আপনি গান কেন ছেড়ে দিলেন, আসিফকে বিচারক

‘আমরা তো একই এলাকার। আমি আপনার সবকিছুই জানি। আপনি কেন গান ছেড়ে দিলেন? গান না ছাড়লে এ ধরনের সমস্যায় পড়তেন না।’

ঢাকার অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম কেশব রায় চৌধুরী এসব কথা বলছিলেন গায়ক আসিফ আকবরকে। তখন কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ছিলেন আসিফ। এসব শুনে আসিফ তখন হাসছিলেন।

তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) আইনে দায়ের করা মামলায় গতকাল মঙ্গলবার দিবাগত রাতে গ্রেপ্তার করা হয় কণ্ঠশিল্পী আসিফ আকবরকে। শিল্পী ও সুরকার শফিক তুহিনের দায়ের করা মামলায় আসিফকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তাঁর বিরুদ্ধে গত সোমবার সন্ধ্যায় তেজগাঁও থানায় মামলাটি দায়ের করা হয়। মামলায় আসিফ আকবর ছাড়া আরো চার-পাঁচজন অজ্ঞাত আসামি রয়েছে।

বুধবার দুপুরে ২টায় আসিফ আকবরকে ঢাকার অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম কেশব রায় চৌধুরীর আদালতে হাজির করা হয়। বিচারক তাঁর জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে তাঁকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এ ছাড়া পুলিশ তাঁকে পাঁচদিনের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করেন। তবে তাও নাকচ করে দেন আদালত।

অনবরত হেসেই গেলেন আসিফ

বেলা সোয়া ১১টার দিকে আসিফ আকবরকে ঢাকা মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে নিয়ে আসা হয়। পরে তাঁকে কিছু সময় আদালতের হাজতখানায় রাখা হয়। দুপুরে ২টায় আসিফকে আদালতে হাজির করা হয়। আদালত প্রাঙ্গণে প্রবেশের পর থেকেই হাস্যোজ্জ্বল ছিলেন আসিফ। এক হাত উঁচিয়ে নাড়ছিলেন। ঠিক যেমন কনসার্টের মঞ্চে উঠার সময় দর্শক-শ্রোতাদের উদ্দেশে হাত নাড়েন!

কাঠগড়ায় আরো কয়েকজন আসামির সঙ্গে আসিফকে একই কাঠগড়ায় তোলা হয়। তখনো অন্যদের সঙ্গে আসিফ হাসছিলেন। এমনকি কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ শুনেও তিনি হাসছিলেন। রিমান্ড ও জামিন শুনানির সময় আসিফ আকবরের স্ত্রী মিতুসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা আদালতে হাজির ছিলেন। তবে তাঁদের খুব চিন্তিত দেখায়।

‘জামিন দিলে আইনের কিছু জটিলতা আছে’

বিচারক আসিফকে বলেন, ‘আপনার বাসা ফৌজদারি চৌমুহনীর (কুমিল্লার মহানগরীর একটি এলাকা) সামনে। এটা আমাদের আড্ডার এলাকা। আপনার বাংলা রেস্তোরাঁ, জিলা স্কুলের সামনে আমি অনেক আড্ডা দিয়েছি। আমরা তো একই এলাকার। আমি আপনার সবকিছুই জানি। আপনি কেন গান ছেড়ে দিলেন? গান না ছাড়লে এ ধরনের সমস্যায় পড়তেন না।’

বিচারক বলেন, ‘মামলাটি করা হয়েছে তথ্য-প্রযুক্তি আইনে। জামিন দিলে আইনের কিছু জটিলতা আছে। আমার এ মামলায় জামিন দেওয়ার বিষয়ে বাধ্যবাধকতা আছে।’

‘তিনি জামিন পেলে পলাতক হবেন না’

আসিফের আইনজীবী ওমর ফারুক আদালতের উদ্দেশে বলেন, ‘মাননীয় আদালত, গায়ক আসিফ সুখ্যাত একজন জনপ্রিয় শিল্পী। তিনি এ দেশের সুনাগরিক।’

আইনজীবী ওমর ফারুক বলেন, ‘আসিফের বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় এ মামলা হতে পারে না। একটা ভিত্তিহীন মামলা। যে অভিযোগ, তা কপিরাইট আইনের। তথ্যপ্রযুক্তি আইনে এ মামলাটি আসে না।’ তিনি আরো বলেন, ‘মামলার বাদী গীতিকার শফিক তুহিন অভিযোগ করেছেন গত ২ জুন রাতে অনুমোদন ছাড়া গান বিক্রির বিষয়টি উল্লেখ করে তাঁর ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে একটি পোস্ট দেন। তাঁর সেই পোস্টের নিচে আসিফ অশালীন মন্তব্য ও হুমকি দেন। এ ব্যাপারে মামলার কোথাও বলা হয়নি গায়ক আসিফ কী হুমকি দিয়েছেন। শুধু এ বক্তব্য দিয়েই প্রমাণ হয় না তিনি হুমকি দিয়েছেন।’

তখন বিচারক আসিফের কাছে জানতে চাইলে, আসিফ আদালতকে জানান, ফেসবুকে শফিক তুহিন তাঁর বিরুদ্ধে আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন। তিনি নিজে শফিক তুহিনের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারতেন। ফেসবুক লাইভে তিনি আগে আসেননি, শফিক তুহিন আগে এসেছেন।

আসিফের আইনজীবী ওমর ফারুক বলেন, ‘আসিফ আবারও গান শুরু করেছেন। তিনি জামিন পেলে পলাতক হবেন না। সে যদি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায় হাজারো ভক্ত তার পিছু নিবে।’

ওমর ফারুক বলেন, ‘সামনে ঈদ। ভক্তরা তাঁকে নিয়ে ঈদ করতে চায়। আর মামলায় তথ্যপ্রযুক্তি আইনের যে ধারা দেওয়া হয়েছে অভিযোগের সঙ্গে তার কোনো মিল নেই। এতে সর্বোচ্চ কপি রাইট আইনে মামলা হতে পারে।’

‘শফিক তুহিন মিথ্যাবাদী’

জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করে আসিফকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন আদালত। কারাগারে যাওয়ার সময় সাংবাদিকদের আসিফ বলেন, ‘মামলাটি আমার আগে করা উচিত ছিল। শফিক তুহিন মিথ্যাবাদী। মামলায় আমি ভীতু নই। আইনি গতিতে মামলা চালিয়ে যাব। আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। মামলায় আমি খালাস পাব।’

মামলার এজাহারে যা আছে

মামলার এজাহারে শফিক তুহিন অভিযোগ করেন, গত ১ জুন রাত ৯টার দিকে চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের ‘সার্চলাইট’ নামে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের মাধ্যমে তিনি জানতে পারেন, আসিফ আকবর অনুমতি ছাড়াই তাঁর সংগীতকর্মসহ অন্যান্য গীতিকার, সুরকার ও শিল্পীর ৬১৭টি গান সবার অজান্তে বিক্রি করেন।

অভিযোগে আরো বলা হয়, আসিফ আকবর আর্ব এন্টারটেইনমেন্টের চেয়ারম্যান হিসেবে বিভিন্ন মাধ্যমে গানগুলো ডিজিটাল রূপান্তরের মাধ্যমে ট্রু-টিউন, ওয়াপ-২, রিংটোন, পিআরবিটি, ফুলট্রেক, ওয়াল পেপার, অ্যানিমেশন, থ্রি-জি কন্টেন্ট ইত্যাদি হিসেবে বাণিজ্যিক ব্যবহার করে অসাধুভাবে ও প্রতারণার মাধ্যমে বিপুল অর্থ উপার্জন করেছেন।

পরে ওই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে শফিক তুহিন গত ২ জুন রাত ২টা ২২ মিনিটে তাঁর ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে অনুমোদন ছাড়া গান বিক্রির এ ঘটনা উল্লেখ করে একটি পোস্ট দেন। ওই পোস্টের নিচে আসিফ আকবর নিজের একটি অ্যাকাউন্ট থেকে অশালীন মন্তব্য করেন এবং হুমকি দেন।

মামলার এজাহারে আরো উল্লেখ করা হয়, পরের দিন রাত ৯টা ৫৯ মিনিটে আসিফ আকবর তাঁর প্রায় ৩২ লাখ লাইকার সমৃদ্ধ ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে লাইভে আসেন। ৫৪ মিনিট ৩৪ সেকেন্ড লাইভ ভিডিওর ২২ মিনিট থেকে তাঁর বিরুদ্ধে অবমাননাকর, অশালীন ও মিথ্যা-বানোয়াট বক্তব্য দেন।

ভিডিওতে আসিফ আকবর শফিক তুহিনকে শায়েস্তা করবেন—এ কথা বলার পাশাপাশি ভক্তদের উদ্দেশে বলেন, তাঁকে যেখানেই পাবেন, সেখানেই প্রতিহত করবেন। এই নির্দেশনা পেয়ে আসিফ আকবরের ভক্তরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁকে হত্যার হুমকি দেয়।

মামলায় আরো বলা হয়, আসিফ আকবরের এই বক্তব্য লাখ লাখ মানুষ দেখেছে। তিনি উসকানি দিয়েছেন। এতে তাঁর (শফিক তুহিন) মানহানি হয়েছে।