এরশাদের মৃত্যুতে কী বলছেন নব্বইয়ের নেতারা?

নব্বইয়ের উত্তাল দিনগুলোতে মহাসড়কে তারা গলা ফাটিয়েছেন। মিছিলে মিছিলে প্রকম্পিত করেছেন রাজপথ। বুকের ঠিক মাঝখান দিয়ে বুলেট উড়ে এসে রাউফুন বসুনিয়ার মতো মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেও কিছু করার ছিলো না। কিন্তু মৃত্যুর ভয়ে দমে যাননি, স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতনের জন্য বুক চিতিয়ে দিয়েছিলেন সময়ের সেরা ছাত্রনেতারা।

যার বিরুদ্ধে ছিল সেই আন্দোলন তিনি সেই সময়ের স্বৈরাচারী শাসক, কথিত রাজনীতিক দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এবং জোর করে রাষ্ট্রপতির পদ দখল করা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। রোববার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন তিনি। তবে পৃথিবীর অন্যসব স্বৈরাচারের মতো নির্মম পরিণতি ভোগ করতে হয়নি তাকে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি এই স্বৈরাচার ক্ষমতা হারালো জীবনের শেষদিনটি পর্যন্ত দেশের রাষ্ট্রক্ষমতার অন্যতম প্রভাবক হিসেবে থেকেছেন।

সাবেক এ স্বৈরশাসক এরশাদের মৃত্যুতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোনো ধরনের পরিবর্তন বা প্রভাব দেখতে পান জানতে চাওয়া হয়েছিল নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা ও বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতা অসীম কুমার উকিল এবং সাবেক জাসদ নেতা শফী আহমদের কাছে।

এরশাদের প্রথম জানাযা

অসীম কুমার উকিল বলেন, আমি সর্বপ্রথম তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করছি এবং তার শোক সন্ত্রস্ত পরিবারকে সমবেদনা জানাচ্ছি। বাংলাদেশে আলোচিত নাম এরশাদ। তার হাত ধরে রাজনীতিতে যে ক্ষতগুলো তৈরি হয়েছিলো, যেগুলো আমরা এখনো শক্তিশালী করার জন্য কাজ করছি। যদিও সেগুলো শুরু করেছিলেন জিয়াউর রহমান। এরশাদ সেটাকে আরো শক্তিশালী করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে তার রাজনীতি, সংসদে যাওয়া, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে ভূমিকা দেশের জন্য ভালো কিছু ছিলো বলবো। তার মৃত্যুতে দেশের রাজনীতিতে কিছুকাল প্রভাব দেখা যাবে।

নব্বই পরবর্তী সময়ে তার ভূমিকা দিয়ে তবে কি তার স্বৈরাচারী শাসনের অপকর্মগুলো আড়াল করা যাবে-এমন প্রশ্নে অসীম কুমার উকিল বলেন, না না। তা কখনো আড়াল করা যাবে না। তিনি একজন স্বৈরাচারী শাসক ছিলেন। এটা কখনো মুছা যাবে না।

একই প্রশ্নে বেশ কড়াভাবে উত্তর দিয়েছেন এক সময়ের জাসদ নেতা ও বর্তমানে আওয়ামী লীগ নেতা শফী আহমদ।

তিনি বলেন, `এরশাদের মৃত্যুতে বর্তমানে একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া কাজ করছে। কারণ, নব্বই সনের ঘটনা বর্তমান প্রজন্ম জানে না। ১৯৯০ সনে এরশাদের পতনের পর থেকে এরশাদ কোনো না কোনোভাবে আলোচিত হয়ে আসছেন। তাকে সকল রাজনীতিক দল; যারা ক্ষমতায় আছে বা গেছে তারা বিভিন্ন সময় ব্যবহার করেছে। এরপরও এরশাদের জাতীয় পার্টির বাংলাদেশে তেমন কোনো রাজনৈতিক অবস্থান নাই। এরশাদের অবর্তমানে বেগম রওশন এরশাদ বা জিএম কাদেররা এটাকে রাজনীতিকভাবে সামনের দিকে আর এগিয়ে নিতে পারবে না। এটি দিনে দিনে একটি ক্ষুদ্র রাজনীতিক শক্তিতে পরিণত হবে।’

স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের এই নেতা বলেন, এরশাদের ৯ বছরের শাসন আমলে যে রক্তপাত ঘটেছে, যে অত্যাচার-নিযাতন চালিয়েছেন তিনি, জনগণের আন্দোলনে যে আঘাত করেছেন, তাতে তার স্বৈরাচারীর যে প্রলেপ আছে এটা কোনোদিনই মুছবে না। উনি একাধারে রাজনীতিকে দূষিত করেছেন এবং সমাজকে দূষিত করেছেন। তার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগও আছে, কবি না হয়েও তিনি কবি। বিভিন্ন কবিকে দিয়ে উনি কবিতা লিখিয়েছেন। উনার নামে সেটা ছাপিয়েছেন। আরো অভিযোগ আছে যে, প্রেমিক এরশাদ। উনার কিন্তু প্রেমের কাহিনীর শেষ নাই। যাকেই উনার নজরে পড়েছে তাকেই কোনো না কোনোভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে করাত্ত্ব করেছেন। এই ইস্যু ধরেই আমাদের পটুয়া কামরুল হাসান জাতীয় কবিতা পরিষদে লিখেছিলেন, ‘বিশ্ব বেহায়ার খপ্পরে আজ বাংলাদেশ।’

“এই খেতাবাটাই উনার জন্য। যদিও উনি বিরোধী দলীয় নেতা, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত কিংবা যতোই উনি পাঁচটি আসন থেকে জিতুন না কেন, এগুলো আর ঢাকা পড়ার কোনো কারণ নাই”-বলেন শফী আহমদ।

তিনি বলেন, এরশাদ সাহেব মারা গেছেন। তার ওপর আমাদের তো কোনো ব্যক্তিগত ক্ষোভ নাই। আমরা রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে গণতান্ত্রিক কাঠামোতে আনতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমরা পুরোপুরি সক্ষম হইনি। গণতন্ত্র এখনো সেভাবে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। দেখুন এরশাদ বাংলাদেশের ক্ষতিটা করেছেন। আমরা যদি নব্বইয়ে তাকে পতন না ঘটাতাম, তাহলে রাষ্ট্রটিই থাকতো না। আমরা ১৯৭১ সালে ত্রিশ লক্ষ শহিদের বিনিময়ে যে দেশ স্বাধীন করলাম ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ, তিনি সে দেশটিকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করে সংবিধানে স্থাপন করলেন, যা অপূরণীয় ক্ষতি দেশের জন্য।

শফী আহমদ বলেন, ইদানিং কোথাও তার প্রশংসা শুনি যে, তিনি দেশের জন্য কি যেন করেছেন। হ্যাঁ, উনি যে কাজগুলো করেছেন যেমন, উপজেলা নাম দিয়ে সরাসরি বিকেন্দ্রিকরণ করেছেন। তাছাড়া তিনি উপজেলা পর্যায়ে ম্যাজিস্ট্রেসি কোর্ট চালু করেছেন। যা পরে অন্য সরকার এসে তুলে দিয়েছে। এটা বাংলাদেশে সংবিধানে নেই। তিনি শুরু থেকেই তো সংবিধান লংঘন করেছেন। তারপর শিক্ষানীতি; যেটি একেবারেই সাম্প্রদায়িক নীতি। যেটা দেশকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে গেছে।

“অর্থাৎ রাষ্ট্রকে মৌলবাদি রাষ্ট্র এর দিকে ঠেলে দেওয়ার জন্য উনার যা যা করার সবই করেছেন। আর আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য তাকে সমর্থন দিয়েছিলো। আপনি জানতে চেয়েছেন রাজনীতিতে তার প্রভাব কতোটুকু থাকবে, তার এককথায় উত্তর হলো, বাংলাদেশের রাজনীতিতে তার প্রভাব থাকার কোনো কারণ নাই।”

এই বিষয়ে এরশাদের শাসন ও বর্তমান শাসনের মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখেন না বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা মো: হাবিবুর রহমান হাবিব। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম এই নেতা মনে করেন, আগের স্বৈরাচারী সরকারের চেয়ে বর্তমানের সরকার আরো ভয়ংকর।

এরশাদের মৃত্যুতে দেশের রাজনীতিতে কোন ধরনের প্রভাব পড়বে এমন প্রশ্নে ছাত্রলীগের সাবেক এই সভাপতি বলেন, একজন বয়স্ক ব্যক্তির বার্ধক্যজনিত মৃত্যু কি আর প্রভাব পড়বে! তাকে জাতীয়তাবাদী শক্তির ঐক্যের বিরুদ্ধে তাকে ব্যবহার করা হতো। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী শক্তি ঐক্যবদ্ধ। দেশের মানুষ বিশ্বাস করে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে একটি মাত্র দল, সেটি হলো বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী শক্তি। এর বিকল্প আর কেউ নাই।

তিনি বলেন, এরশাদের স্বৈরাচারের চেয়ে বর্তমান সরকারের আরো গতি বেড়ে গেছে। আরো ভয়ংকরভাবে চলছে দেশ। বর্তমান শাসক আর অতীতের স্বৈরাচার একাকার হয়ে গেছে।

‘‘আপনার বক্তব্য অনুযায়ী বিষয়টি দেশের রাজনীতিতে কতোটা প্রভাব ফেলতে পারে এমন প্রশ্নে হাবিবুর রহমান হাবিব বলেন, আমার বক্তব্য হলো একজন সামরিক শাসক, যিনি নির্বাচিত রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে ক্ষমতা নিয়ে দীর্ঘ ৯ বছর শাসন পরিচালনা করেছেন। সেই শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র সমাজ ঐক্যবদ্ধ হয়ে তার পতন ঘটিয়েছিলো। এটাই তো আমাদের গণতন্ত্র রক্ষার জন্য আন্দোলন ও সফলতা। কিন্তু এখনো আমাদের গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা হুমকির মুখে। গণতন্ত্র তো নাই, একেবারে একদলীয় শাসনের মতো দেশ চলছে। এখান থেকে দেশ ও জাতি মুক্তি চায়।’’ সৌজন্যে : চ্যানেল আই অনলাইন।