চাকুরিটা ৯টা-৫টার নয়। আর তাই সদা সচেষ্ট থাকেন দায়িত্ব পালনে। ফোন আসা মাত্রই ছুটে যান ঘটনাস্থলে। সেক্ষেত্রে গভীর রাতেও ছুটে যান দায়িত্ব পালনে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে গ্রামের মধ্যে স্বল্প সংখ্যক ফোর্স নিয়েও মাইলের পর মাইল হেঁটে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা অনেক চ্যালেঞ্জের বিষয়। অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ও ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাকালে অনেকসময় পড়তে হয় চাপের মুখে। প্রভাবশালীরা সেসময় জোর খাটানোর চেষ্টা করে। সবকিছুই মোকাবিলা করে চলেছেন সাহসিকতার সঙ্গে।

চাকুরিতে যোগদানের আগে এ সম্পর্কে খুব বেশি ধারণা ছিল না তার। এখানে এসে দেখতে পান মানুষের জন্য কাজ করার বিস্তর সুযোগ। বিষয়টা অনেক উপভোগ করেন এ কর্মকর্তা।

মেধাবী এ কর্মকর্তার প্রিয় কাজ বই পড়া। পড়তে পছন্দ করেন অনেক বেশি। আর তাই বিদেশ ট্যুরে গিয়ে অন্যান্য ব্যাচমেটরা যখন শপিং এ ব্যস্ত তখন তাকে খুঁজে পাওয়া যায় বইয়ের দোকানে।

দুটো জাতীয় পুরস্কারও রয়েছে তার ঝুলিতে। জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহে সুন্দর হাতের লেখা প্রতিযোগীতায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন তিনি। রচনা প্রতিযোগীতাতেও থানা ও জেলা পর্যায়ের প্রথম পুরস্কারটি বরাদ্দ থাকতো তার জন্যই। লেখালেখিতে সিদ্ধহস্ত এ কর্মকর্তা কবিতা লিখতে পছন্দ করেন। ‘সহজ প্রেমের কবিতা’ নামে তার একটি বইও প্রকাশিত হয়েছে বইমেলায়। পছন্দ করেন শিশুদের সঙ্গে সময় কাটাতে। আর তাই সুযোগ পেলে হাতছাড়া করেন না কখনোই। (প্রতিবেদন চ্যানেল আই অনলাইনের সৌজন্যে প্রকাশিত।)