আরসার সঙ্গে আলোচনায় মিয়ানমারের না বসার নেপথ্যে

গত ১০ সেপ্টম্বর রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) যখন রাখাইনে অবাধ মানবিক ত্রাণ সহায়তায় বাধা না দেয়ার লক্ষ্যে মাসব্যাপি যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেয় তখন তার প্রতিক্রিয়া খুব দ্রুতই জানিয়েছিল মিয়ানমার সরকার।

ওইদিন দেশটির ডি ফ্যাক্টো নেতা অং সান সু চির মুখপাত্র জ্য তে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটারে দেয়া এক টুইট বার্তায় বলেন, ‘সন্ত্রাসীদের সঙ্গে আমাদের আলোচনার কোনো নীতি নেই।’

আরসা নামে পরিচিত এই সংগঠনকে মিয়ানমার সরকার সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। গত ২৫ আগস্ট রাখাইনে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর তল্লাশি চৌকিতে হামলার আরসাকে সন্ত্রাসী সংগঠনের তকমা লাগিয়ে দেয় মিয়ানমার। এই হামলার অভিযোগে রাখাইনে কঠোর সামরিক অভিযান শুরু হয়; যে অভিযানে এখন পর্যন্ত প্রায় ৪ লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়েছে। এর ফলে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ব্যাপক নৃশংসতা ও জাতিগত নিধনের অভিযোগ উঠেছে।

তবে পর্যবেক্ষকরা এমনকি আরসার সদস্যরাও বলছেন, সীমান্ত এলাকার বেশ কয়েকটি জাতিগত সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রেখেছে। যারা নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের স্বায়ত্ত্বশাসনের জন্য লড়াই করছে। তাদের কিছু সংগঠনকে সন্ত্রাসী বলা হলেও কেন্দ্রীয় সরকার আবার তা বলেনি।

তাহলে মিয়ানমার সরকার কীভাবে একই ক্ষেত্রে দ্বৈত আচরণ করছে? এক্ষেত্রে পার্থক্যের জায়গা হলো; কিছু সশস্ত্র জাতিগত সংখ্যালঘু সংগঠন রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের স্বায়ত্ত্বশাসনের লড়াইকে বৈধ হিসেবে দেখে; যা মিয়ানমার সরকার বেআইনি হিসেবে দেখে।

দেশটির সরকার রোহিঙ্গাদেরকে মিয়ানমারের জাতিগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না; রোহিঙ্গাদের কয়েক প্রজন্মের শেকড় আরাকানে হলেও তাদেরকে বাংলাদেশি অবৈধ অভিবাসী হিসেবে মনে করে। এখন তাদের সঙ্গে আলোচনায় যদি বসা হয় তাহলে সেটি রোহিঙ্গাদেরকে পরোক্ষভাবে স্বীকৃতি দেয়া হবে।

দেশটির নেতা অং সান সু চি নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) মুখপাত্র নিয়ন উইন বলেন, ‘তারা আমাদের জাতিগত গোষ্ঠী নয়। তারা জাতিগত হওয়ার দাবি করে। কিন্তু আমরা তাদেরকে এই স্বীকৃতি দিতে পারি না। আমাদের ইতিহাসে কোনো রোহিঙ্গা নেই।’

মিয়ানমারে বসবাসকারী আরো কয়েকটি জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, কারেন অথবা কাচিন অথবা শানদের থেকে এরা আলাদা। আর ‘আরসা’ হচ্ছে শুধুই বিদ্রোহী।

নিয়ন উইন বলেন, ‘রাখাইন প্রদেশে তারা বিশৃঙ্খলা তৈরি করছে এবং তারপর তারা যুদ্ধবিরতির কথা বলছে। তারা কী বুঝাতে চাচ্ছে; তা আমরা বুঝতে পারছি না।’

আরসাকে মিয়ানমার যে ভিন্নদৃষ্টিতে দেখে সেই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন তিনি। বৌদ্ধসংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমারে একমাত্র মুসলিম গোষ্ঠী হচ্ছে রোহিঙ্গারা। জাতিগত অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো রাখাইনের বিদ্রোহের ঘটনায় একই সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করছে। তবে তারা নিজেদেরকে আরসা থেকে দূরে রাখতে সক্ষম হয়েছে।

বেশ কয়েকটি জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন ইউএনএফসি’র চেয়ারম্যান নাই হং সার চলতি মাসের শুরুর দিকে বলেন, আমরা ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটির স্বীকৃতি দেই না।

ইউনাইটেড ন্যাশনালিটিজ ফেডারেল কাউন্সিল; যা সংক্ষেপে ইউএনএফসি নামে পরিচিত। যদিও এই সংগঠনটি মিয়ানমারে চলমান শান্তি আলোচনায় জড়িত সব পক্ষের প্রতিনিধিত্ব করে না। তবে সংগঠনটির বক্তব্য দেশটির সেনাবাহিনী, সরকার এবং কয়েকটি জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীর মধ্যে বিরল ঐক্যের কথা বলে।

মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলের জাতিগত পলাং সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্বকারী ট্যাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মির (টিএনএলএ) মহাসচিব ট্যার বোনে কিয়াও বলেন, ‘আমরা দেখেছি আরসা একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। কারণ তাদের কার্যকলাপ। আরসার বিরুদ্ধে বেসামরিক মানুষ হত্যার অভিযোগ রয়েছে।’ তবে আরসা এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে।

‘তার যেভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করে তা সন্ত্রাসীদের কর্মকাণ্ডের মতো। যে কারণে আমরা তাদেরকে বিপ্লবী গোষ্ঠী বা এরকম কোনো সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করতে পারি না। সুতরাং তারা শুধুমাত্র সন্ত্রাসী। রোহিঙ্গা সংগঠনের ব্যাপারে আমাদের মতামত এটাই।’

একই সময়ে রাখাইন প্রদেশে সেনাবাহিনীর অভিযানেরও নিন্দা জানান ট্যার বোনে কিয়াও। তিনি বলেন, এই অভিযানের মূল্য দিতে হচ্ছে অনেক মানুষের জীবনের বিনিময়ে। বেসামরিক নয়, সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে বলে দাবি করে দায় সাড়ছে সেনাবাহিনী।

ট্যার বোনে কিয়াও বলেন, অন্যান্য সংঘাতের ক্ষেত্রেও জাতিগত গোষ্ঠীগুলোকে স্বীকৃতি দেয় না টিএনএলএ। ‘বার্মায় কোনো রোহিঙ্গা নেই। তারা হচ্ছে বাঙালি। তারা বাংলাদেশ থেকে এসেছে। সুতরাং তারা বার্মার জাতিগত আদিবাসী নয়।’

সোমবার অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠনগুলোর সঙ্গে যোগাযাগ করা সম্ভব হয়নি। রাখাইন প্রদেশে বসবাসকারী দশ লাখের বেশি সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদেরকে নাগরিকত্বের স্বীকৃতি দেয়নি মিয়ানমার। আরসা বলছে, তারা শুধুমাত্র রোহিঙ্গাদের মৌলিক মানবাধিকারের জন্য লড়াই করছে। মিয়ানমারের নিরাপত্তা সূত্রগুলো বলছে, রাখাইনে একটি ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে আরসা।

গত ২৫ আগস্ট রাখাইনে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার পর লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়েছে। রাখাইনের এই সহিংসতায় বৌদ্ধ, হিন্দুরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে দাবি করেছে মিয়ানমার।

সোমবার মিয়ানমার সেনাবাহিনী বলছে, রাখাইনের উত্তরাঞ্চলে একটি গণকবর থেকে ২৮ হিন্দুর মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। রোহিঙ্গা বিদ্রোহীরাই এই হিন্দুদের হত্যার পর গণকবর দিয়েছে বলে দাবি করেছে সেনাবাহিনী। আরসা এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে বলে বার্তাসংস্থা রয়টার্স এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে।