ইন্টারপোলের নাগালে যুদ্ধাপরাধী মুঈনুদ্দীন : দ্য সান

বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী চৌধুরী মুঈনুদ্দীনকে দেশে ফিরে আনার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। যুক্তরাজ্যে অবস্থান করা একাত্তরের এই আলবদর নেতা আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের হাতের নাগালেই আছে বলে জানিয়েছে ব্রিটিশ ট্যাবলয়েড পত্রিকা দ্য সান।

বুধবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দিনের আলোয় কুখ্যাত এই আলবদর নেতার নির্বিকার ঘুরে বেড়ানোর বেশ কিছু ছবি প্রকাশ করে তাকে ধরতে ইন্টারপোলের আদৌ কোনো তৎপরতা আছে কি না, সে ব্যপারেই প্রশ্ন করেছে পত্রিকাটি।

২০১৫ সালে যুদ্ধাপরাধ মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আলবদর নেতা চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের ঠিকানা নিশ্চিত করতে ইন্টারপোলের সহায়তা চেয়েছিল বাংলাদেশ। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ইন্টারপোল তাদের মোস্ট ওয়ান্টেড বা ফেরারি আসামির তালিকায় মুঈনুদ্দীনের নাম দেয়। এ ব্যাপারে তারা লন্ডনে খোঁজ খবরও করেন। তবে পরবর্তীতে তারা এ নিয়ে বাংলাদেশকে সাহায্য করতে খুব একটা তৎপরতা দেখায়নি।

বৃটিশ পত্রিকা ‘দ্য সান’ লন্ডনে ইন্টারপোলের মোস্ট ওয়ান্টেড লিস্ট নিয়ে একটি প্রতিবেদন করেছে সম্প্রতি। সেই প্রতিবেদন করতে গিয়ে তারা চৌধুরী মুঈনুদ্দীনকে খুব সহজেই খুঁজে পায় উত্তর লন্ডনের রাস্তায়। সেখান তার দশ লাখ পাউন্ডের প্রাসাদোপম বাড়ির ঠিকানাও রয়েছে তাদের হাতে। আর দশজন সাধারণ নাগরিকের মতই প্রকাশ্যে ঘুরে ফিরে বেড়াতে দেখে।

মুঈনুদ্দীনের এক প্রতিবেশিকে বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন-“ইন্টারপোল মনে হয়না ঠিক মতন খোঁজ করছে। তাকে তো আমরা সব সময়ই চোখের সামনে দেখছি।“ তখনই ‘দ্য সান’ চৌধুরী মুঈনুদ্দীনকে ধরার ব্যাপারে ইন্টারপোলের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।

‘দ্য সান’ বলছে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরই মুঈনুদ্দীন পালিয়ে পাকিস্তান চলে যান। সেখান থেকে যান যুক্তরাজ্যে। এখন পর্যন্ত তিনি লন্ডনেই অবস্থান করছেন। লন্ডনে জামায়াতের সংগঠন দাওয়াতুল ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি লন্ডনভিত্তিক সাপ্তাহিক দাওয়াতের বিশেষ সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছেন। ৬৯ বছর বয়সী মুঈন ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের একজন সাবেক পরিচালক, মুসলিম এইডের ট্রাস্টি এবং টটেনহ্যাম মসজিদ পর্ষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন।

শুধু খুঁজে বের করা নয়, ‘দ্য সান’ চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের সঙ্গে কথাও বলেছে। কুখ্যাত এই আলবদর নেতা বাংলাদেশের আদালতে তার বিচারের রায় এবং ইন্টারপোলের ফেরারি আসামির তালিকায় তার নাম থাকা নিয়ে মন্তব্য করেন-“এসব ফালতু ব্যাপার!”

মুঈনুদ্দীনের পক্ষের আইনজীবী টবি ক্যাডম্যানের সঙ্গেও কথা হয় ‘দ্য সান’ এর। টবি ক্যাডম্যান জানান, তিনি জানতেন না যে ইন্টারপোলের তালিকায় মুঈনুদ্দীনের নাম রয়েছে। ‘দ্য সান’ এর কাছ থেকে জানার পর ইতোমধ্যেই তিনি তার মক্কেলের তালিকা থেকে নাম সরাতে আবেদন করেছেন। ক্যাডম্যান বলেন “এটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে বাংলাদেশ সরকার ইন্টারপোলের ফেরারি আসামির তালিকাকে প্রভাবিত করেছে। রিভিউ করা হলেই তালিকা থেকে তার নাম সরিয়ে নেয়া হবে বলে আমার বিশ্বাস।”

সেই সঙ্গে মুঈনুদ্দীনের আইনজীবী এও বলেন “মুঈনুদ্দীনকে একটি ত্রুটিপূর্ণ বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ফাঁসির রায় দেয়া হয় যেখানে তার আপিল করার সুযোগও রাখা হয়নি। বাংলাদেশ সরকারের উচিৎ হবে লন্ডন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করা। যদিও কোনো বিচারকই মুঈনুদ্দীনকে ফিরিয়ে দিতে সম্মত হবেন না।“

২০১০ সালে ট্রাইব্যুনাল গঠন করে যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরুর পর মুঈনুদ্দীনের বিরুদ্ধেও তদন্ত শুরু হয়। তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের তদন্ত করেন ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তা মো. আতাউর রহমান।

মুঈনুদ্দীনের বিরুদ্ধে আনা ১১টি অভিযোগের সবগুলোই প্রমাণিত হওয়ায় ২০১৩ সালের ৩ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করার আদেশ দেন। বর্তমানে যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত এই আসামি আত্মসমর্পণ অথবা গ্রেপ্তারের পর তার সাজা কার্যকর করা হবে বলেও জানান ট্রাইব্যুনাল।

আত্মস্বীকৃত এবং দণ্ডপ্রাপ্ত এই যুদ্ধাপরাধী একাত্তরে ‘পাকিস্তানের অখণ্ডতার’ পক্ষে থাকার কথা নিজের ওয়েবসাইটে দেন। বাংলাদেশের চূড়ান্ত বিজয়ের পূর্বক্ষণে জাতিকে মেধাশূন্য করার নীলনকশা বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দেন চৌধুরী তিনি।

আলবদরের এই নেতার রায়ের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল জানায়, ‘একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের মূল নায়ক ছিলেন তিনি। এই নৃশংস অপরাধের জন্য তিনি শুধু এবং শুধুমাত্র ফাঁসির যোগ্য। তাদের মৃত্যুদণ্ড না হলে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে না।’

রায়ের অভিমতে বলা হয়, ফেনী জেলার পুলিশের বিশেষ শাখার প্রতিবেদন অনুযায়ী জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলে চৌধুরী মুঈনুদ্দীন পাকিস্তানি দূতাবাসের গাড়িতে করে নিজ গ্রামে গেছেন। এটা জাতির জন্য অত্যন্ত লজ্জাকর, তাদের (জিয়াউর রহমান ও এরশাদের) শাসনামলে চৌধুরী মুঈনুদ্দীন যে মুক্তিযুদ্ধের পরে লুকিয়ে ছিল এবং পরে পালিয়ে যায় তাকে রাষ্ট্রীয় পুলিশ প্রোটেকশন দিয়ে তার নিজ গ্রামে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছিল। মুঈনুদ্দীনকে তিরস্কার করার পরিবর্তে তাকে রাষ্ট্রীয় সম্মান দেখানো হয়েছে। এটা লজ্জার, শুধুই লজ্জার। এটা জাতিকে গভীরভাবে নাড়া দেয়।