উপকূলে মৃত্যুর মিছিলের ৪৭ বছর

আজ ১২ নভেম্বর। ১৯৭০ সালের এই দিনে এই ভুখণ্ডে আঘাত হেনেছিল শক্তিশালী এক ঘূর্ণিঝড়। যার নাম ‘ভোলা সাইক্লোন’। এর আঘাতে হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানিসহ মারা গেছে অসংখ্য গৃহপালিত ও বন্য পশু। নষ্ট হয়েছে হাজার হাজার হেক্টর জমির ফসল। দুমড়ে-মুচরে গেছে ঘরবাড়ি, জীবন ও জনপদ। মৃত্যুর মিছিল দেখে ছিল গোটা বিশ্ব। সেই ঘূর্ণিঝড়ে বেঁচে যাওয়া মানুষগুলোর জীবন থেকে কেটে গেল ৪৭ বছর। যারা তখন যুবক ছিলেন তারা এখন বৃদ্ধ। মনের মাঝে এই দিনটির দগদগে আঘাত এখনো বয়ে বেড়াচ্ছেন উপকূলে বসবাসরত সেসব মানুষ। দিনটিকে কেন্দ্র করে সমগ্র উপকূলে দাবি উঠেছে এই দিনটাকে ‘উপকূল দিবস’ হিসেবে পালনের।
.
সাংবাদিক রফিকুল ইসলাম মন্টুর দিক-নির্দেশনায় এ বছর ১২ নভেম্বর (আজ) উপকূলের ১৫ জেলার ৩২ উপজেলার ৩৪ স্থানে প্রথমবারের মতো পালিত হচ্ছে ‘উপকূল দিবস’। বেসরকারি উদ্যোগে পালিত হওয়া এটিই প্রথম উপকূল দিবস।

১৯৭০ এর ১২ নভেম্বরের প্রলয়ংকরী ‘ভোলা সাইক্লোন’ নামের ওই ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণহানি ঘটেছিল প্রায় পাঁচ লাখ লোকের। উপকূল বাংলাদেশের একটি প্রতিবেদন বলছে, এটি সিম্পসন স্কেলে ক্যাটাগরি তিন মাত্রার ঘূর্ণিঝড় ছিল। যা এ পর্যন্ত বাংলাদেশের ভুখণ্ডে রেকর্ডকৃত ঘূর্ণিঝড়সমূহের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়।

সূত্রের তথ্য মতে, ওই ঘূর্ণিঝড়টি ৮ নভেম্বর বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট হয়। ক্রমশ শক্তিশালী হতে হতে এটি উত্তর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ১১ নভেম্বর এটির সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ১৮৫ কিলোমিটারে পৌঁছায়। ওই রাতেই উপকূলে আঘাত হানে। জলোচ্ছ্বাসের কারণে উপকূলীয় অঞ্চল ও দ্বীপসমূহ প্লাবিত হয়। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ছিল ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলা।

ওই সময় সেখানকার এক লাখ ৬৭ হাজার মানুষের মধ্যে ৭৭ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। ওই ঘূর্ণিঝড়ে তৎকালীন বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। দ্বীপচরসহ বহু এলাকার ঘরবাড়ি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। উপকূল অঞ্চলের বহু এলাকা মানবশূন্য জনপদে পরিণত হয়। ঘরবাড়ি হারিয়ে পথে বসেন হাতিয়া, রামগতি, চর আব্দুল্লাহ, সন্দ্বীপ, ঢালচর, চর জব্বার, তজুমুদ্দিন, চর কচ্ছপিয়া, চর পাতিলা, কুকরী কুমড়ী, মনপুরা, চরফ্যাশন, দৌলতখাঁন, ভোলা, বরগুনা, পটুয়াখালী ও চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষ।

উপকূলবাসী আজও ভুলে যায়নি সেই দিনের কথা। স্বজন হারানোর বেদনা। ঘরের মেঝেতে বসে সন্তান হারানো সেই মা আজও সারারাত কাঁদেন। এই দিন আসলেই চোখের ঘুম চলে যায় সেইসব বোনের যার চোখের সামনে দিয়েই জলোচ্ছ্বাস ভাসিয়ে নিয়েছিল তার একমাত্র আদরের ছোট ভাইটাকে।

বরিশাল জেলার মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার উলানিয়া গ্রামে বর্তমানে বসবাসকারী একজন বৃদ্ধ হামিদ মিয়া। কাজের সূত্রে আসা যাওয়া হয় বরগুনায়। ৭০’এ তার ঠিকানা ছিল ভোলার তজুমুদ্দিন। বরগুনার এক চায়ের দোকানে প্রতিবেদকের সাথে তার পরিচয় ঘটে। এ বিষয় কথা বলতে গেলে এক সময় কেঁদে ফেলেন হামিদ মিয়া। তিনি বলেন, ‘নিজের ভাইয়ের লাশটা সেদিন খুঁজে পাইনি, তয় শত শত লাশ মাটি চাপা দিছি হেই দিন। কত মানুষ যে পাগলের মতো তাগোর স্বজনগুলারে খোজ্জে (খুঁজেছে) সেই দৃশ্য বইলা বুঝান যাইবে না। মনে হইছে, যেন কোন কেয়ামতের মাঠ।’

এখনো অরক্ষিত উপকূল। উপকূলীয় মানুষের জীবনধারার উন্নয়ন, সংকটের উত্তরণ এবং সম্ভাবনাময় উপকূলকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অংশীদার করার তাগিদে হলেও একটি উপকূল দিবস প্রয়োজন। তাছাড়াও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে প্রতিনিয়ত ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে উপকূলীয় জীবন যাত্রা। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর কার্বন নিঃরসনের প্রভাব ফেলছে আমাদের জলবায়ুতে। এসব প্রতিরোধে সমগ্র বিশ্বের পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণে উপকূল দিবস ঘোষণা জরুরি বলে মনে করছেন উপকূলে বসবাসরত সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা।

পরিবেশবাদীরা বলছেন, দেশ, মানুষ, সরকার, রাজনীতি, সমাজনীতিকে কেন্দ্র করে হাজারটা দিবস পালনের রেওয়াজ থাকলেও উপকূলের জন্য তো আজও ঘোষিত হয়নি একটি বিশেষ দিন। রাষ্ট্রীয় অনেক আয়োজিত দিবসগুলোর মতোই উপকূলবাসীর জন্য একটি দিবসের আয়োজন এখন সময়ের দাবি।

বাংলাদেশে এই প্রথমবারের মতো উপকূল দিবস বাস্তবায়ন কমিটির আহবানে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের প্রায় ১০০ সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান দিবস পালনে এগিয়ে এসেছে। এর মধ্যে রয়েছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা, গণমাধ্যকর্মীদের সংগঠন, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান, কিশোর-তরুণদের ফোরাম ইত্যাদি। দিবস পালনের প্রধান উদ্যোক্তা হিসেবে রয়েছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান উপকূল বাংলাদেশ, কোস্টাল জার্নালিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ ও আলোকযাত্রা দল।

এ বিষয়ে কথা হলে বরগুনার স্থানীয় সাংবাদিক সুমন শিকদার বলেন, ‘অন্তত এই দিনটাকে কেন্দ্র করে হলেও দেশের সরকার, সুশীল সমাজ, মিডিয়া ও উন্নয়ন সংগঠনগুলোর নজর পড়তে পারে দুঃখ গাঁথা উপকূলের দিকে। আর ১৯৭০ এর ১২ নভেম্বরের প্রলয়ংকরী ‘ভোলা সাইক্লোন’কে স্মরণ করে উপকূলবাসীর জন্য সবচেয়ে শোকের দিন হিসেবে পরিচিত ১২ নভেম্বরই ঘোষিত হতে পারে উপকূল দিবস।’

এত দিবসের ভিড়ে উপকূলের জন্য একটি পৃথক দিবস প্রসঙ্গে উদ্যোগের সঙ্গে উপকূল দিবস বাস্তবায়ন কমিটির কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী সাংবাদিক রফিকুল ইসলাম মন্টু বলেন, ‘উপকূলের প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ প্রতিনিয়ত বহুমূখী দুর্যোগের সঙ্গে বসবাস করেন। কেবল দুর্যোগ এলেই এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীর খবরাখবর গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়। কিন্তু স্বাভাবিক সময়েও তাদের জীবন যে কতটা অস্বাভাবিক, সে বিষয়ে খুব একটা খোঁজ রাখা হয় না। উপকূলের দিকে গণমাধ্যম ও নীতিনির্ধারকদের নজর বাড়িয়ে উপকূলবাসীর জীবনমান উন্নয়ন ঘটানোই উপকূলের জন্য একটি দিবস প্রস্তাবের মূল লক্ষ্য।’