ঈদ আনন্দ বঞ্চিত গাইবান্ধার চরাঞ্চলের মানুষেরা!
ঈদের আনন্দ ছিলো না গাইবান্ধার তিস্তা-ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদী বেষ্টিত চরাঞ্চলের মানুষের মাঝে। কখনো খরা কখনো বন্যা আর নদী ভাঙনের সঙ্গে জীবন যুদ্ধে যেন পরাজিত সৈনিক তারা। তাই ঈদ কখন আশে কখন যায় বুঝেই উঠতে পারে না তারা। মাছ-মাংস তো দূরের কথা ঈদের দিন সেমাই, চিনিও জোটে না তাদের কপালে।
সাঘাটা উপজেলার সাঘাটা ইউনিয়নের গোবিন্দির গ্রামের লাল মিয়া রাহেলা দম্পতি। লাল মিয়ার বাবা ইঞ্জিন ব্যপারির রেখে যাওয়া চার বিঘা জমিতেই চলছিল সুখের সংসার। ১৯৮০ সালে যমুনার গর্ভে ভিটে মাটি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায়। কয়েক বছর পর ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যার পর সেই ভিটায় চর জাগে। তবে নতুন চরে বসতি স্থাপনের স্বপ্ন আর সুখ কপালে সয়নি। ১৯৯২ সালের বন্যায় নদী ভাঙনের তীব্রতায় আবারও বসত ভিটা নদীতে বিলিন হয় যায়। এর পর থেকে সংসারের অভাব আর যায়নি।
১৯৯৩ সালে মাথা গোজার একটু জায়গা কিনে বসত-বাড়ি তৈরির পর ভালোই চলছিল সংসার। তবে তিন বছর পার না হতেই ১৯৯৬ সালের বন্যায় সেই বাড়িটিও যমুনার গর্ভে বিলিন হয়ে যায়। এরপর থেকে বন্যা আর ভয়াবহ নদী ভাঙনে বছরের পর বছর চলে জীবন যুদ্ধ। দিন মজুরের কাজ করে পেট চললেও বয়স বেশির কারণে কাজ করতে না পেরে মানবেতর চলছে জীবন।
সংসার জীবনে লাল মিয়া রাহেলা দম্পতির চার ছেলে। প্রথম ছেলে আলী আজম, দ্বিতীয় ছেলে আছির উদ্দিন, তৃতীয় ছেলে গোলাম হোসেন ও চতুর্থ ছেলে বাবু মিয়া। ছেলেদের নিয়ে গোবিন্দি গুচ্ছ গ্রামে আশ্রয় নিলেও ছেলেরা বাবা-মায়ের খবর রাখে না। তাই ঈদের দিন রান্না করার মতো সেমাই-চিনিও জোটেনি তাদের।
ঈদ কেমন কাটেছে জানতে চাইলে কান্না ভেজা কণ্ঠে লাল মিয়া বলেন, ‘ঈদের আনন্দ হামাগেরে কপালে নাই। হামাগেরে টাকা নাই, ঈদ ক্যামনে করি। হামাগেরে কপালের সুখ কেড়ে নিয়েছে যমুনা নদী। হামরা কেমন আছি আর কী করি কেউ খোঁজ নেয় না। হামাগেরে ঈদ নাই বাহে।’
লাল মিয়ার স্ত্রী রাহেলা বেগম বলেন, ‘কষ্টের কথা বলতে শরম লাগে, কি যে কষ্টে আছি বাবা-মন জানে। জমিগুলো যদি থাকতো তাহলে ঘরের ভাত খেতাম। এতো কষ্ট করতে হতো না। এখন পরের জমিতে দিন মজুরের কাজ করতে হয়। এক মাস রোজা করেছি একট টুকরো মাংসও খেতে পারিনি। অনেক কষ্টে রোজা করার পর ঈদ আমারদের জন্য অভিশাপ মনে হয়। কারণ ঈদের দিন পারি না কিছু খেতে, পারি না নতুন কাপড় পরতে।’
লাল মিয়ার ছোট ছেলে বাবু মিয়া বলেন, চরে অনেক কষ্টে জীবন যাপন করি। কেউ আসে না খোঁজ নিতে। বাবা-মাকে দেখার মতো সাধ্য নেই। কারণ নিজের সংসার চলে না। নিজেও দুই বেলা ঠিকমতো খেতে পারি না। বাবার-মার জন্য কী আর করবো। সরকার যা দেয় তা আমাদের কাছে পৌঁছার আগেই শেষ হয়ে যায়।’
যমুনার করাল গ্রাসে ভিটে মাটি হারানো লাল মিয়ার মতো হাজারও মানুষ উপভোগ করতে পারে না ঈদ আনন্দ। গাইবান্ধার তিস্তা-ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদী বেষ্টিত প্রায় ৮২টি চরের একই চিত্র। তাদের শিশু সন্তানরা জানেই না ঈদ মানে আনন্দ। তাই তাদের জন্য প্রতিবছর ঈদ যেন অভিশাপ হয়ে আসে।
সাঘাটা উপজেল প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মিঠুন কুন্ডু বলেন, ঈদের আগে সরকারিভাবে দুঃস্থ অসহায় ১৫ হাজার ১৬০ পরিবারকে ভিজিটির ৪৫০ টাকা পাঁচ হাজার ৫৫০ জনকে মানবিক সহায়তার ৪৫০ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়াও চারশ পরিবারকে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের প্যাকেট বিতরণ করা হয়েছে।
গাইবান্ধা জেলা প্রশাসক মো. আব্দুল মতিন বলেন, ‘ঈদের আগে গাইবান্ধার চরাঞ্চলসহ সব ইউনিয়নেই ভিজিএফ ও সরকারের মানবিক সহায়াতার ৪৫০ টাকা বিরতণ করা হয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন পেশার মানুষের মাঝেও মানবিক সহায়তা প্রধানমন্ত্রীর উপহার সামগ্রী ও করোনা কালীন নগদ অর্থ বিতরণ অব্যহত রয়েছে।’
জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার ও গাইবান্ধা-৫ (সাঘাটা-ফুলছড়ি) আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বী মিয়া বলেন, চরের মানুষের জীবন মান উন্নয়নে ‘চর উন্নয়ন বোর্ড’ গঠন করতে বেশ কিছু খসড়া প্রণয়ন করেছি। সরকার অনুমোদন দিলে চরের মানুষের উন্নয়নে আলাদা বোর্ডের মাধ্যমেই সেবা দেয়া সম্ভব হবে।’
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন