ইঁদুরে বাঁধ খাওয়া দিনগুলিতে উন্নয়নের বন্যা

ফারুক ওয়াসিফ : এটা সব সময়ই ইঁদুর আর মশা। চিকুনগুনিয়া মহামারির সব দায় মশা মহাশয়ের। হাজারো মানুষের কষ্টের দায় তারা নিজেদের ফিনফিনে শরীরে বহন করে নগরপিতাদের মুখরক্ষা করেছেন। এবারের বন্যায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) মুখ ও পিঠ দুটিই বাঁচানোর ভার নিয়েছে ইঁদুর সম্প্রদায়। উনাদের চিকন দাঁতের গ্রাস থেকে শক্তিমান বাঁধগুলো আত্মরক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। ইঁদুরের গর্তে ঝাঁঝরা বাঁধ বানের পানির চাপে শাদ্দাদের বেহেশতের মতো ধসে গেছে। হাওরের বাঁধ, উত্তরবঙ্গের বাঁধ, কিংবা উপকূলীয় বাঁধ—কোনোটিই এই পরাশক্তির হাতে নিরাপদ নয়। পাউবো এবং তাদের ঠিকাদার কাম রাজনীতিক এবং রাজনীতিক কাম ঠিকাদারেরা এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ মাসুম। তাঁদের কিছুই করার নাই। এভাবে উন্নয়ন ফুটো করে দিচ্ছে ইঁদুর বাহিনী। কোটি কোটি টাকার বাঁধ আর গুদামের বস্তা ফুটো করা ইঁদুরই এখন আমাদের জাতীয় শত্রু। এমন ইঁদুরাক্রান্ত উন্নয়ন কি আমরা চেয়েছিলাম?

ইঁদুরপ্রুফ উন্নয়নের উপায় বের করা তাই কোটি টাকার প্রশ্ন। উত্তরের খোঁজে শতকোটি টাকা ব্যয় না হলে গবেষণার ইজ্জতই থাকে না। নেদারল্যান্ডসের বাঁধগুলো কীভাবে ইঁদুরপ্রুফ করা হলো, সেটা দেখতে মন্ত্রী-আমলাদের একটা বহর সাততাড়াতাড়ি সে দেশে পাঠানো দরকার। অবশ্য পছন্দের অন্য কোনো দেশেও তাঁরা যেতে পারেন, জ্ঞানের জন্য যত দূরে পারা যায় তত দূরে যাওয়াই শ্রেয়। এ ব্যাপারে আমরা অতীতেও কার্পণ্য করিনি, ভবিষ্যতেও করব না।

ইঁদুরের আপদের মধ্যে যখন আমাদের পড়তেই হচ্ছে, তখন হাটবাজারের ইঁদুর মারা বিষ বিক্রেতাদের হাত-পা ধরা ভালো। চোঙা ফুঁকে ‘ইঁদুরের বংশ বিষে হবে ধ্বংস’ বলে তাঁরা কত যে চিৎকার করে গেলেন, আমরা শুনলাম না। আমরা শুনলাম বড় কর্তাদের শত-হাজার কোটি টাকার উন্নয়নের কথা। এখন উচিত তওবা করে বাঁধ প্রতিরক্ষার কাজ থেকে পাউবোকে ছুটি দিয়ে ওই ক্যানভাসারদের হাতে তুলে দেওয়া। চড়া বেতনের কড়া আমলারা যেহেতু ব্যর্থ, সেহেতু ইঁদুরের বিষই আমাদের ভরসা।

হাওরের বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম ও দুর্নীতির মামলায় সুনামগঞ্জের যুবলীগ নেতা ঠিকাদার খায়রুল হুদা চপলকে বিমানবন্দর থেকে আটক করাটা তাই ঠিক হয়নি। ইঁদুর-মশা-তেলাপোকা এদের যে–কাউকে ‘জজ মিয়া’ সাজিয়ে তার ঘাড়ে দোষ চাপালেই তো চলত। গত বছর পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলীসহ একগাদা কর্মকর্তাকে সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা দায়ী করে। অথচ পাউবো ইঁদুর ছাড়া কারও কোনো দোষ পায়নি। এবারের বন্যার জন্যও খোদ প্রকৃতিকেই ‘জজ মিয়া’ বানানো যায়। বেশি বৃষ্টির দোষ তো প্রকৃতিরই। উজান থেকে ঢল নামার দায়ও প্রকৃতির। তিরিশেরও বেশি আদমসন্তানের মৃত্যুর দায়ও প্রকৃতির। প্রকৃতির সন্তান প্রকৃতি নিয়ে গেছে, আমরা ভেবে করব কী? গজলডোবা ব্যারাজ ও ফারাক্কা বাঁধের সব কটি দরজা খুলে দেওয়া কিছু নয়, বাংলাদেশের নদীগুলো ড্রেজিং না করা নয়, বন্যার প্রবাহভূমিতে দালান-মার্কেট-ভবন বানিয়ে পানি নামার পথ বন্ধ করা নয়, বাঁধগুলো রক্ষণাবেক্ষণের টাকা মেরে দেওয়া নয়, ভাড়াটে বিশেষজ্ঞদের গোঁজামিলের পরামর্শ নয়; প্রকৃতিই হলো আসল দুশমন!

প্রকৃতি শুধু খারাপই নয়, মারাত্মক বুর্জোয়াও বটে। দুর্ভিক্ষ ও মহামারির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগও ভীষণ গরিববিরোধী এবং শ্রেণিবৈষম্যবাদী। বন্যা-পাহাড়ধস-জলোচ্ছ্বাস বেছে বেছে গরিবদেরই আক্রমণ করে। এখানে সরকারের বা রাষ্ট্রের কোনো দায় খোঁজা ঠিক না। এসবের ওপর তো মানুষের কোনো হাত নাই। এ জন্যই তো এর নাম প্রাকৃতিক দুর্যোগ। পাহাড়ধস, নদীমৃত্যু, পরিবেশ ধ্বংসের জন্যও কেউ দায়ী না। প্রকৃতিকে কেউ হত্যা করছে না, প্রকৃতি নিজেই আত্মহত্যা করছে। প্রকৃতির এই হত্যা ও আত্মহত্যার কুপ্রভাব থেকে মানুষকে বাঁচাতেই তো সরকার, ব্যবসায়ী, বিশেষজ্ঞরা জোট বেঁধে প্রকৃতির বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। অনন্ত যুদ্ধের এই ধারণাটা তাঁরা পেয়েছেন মহান মার্কিন প্রেসিডেন্ট কনিষ্ঠ জর্জ বুশের কাছ থেকে। এ বাবদ তাঁর কাছেও আমরা ঋণী।

আজকে অনেকে বুঝতে পারেন না, কিন্তু একদিন তাঁদের দূরদর্শিতা সবাই বুঝতে পারবে। পাহাড়গুলো যদি কেটে কেটে সমান করা হয়, তাহলে তো আর পাহাড়ধস বলে কিছু থাকবে না। যদি দেশের নদীগুলোকে বুজিয়ে ফেলা যায়, প্রতিবেশী দেশ যদি নদীর পানি অন্যদিকে সরিয়ে নিয়ে যায়, তাহলে তো বন্যার বালাইও থাকে না। টিপাইমুখ বাঁধবিরোধী আন্দোলনের সময় এ কথাটাই বোঝাতে চেয়েছিলেন আওয়ামী লীগের কুড়িগ্রাম অঞ্চলের এক নেতা। তিনি বলেছিলেন, তিস্তা নদী না থাকলে কী সমস্যা? সৌদি আরবে তো নদী নেই, তাতে তো তাদের সমস্যা হচ্ছে না। মানুষ তাঁকে ভুল বুঝেছিল। বাঙালি এমনই, সত্যিকার জনবন্ধুদের চিনতে দেরি করে। দেশ মরুভূমি হলে তেল পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, আর অতি বন্যা হলে বন্যার পরে উন্নয়নের দরজা খুলে যায়। বুঝতে হবে।

একইভাবে সুন্দরবন না থাকলেও ভালো। বন থাকলেই আশপাশে মানুষ থাকবে, জেলে সম্প্রদায় থাকবে, পশুপাখি থাকবে। সেখানে যদি কয়লাবিদ্যুৎ কারখানা ও শত শত শিল্প-কারখানা হয়, তাহলে তো বনজীবী, কৃষক, জেলে কিংবা বাঘ-হরিণ কিছুই থাকতে পারবে না। সুন্দরবনকেও তাহলে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের বিরুদ্ধে প্রাকৃতিক দেয়ালগিরির অবৈতনিক চাকরি করতে হয় না।

আসলে দৃষ্টিভঙ্গিটা বদলালেই দুনিয়াটা বদলে যাবে। বাঁধ-সড়ক-সেতু নির্মাণে দুর্নীতির তত্ত্ব-তালাশ ছেড়ে ইঁদুরসন্ধানী হওয়া দরকার। তবে একেবারেই সব ইঁদুর মেরে ফেলা ঠিক হবে না। উন্নয়নের এই গৌরবযাত্রাকে দীর্ঘ করতে কিছু ইঁদুর রাখতে হবে। তারা যদি গর্ত না-ই খুঁড়বে, তাহলে বছর বছর বাঁধ-সড়ক-সেতু বানানোর বাজেট বাড়ানো যাবে কী করে? আর বাজেটা বাড়ানো মানে ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত ট্রিকল ডাউন ইফেক্টে চুইয়ে চুইয়ে সবার পাতেই কিছু না কিছু ঝোল জুটবে।

বাঁধের ইঁদুর আমাদের কত কিছুই না শেখাল। সমাজের ইঁদুরেরা তাদের থেকে প্রেরণা নিতে পারেন। জয় ইঁদুরতন্ত্র, জয় প্রকৃতির বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ।

পুনশ্চ: ইতিহাসের বুড়ো সাক্ষি আমাদের জানায়: ইঁদুরবাহিত প্লেগরোগে অনেক জনপদ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল আবার ইঁদুর তাড়ানো সেই হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালারাও যুগে যুগে দেখা দিয়েছিল। সূত্র : প্রথম আলো

 লেখক : সাংবাদিক।