এখনও অধরা মানবতাবিরোধী ২৩ অপরাধী

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এটি গঠনের পর এখন পর্যন্ত রায় ঘোষিত হয়েছে ২৯টি মামলার। এসব মামলার আসামির সংখ্যা ৫৭।

২৯ মামলায় ৫৭ আসামির মধ্যে দেশে ও বিদেশে পলাতক আছেন ২৩ জন। ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর ছয় বছর অতিক্রম হয়েছে। এখনও অধরা রয়েছেন পলাতক এসব মানবতাবিরোধী।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২৩ আসামির মধ্যে ট্রাইব্যুনালে রায় ঘোষণার আগেই পালিয়ে যান অনেকে। তাদের পলাতক দেখিয়ে বিচার শুরু হয়। বর্তমানে তারা কোথায় আছেন সেই তথ্যও নেই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে।

তবে, সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, পলাতক ২৩ আসামির মধ্যে হাতেগোনা চার/পাঁচজনের তথ্য রয়েছে তাদের কাছে। কিন্তু তাদের দেশে ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকরের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তেমন তৎপরতা এখন পর্যন্ত লক্ষ্য করা যায়নি।

যেসব অপরাধী বিদেশে আছেন
ট্রাইব্যুনালের রায়ে প্রথম মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি জামায়াতের সাবেক রোকন মাওলানা আবুল কালাম আযাদ পালিয়ে বর্তমানে পাকিস্তানে অবস্থান করছেন।

মাওলানা আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পরপরই ভারতে পালিয়ে যান। সেখান থেকে পাকিস্তানে চলে যান তিনি।

কুখ্যাত রাজাকার ও আলবদর সদস্য চৌধুরী মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খানকে বুদ্ধিজীবী হত্যাসহ কয়েকটি অপরাধে ট্রাইব্যুনাল ২০১৩ সালের ৩ নভেম্বর মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন। তারা অনেক আগেই যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে যান। বিদেশে থেকেও ট্রাইব্যুনালের বিচারের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছেন তারা। সরকারের পক্ষ থেকে বারবার তাদের দেশে ফেরত আনার কথা বলা হলেও তা সম্ভব হয়নি।

এছাড়া কিশোরগঞ্জের হাসান আলী ওরফে হাসান এবং ফরিদপুরের জাহিদ হোসেন ওরফে খোকন রাজাকারও বিদেশে পালিয়ে গেছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। তারাও মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত আসামি।

দণ্ডপ্রাপ্ত অন্যান্য অপরাধীর অবস্থান জানা নেই
শীর্ষস্থানীয় মানবতাবিরোধীদের বিচারের পর দেশের বিভিন্ন স্থানের অপরাধীদের বিচার শুরু হয়। কক্সবাজার, জামালপুর, বাগেরহাট, কিশোরগঞ্জসহ দেশের অন্যান্য স্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত শুরু হওয়ার পরই ওইসব এলাকার চিহ্নিত আসামিরা পালিয়ে যান। পরবর্তীতে তাদের অনুপস্থিতিতেই বিচার শেষ হয়।

২০১৪ সালের ২৭ নভেম্বর কিশোরগঞ্জের চার মানবতাবিরোধীর ফাঁসির নির্দেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। একজনকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়া হয়। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন- অ্যাডভোকেট শামসুদ্দিন আহমেদ, তার ভাই ক্যাপ্টেন (অব.) নাসির উদ্দিন আহমেদ, রাজাকার কমান্ডার গাজী আবদুল মান্নান ও হাফিজ উদ্দিন। আমৃত্যু কারাদণ্ডে দণ্ডিত আসামি হলেন আজহারুল ইসলাম। অ্যাডভোকেট শামসুদ্দিন ছাড়া বাকি চার আসামিই বর্তমানে পলাতক রয়েছেন।

একই বছরের ১৮ জুলাই জামালপুরের তিনজনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেয়া একই রায়ে আরও পাঁচজনকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়া হয়। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত তিন রাজাকার হলেন- আশরাফ হোসেন, আবদুল মান্নান ও আবদুল বারী। আমৃত্যু কারাদণ্ডে দণ্ডিত আসামিরা হলেন- অ্যাডভোকেট শামসুল হক ওরফে বদর ভাই, এস এম ইউসুফ আলী, শরীফ আহমেদ ওরফে শরীফ হোসেন, আবুল হাশেম ও মো. হারুন। ওই আট রাজাকারের মধ্যে শামসুল হক ও ইউসুফ কারাগারে আছেন। বাকি ছয়জনই পলাতক রয়েছেন। তাদের অনুপস্থিতিতে বিচারকাজ শেষ হয়।

২০১৪ সালের ১৩ নভেম্বর খোকন রাজাকার এবং ২০১৫ সালের ৯ জুন হাসেন আলীর বিরুদ্ধে মামলার রায় ঘোষণা করা হয়। তদন্তের সময়ই তারা পালিয়ে যান বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।

২০১৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার জাতীয় পার্টির নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার আবদুল জব্বারকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়া হয়। কারাদণ্ডের বোঝা মাথায় নিয়েই তিনি পলাতক রয়েছেন। এখন তিনি কোথায় আছেন তা কেউ জানে না। এদিকে তার ফাঁসি চেয়ে সরকার সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করেছে।

আরও বেশ কয়েকটি মামলার আসামিরা পলাতক রয়েছেন। তাদের মধ্যে যশোর জাতীয় পার্টির নেতা সাখাওয়াত হোসেনসহ আটজনের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা হয়েছে। আট আসামির মধ্যে সাখাওয়াত হোসেন ও বিল্লাল হোসেন কারাগারে আছেন। বাকি ছয়জন পলাতক রয়েছেন। পলাতকরা হলেন- ইব্রাহিম হোসেন ওরফে ঘুঙ্গুর ইব্রাহিম, শেখ মোহাম্মদ মুজিবুর রহমান, মো. আ. আজিজ সরদার, আবদুল আজিজ সরদার, কাজী অহিদুল ইসলাম ওরফে কাজী ওহিদুস সালাম ও আবদুল খালেক মোড়ল।

বিদেশ থেকে ফিরিয়ে আনার তৎপরতা নিয়ে প্রশ্ন
ট্রাইব্যুনালের রায়ে শাস্তি পাওয়া আসামি বা ব্যক্তিদের ফিরিয়ে আনার কোনো ফলপ্রসু উদ্যোগও দৃশ্যত চোখে পড়ছে না। আত্মগোপনে থাকাদের মধ্যে মামলায় নাম আছে, শুধু তাদের সংখ্যাই জানাতে পেরেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

দণ্ডপ্রাপ্ত ২৩ আসামি ছাড়া অন্তত ৭০ থেকে ৮০ জন পালিয়ে গেছেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে। অনেকে দেশে আত্মগোপন করে আছেন, আবার বিদেশে পাড়ি দেয়ার সংখ্যাও কম নয়। একে একে দীর্ঘ সময় ধরে কুখ্যাত এসব রাজাকার-আলবদর আত্মগোপনে চলে গেলেও তাদের ধরে আটক রাখা বা বিদেশে পালিয়ে যাওয়া রোধে কার্যকর কোনো উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি।

বিদেশে পালিয়ে থাকা একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের ফিরিয়ে আনতে টাস্কফোর্স গঠন করা হলেও এখন পর্যন্ত কাউকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে তদন্তকালে যারা এলাকা ছেড়ে পালিয়েছেন তাদের গ্রেফতারের জন্য মনিটরিং সেল গঠন করা হলেও তাতে কোনো কাজ হয়নি।

সুপ্রিম কোর্টে নিষ্পত্তি ও শুনানির অপেক্ষায় যেসব আপিল

২৯ মামলার রায়ের পর সাজার দণ্ড থেকে খালাস চেয়ে ২৫ অপরাধী আপিল করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে। এর মধ্যে রিভিউসহ সাতটি আপিলের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়েছে। এখন পর্যন্ত শীর্ষ ছয় আসামির ফাঁসির দণ্ড কার্যকর করেছে সরকার।

বাকি এক আসামি সাঈদীর মামলার রিভিউ নিষ্পত্তি করার পর অপেক্ষা এখন রায় প্রকাশের। অপর দুই আপিল শুনানির সময় আসামিরা মারা যাওয়াই মামলা অকার্যকর ঘোষণা করা হয়েছে। বাকি সব আপিলের শুনানি অপেক্ষায় রয়েছে।

পলাতকদের বিষয়ে বিশিষ্টজনের মতামত
বিশিষ্টজনদের মতে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সেল, প্রসিকিউশন টিম ও পুলিশ প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয় নেই বলেই একাত্তরে দেশ ও মানুষের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া এসব ভয়ঙ্কর অপরাধী পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। যেসব অপরাধীর বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে তাদের বেশির ভাগই এলাকা ছেড়েছে বলে জানা গেছে। তাদের অনেকেই পুলিশ প্রশাসন ও স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনীতিকদের সহযোগিতা নিয়ে পালিয়েছে- এমনও অভিযোগ রয়েছে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান খান বলেন, ‘একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে দায়ের করা মামলার আসামিদের মধ্যে ২৩ জন পালাতক রয়েছেন। আশঙ্কা করি, তাদের অনেকে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। তবে এ সংখ্যা বলার কোনো উপায় নেই।’

একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘একাত্তরে বেশ কয়েকজন আলোচিত শীর্ষ মানবতাবিরোধী অপরাধীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। তারা প্রভাবশালী, অনেকে এখন বিদেশে পলাতক। তাদের ফিরিয়ে আনতে সরকার একটি তদারকি সেল গঠন করেছে। এর আগে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিদেশ থেকে ফিরিয়ে আনতেও একটি উচ্চপর্যায়ের টাস্কফোর্স গঠন হয়েছিল। ওই টাস্কফোর্স যেমন অকার্যকর ভূমিকা পালন করছে, তেমনি পলাতক দণ্ডিত রাজাকারদের দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে তদারকি সেলও অকার্যকর ভূমিকা পালন করছে। এ কমিটি শুধু কাগজে-কলমে, তাদের কোনো কার্যক্রম দেখা যায় না। তাই পলাতক মানবতাবিরোধীরা নিরাপদেই আছে বলা যায়।’

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রানাদাস গুপ্ত জানান, ট্রাইব্যুনালের রায়ের পরও পুলিশের নির্লিপ্ততার কারণে মানবতাবিরোধী আসামিরা গ্রেফতার হচ্ছে না। পলাতকদের গ্রেফতার করে সাজা কার্যকর করতে সরকার একটি মনিটরিং সেল গঠনের নির্দেশ দেয়। সেই নির্দেশের পর পুলিশ সদর দপ্তর একটি কমিটিও গঠন করে। কিন্তু ওই কমিটির কার্যক্রমে কোনো অগ্রগতি নেই। যারা পালিয়েছে রায়ের পর তাদের কাউকে এখন পর্যন্ত গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, যারা দেশের বাইরে পালিয়েছে তাদের ফেরত আনতে মন্ত্রণালয়ও একটি তদারকি সেল ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে গঠন করে। ওই সেল গঠন হওয়ার পর ওই বছর সেপ্টেম্বরে একটি সভা হয়। সভায় কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি, ইন্টারপোলের সহায়তা নেয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত বিদেশে পালিয়ে থাকা অভিযুক্ত বা রায়ে দণ্ডিত কাউকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি।

২০১০ সালের ২৫ মার্চ একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িতদের বিচার করার জন্য গঠন করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। প্রথম দিকে শীর্ষস্থানীয় অপরাধীদের বিচার করতে তদন্ত শুরু হয়। কুখ্যাতদের মধ্যে জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতা গোলাম আযম, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, কামারুজ্জামান, আবদুল কাদের মোল্লা, মতিউর রহমান নিজামী, মাওলানা আবদুস সুবহান, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী, চৌধুরী মঈনুদ্দীন, আশরাফুজ্জামান খান, আবুল কালাম আযাদ, মীর কাশেম আলী প্রমুখের বিচার প্রথম দিকে শুরু হয়। তাদের বিচার শেষে ছয়জনের দণ্ড কার্যকর হয়।

ট্রাইব্যুনালের প্রথম রায়ে ফরিদপুরের মাওলানা আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের তদন্ত শেষ হওয়ার পর গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির সঙ্গে সঙ্গে পালিয়ে যান তিনি।