এক সময়ে আওয়ামী লীগের আন্দোলন-সংগ্রামের ‘ভ্যানগার্ড’ যুবলীগ এখন নির্জীব
মুখ থুবড়ে পড়েছে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন আওয়ামী যুবলীগ। দুই বছর মেয়াদের জেলা কমিটি ৩১ বছর পার করলেও সম্মেলনের খবর নেই। মহানগর-উপজেলাতেও বেহাল অবস্থা। সাংগঠনিক কার্যক্রমের চেয়ে অন্যকাজে ব্যস্ত কেন্দ্রের শীর্ষ নেতারা। কমিটিতে কে কোন পদ পাবেন তা নির্ধারণে নাক গলানোর অভিযোগ রয়েছে যুবলীগের এক শীর্ষ নেতার স্ত্রীর বিরুদ্ধে।
এক সময়ে আওয়ামী লীগের আন্দোলন-সংগ্রামের ‘ভ্যানগার্ড’ যুবলীগ এখন নির্জীব। সংগঠনের ৭৮টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে ৫৭টির নেই কোনো সাংগঠনিক কার্যক্রম। দিবস ভিত্তিক কর্মসূচিতেই সীমাবদ্ধ তারা। বর্তমান কমিটি দায়িত্ব গ্রহণের পর কিছু জেলা কমিটি দিলেও সম্মেলন স্থলে কমিটি ঘোষণা করেনি। নেতারা ঢাকায় ফিরে সম্মেলনের কয়েক মাস পর ‘ফেসবুক’ কমিটি ঘোষণা করেন। ‘আদুভাই’ দের হাত থেকে সংগঠনকে বাঁচাতে কেন্দ্রের উদ্যোগ না থাকায় হতাশ পদপ্রত্যাশী নেতারা।
সংগঠনের বেহাল অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান নিখিল বলেন, ‘অনেক জেলায় দীর্ঘদিন সম্মেলন হয় না। সেগুলোসহ ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণেরও সম্মেলন হওয়া দরকার। বর্তমানে রমজানের কারণে আমরা সাংগঠনিক সম্মেলনে হাত দিচ্ছি না। ঈদের পর সংগঠনে সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব নিয়ে আসবে। আশা করি সংগঠন গতিশীল হবে।’
জানা গেছে, ১৯৯৩ সালের ১৯ নভেম্বর গঠন হয়েছিল বরিশাল জেলা যুবলীগের কমিটি। জাকির হোসেনকে সভাপতি ও ফজলুল করীম শাহীনকে সাধারণ সম্পাদক করে গঠিত দুই বছর মেয়াদি কমিটি পার করেছে ৩১ বছর।
ই কমিটির সভাপতি-সম্পাদকসহ শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা এখন জেলা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পদে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। মো. জাকির হোসেন বর্তমানে বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং ফজলুল করিম শাহীন রয়েছেন তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক পদে। এর বাইরে আরও কয়েকজন যুবলীগ নেতার নাম রয়েছে জেলা আওয়ামী লীগের কমিটিতে। এ ছাড়া মৃত্যুবরণ করেছেন কয়েকজন।
কমিটির অনেকে আবার রাজনীতি থেকে সরে গিয়েছেন। জেলার অধীনস্ত ১০টি উপজেলা এবং ৬টি পৌরসভা ইউনিটেও যুবলীগের কার্যক্রম চলছে ‘আদুভাই’দের নেতৃত্বে। ২০০৪ সালে ৪১ সদস্যের বরিশাল মহানগর যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। দুই দফা কো-অপ্ট করে কমিটির আকার বাড়ানো হয় ৭১ জন। এর পরেও বরিশাল জেলা ও মহানগর যুবলীগের নতুন কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেই কেন্দ্রের। ফলে নতুন নেতৃত্ব যেমন বিকাশ ঘটছে না, তেমনি মেয়াদ উত্তীর্ণ কমিটির সাংগঠনিক কার্যক্রমেও চলছে স্থবিরতা।
জানা গেছে, ১৯৯৮ সালে নাটোর জেলা যুবলীগের সর্বশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে ডেলিগেটরদের সরাসরি ভোটে শরিফুল ইসলাম রমজান সভাপতি নির্বাচিত হলেও সাধারণ সম্পাদক পদে বর্তমান সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুল ও সৈয়দ মোস্তাক আলী মুকুল সমান সংখ্যক ভোট পাওয়ায় কমিটি ঘোষণা স্থগিত হয়। প্রায় দুই বছর পর ২০০০ সালে শফিকুল ইসলাম শিমুলকে সাধারণ সম্পাদক করে জেলা যুবলীগের কমিটি অনুমোদন করে কেন্দ্রীয় যুবলীগ। পরবর্তীতে শিমুল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
এরপর সভাপতি শরিফুল ইসলাম রজমানও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এরকম একটা অবস্থায় চলছে যুবলীগের কার্যক্রম। পরে কমিটির সহসভাপতি বাশিরুর রহমান খান এহিয়া চৌধুরীকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমিন বিপ্লবকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব অর্পণ করে কেন্দ্রীয় কমিটি। সংগঠনের নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরে সম্মেলন না হওয়ায় সংগঠনের কার্যক্রমে কোনো গতি নেই। কিশোরগঞ্জ জেলা যুবলীগের সর্বশেষ ২০১২ সালের জুলাই মাসের ৩ তারিখ আমিনুল ইসলাম বকুলকে আহ্বায়ক, মীর আমিনুল ইসলাম সোহেল ও রুহুল আমিন খানকে যুগ্ম আহ্বায়ক করে ৫১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি দেওয়া হয়।
৯০ দিনের আহ্বায়ক কমিটি বর্তমানে প্রায় ১২ বছর পেরিয়ে গেলেও আর জেলা যুবলীগের কমিটি হয়নি। বর্তমান কমিটির আহ্বায়ক আমিনুল ইসলাম বকুল জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন। দীর্ঘ সময় ধরে জেলা যুবলীগ মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ায় যুবলীগের রাজনীতি থেকে নিষ্ক্রিয় হয়েছেন জেলার অনেক নেতা। শরীয়তপুর জেলা যুবলীগ সূত্র জানায়, ২০০৫ সালে শরীয়তপুর জেলা যুবলীগের সম্মেলন করা হয়। ওই সম্মেলনে এম এম জাহাঙ্গীরকে সভাপতি, গোলাম মোস্তফাকে সহসভাপতি ও নুহুন মাদবরকে সাধারণ সম্পাদক করে ৭১ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটির সভাপতি এম এম জাহাঙ্গীর ২০১৯ সালে পৌরসভা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সহসভাপতি গোলাম মোস্তফা সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান।
যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক কাওসার আহমেদ তকি জেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক। দীর্ঘ ১৯ বছরেও আর সম্মেলন বা নতুন কমিটি করা হয়নি। কেউ দেশের বাইরে আবার কেউ মারা গেছেন। দীর্ঘ সময়ে নতুন কমিটি গঠিত না হওয়ায় নেতা-কর্মীরা হতাশ হয়ে পড়েছেন। নীলফামারী জেলা যুবলীগের সর্বশেষ সম্মেলন হয় ২০০৫ সালে। অ্যাডভোকেট রমেন্দ্র বর্ধন বাপ্পিকে সভাপতি ও শাহিদ মাহমুদকে সাধারণ সম্পাদক করে এ কমিটি করা হয়। জেলা যুবলীগের সভাপতি জেলা আওয়ামী লীগের কমিটিতে আছেন। সংগঠন পুরোদমে ঝিমিয়ে পড়েছে। কমিটির অন্যান্য সদস্যারাও সংগঠনের কোনো কর্মসূচিতে আসেন না। মাত্র সাত-আটজন নেতা সক্রিয় রয়েছেন।
উপজেলাগুলোর সঙ্গেও জেলা কমিটির সম্পর্ক ভালো নয়। ২০১৬ সালে কক্সবাজার জেলা যুবলীগের সম্মেলন করা হয়। ২০২৩ সালের জুনে পৌরসভা নির্বাচনে জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক শহিদুল হক সোহেল নৌকার বিরোধিতা করায় তাকে বহিষ্কার করা হয়। পরবর্তীতে প্রেসরিলিজের মাধ্যমে কমিটি ভেঙে দিয়ে পদপ্রত্যাশীদের কাছে জীবনবৃত্তান্ত আহ্বান করা হয়। দীর্ঘ সময়ও পদপ্রত্যাশীদের অপেক্ষা ফুরাচ্ছে না। স্থানীয় নেতারা জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় এক শীর্ষ নেতার স্ত্রীর পছন্দ না হওয়ার কমিটি গঠন করতে দেরি হচ্ছে।
২০১২ সালের ১৪ জুলাই যুবলীগের ষষ্ঠ জাতীয় কংগ্রেসের আগে ওই বছরের ৩ জুলাই ঢাকা দক্ষিণ এবং ৮ জুলাই উত্তরের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তখন উত্তরে মাইনুল হোসেন খান নিখিল সভাপতি ও ইসমাইল হোসেন সাধারণ সম্পাদক এবং দক্ষিণে ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট সভাপতি ও ওয়াহিদুল আলম আরিফ সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। বর্তমানে রাজধানীর দুই মহানগরের এই সংগঠনে তিন নেতা রয়েছেন ভারপ্রাপ্ত। একসময়ে ঢাকায় যে কোনো কর্মসূচি সফল করতে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগ মুখ্য ভূমিকা পালন করতেন। বর্তমানে ঢাকার কর্মসূচি সফল করতে ঢাকার বাইরে থেকে লোক নিয়ে আসা হয়। ২০১৯ সালের ২৩ নভেম্বর যুবলীগের সপ্তম জাতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়।
কিন্তু এই জাতীয় কংগ্রেসের আগে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ যুবলীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়নি। সে অনুযায়ী প্রায় ৭ বছর আগে ঢাকার দুই কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে। সম্পদ অর্জনে এগিয়ে থাকলেও সাংগঠনিকভাবে ততটাই পিছিয়ে বগুড়ার যুবলীগ। সম্মেলনের প্রায় ৭ বছর পর বগুড়ায় যুবলীগের ১০১ সদস্যবিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়। তবে সে কমিটিতে রয়েছেন হত্যা মামলাসহ একাধিক মামলার আসামি। জেলার উপজেলা কমিটিগুলোর সম্মেলন হয় না দীর্ঘসময় ধরে।
বগুড়া শহর ও সদর উপজেলার কমিটির সর্বশেষ সম্মেলন কবে হয়েছে তা অনেকেই জানে না। তবে ২০০০ সালের পর আর সম্মেলন হয়নি। এ ছাড়া মেয়াদোত্তীর্ণ আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে চলছে গাজীপুর জেলা ও মহানগর, ফরিদপুর, জয়পুরহাট, সাতক্ষীরা, কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, পাবনা, সিলেট জেলা ও মহানগর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, গাইবান্ধা, নারায়ণগঞ্জ জেলা ও মহানগর, ময়মনসিংহ জেলা ও মহানগর, নেত্রকোনা, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, পাবনা, নোয়াখালী, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, দিনাজপুর, নওগাঁসহ মোট ৫৭টি সাংগঠনিক জেলার কমিটি। এসব জেলা-মহানগর যুবলীগের রাজনীতি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন