আলুর কেজি ১ টাকা!
বগুড়ায় আলুর বাজারে ব্যাপক ধস নেমেছে। ৮৪ কেজির এক বস্তা আলুর দাম ৯০ থেকে ১০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এতেও মিলছে না গ্রাহক।
এ অবস্থায় মজুদ করা আলু হিমাগার থেকে তুলছেন ব্যবসায়ীরা। আলু নিয়ে বিপাকে তারা। বগুড়ার ৩৩ হিমাগারে থাকা আলুতে ১০০ কোটি টাকার লোকসানের আশঙ্কা করছেন তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ১৬-১৭ মৌসুমে বগুড়া অঞ্চলে আলুর বাম্পার ফলন হয়েছিল। ভালো দামের আশায় ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ আলু কিনে মজুদ করে রাখে।
গত ৩ মৌসুমে উত্তরাঞ্চলে আলুর ভালো ফলনের পাশাপাশি বছরজুড়ে দামও ছিল ভালো। মৌসুমের শুরুতে তুলনামূলক কম দামে আলু কিনে পরে বেশি দামে বিক্রি করেছেন মজুদদাররা। এবার সেই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন তারা।
গেল মৌসুমে উৎপাদিত আলুর বেশির ভাগ জমা পড়ে হিমাগারে। এতে আগের মৌসুম শেষ হয়ে নতুন মৌসুম শুরুর আগেই সবাই একযোগে আলু বাজারজাত করতে গিয়ে বিপাকে পড়ে। হঠাৎ করেই আলুর দাম তলানিতে নেমে যায়। ১ টাকা থেকে দেড় টাকা কেজিতে নেমে আসে আলুর দাম।
বগুড়া কৃষি আঞ্চলিক অফিসের দেয়া তথ্যে জানা গেছে, ২০১৬-১৭ কৃষি মৌসুমে উত্তরের চার জেলা বগুড়া, জয়পুরহাট, পাবনা, সিরাজগঞ্জে আলুর চাষ হয়েছিল ১ লাখ ১৪ হাজার ১৬ হেক্টর জমিতে। উৎপাদন হয়েছিল ২৩ লাখ ৫০ হাজার ২ মেট্রিক টন।
চলতি মৌসুমে আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা আছে ১ লাখ ১০ হাজার ৪১০ হেক্টর জমি। ইতোমধ্যে চাষ হয়েছে ৪৭ হাজার ৩২৩ হেক্টর জমিতে। আগাম জাতের আলু উত্তোলন হয়েছে ১০০ হেক্টর। উৎপাদন প্রতি হেক্টরে ১৪ মেট্রিক টন।
গত মৌসুমে পর্যাপ্ত মজুদ এবং চলতি মৌসুমে নতুন আলু উত্তোলনের ফলে পুরনো আলু হিমাগার থেকে নিচ্ছে না কৃষকরা। দাম না থাকায় কৃষকদের বস্তাপ্রতি লোকসান গুনতে হচ্ছে ১ হাজার ৩০০ টাকা। এক বস্তা লালশীল আলু মৌসুমে ক্রয় ও ভাড়াসহ খরচ হয়েছে ১৫৫০ টাকা, আর এ বছর তা বিক্রি হয়েছে কখনো ৫০০-৪০০-২০০ টাকায়। সম্প্রতি ১ বস্তা আলু ১০০ টাকায়ও নিচ্ছেন না কৃষকরা।
উত্তরাঞ্চলের শস্যভান্ডার নামে খ্যাত শিবগঞ্জ উপজেলায়র ১৪টি কোল্ডস্টো রেজের প্রতিটির ধারণক্ষমতা ১ লাখ থেকে দেড় লাখ বস্তা। গড়ে শিবগঞ্জে আলু মজুতের পরিমাণ ১৫ লাখ বস্তা যা ব্যবসায়ী ও কৃষক মিলে সংরক্ষণ করেছেন। এসব স্টোরে প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ আলু এখনও পড়ে আছে।
বগুড়া জেলায় মোট কোল্ডস্টোরেজ আছে ৩৩টি। যার প্রতিটিতে ১ থেকে ২ লাখ বস্তা ধারণক্ষমতা। প্রতি বস্তায় ৮৪ কেজি আলু থাকে। যার মূল্য বর্তমানে ৯০ থেকে ১০০ টাকা।
শিবগঞ্জ সদরে অবস্থিত নিউ কাফেলা কোল্ড স্টোরেজের ক্যাশিয়ার আখতারুজ্জামান জানান, চলতি মৌসুমে ১ লাখ বস্তা আলু সংরক্ষণ করা আছে। এর মধ্যে ৭৪ হাজার বস্তা আলু কৃষক ও ব্যবসায়ীদের সরবরাহ করা হয়েছে। বাকি ২৬ হাজার বস্তা আলু ব্যবসায়ী ও কৃষক কেউ নিতে আসছে না। মজুদকৃত মোট আলুর ৫০ ভাগের বিপরীতে ব্যবসায়ী ও কৃষকদের সহজ শর্তে ঋণও দেয়া আছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো কৃষক ও ব্যবসায়ী ঋণের টাকা পরিশোধ করেননি।
আখতারুজ্জামান জানান, প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০ বস্তা আলু পচে নষ্ট হচ্ছে। এগুলো বাছাই করছেন নারী শ্রমিকরা। দাম কম থাকায় স্টোরগুলোতে বিদ্যুৎ সরবরাহ সীমিত করা হয়েছে। নিউ কাফেলা কোল্ডস্টোরে বিগত ৯ মাসে বিদ্যুৎ বিল এসেছে ৮৬ লাখ টাকা। এছাড়া প্রশাসনিক খরচ, কর্মচারীদের বেতন বিল মিলে ৬০ লাখ টাকা দেয়া হয়েছে। এই কোল্ডস্টোরে চলতি মৌসুমে প্রায় ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা লোকসান গুনতে হবে।
একই অবস্থা কোল্ডস্টোরেজ হিমাদ্রীর। এর ধারণক্ষমতা ৯৫ হাজার বস্তা এবং অধিকাংশই বীজ আলু। দীর্ঘদিন ধরে এই স্টোরের সুনাম আছে। কিন্তু এখানেও ১২ হাজারের বেশি বস্তা আলু অবিক্রিত রয়েছে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে কোল্ডস্টোরেজের জিএম আব্দুল করিম বলেন, কেউ আলু নিতে আসছে না। মজুদকৃত আলুর বিপরীতে ৪০ শতাংশ হারে লোন দেয়া আছে। কিন্তু লোন পরিশোধ তো দূরের কথা, স্টোরের কাছে আসছেন না গ্রাহক ও ব্যবসায়ীরা।
এদিকে, শিবগঞ্জের দোপাড়া গ্রামের কৃষক আব্দুল আজিজ এই মৌসুমে ১ হাজার ৫০০ বস্তা আলু ব্যবসার উদ্দেশ্যে সংরক্ষণ করেন। এর আনুমানিক মূল্য ২২ লাখ ৬৬ টি হাজার ৫০০ টাকা। কিন্তু আলু বিক্রি করেছেন মাত্র ২ লাখ ৫৬ হাজার টাকার। এই কৃষকের তহবিল থেকে ২০ লাখ টাকা লাপাত্তা হয়ে গেছে। এ রকম আরও বহু কৃষকের একই দশা।
বগুড়ার প্রতিটি উপজেলায় চারদিকে সবুজ ছাতার বেষ্টনীর মতো গড়ে উঠেছে এসব শিল্প। এর মধ্যে শিবগঞ্জে বেশি। এর মধ্যে রয়েছে মোকামতলা এএইচজেড কোল্ডস্টোর, আগমনী কোল্ডস্টোর মহাস্থান, শাহা হিমাদ্রী উথলি বাজার, হিমাদ্রী লি. সাদুরিয়া, আফাকু কিচক, হিমাদ্রী শিবগঞ্জ, নিউ কাফেলা শিবগঞ্জ, কাজী কোল্ডস্টোর শোলাগাড়ী, মাহমুদিয়া জামুর হাট, মালটি পারপাস ধনতলা, শাহ সুলতান খয়রা পুকুর, নিউ জনতা বুড়িগঞ্জ। চলতি মৌসুমে লোকসানের ছোবল থেকে রেহায় পায়নি এসব শিল্পের কোনোটি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিবগঞ্জে কৃষি বিভাগের কর্মী কামাল হোসেন জানান, গত বছরে শিবগঞ্জে ১৮ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়েছিল। কিন্তু এই অবস্থা চলতে থাকলে চলতি মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক প্রতুল চন্দ্র সরকার বলেন, গত মৌসুমে বগুড়ায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ১ লাখ টন আলু বেশি উৎপাদন হয়েছিল। ফলে বর্তমানে পুরনো আলুর দাম কমেছে। বর্তমানে নতুন মৌসুমে কৃষকরা আলু লাগাতে শুরু করেছে। হিমাগার থেকে কিছু আলু বীজ হিসেবে বের হয়ে আসবে। তখন পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হবে।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন