এসএসসি রেজাল্ট এবং উৎকণ্ঠায় একদিন

এইচ. এম নুর আলম : সময় তখন ২০০৮ সাল। থাকি লজিংবাড়িতে, এক ভদ্রলোকের বাসায়।ভদ্রলোকের বাড়ির তখন তিনটি রুম। একটিতে ভদ্রলোক ও তাঁর স্ত্রী, আরেক রুমে তাঁর ছেলে-মেয়ে এবং অপর রুমে আমি।আমি পড়তাম মাদরাসায়-লালমনিরহাট নেছারিয়া কামিল এমএ মাদরাসা।বাড়ি সদর থেকে চার কিমি দূরে হলেও লেখাপড়ার সুবিধা আর দৈন্যতায় শহরেই থেকেছি প্রায় ৮ বছর। যখন আমি মাদরাসায় দাখিল (এসএসসি)এ পড়ি তখন শহরের প্রাণকেন্দ্রেই সেই ভদ্রলোকের বাসায় পড়াতাম এবং থাকতাম-এক প্রকার লজিং সিস্টেমে। ভদ্রলোকের তিন মেয়ে এবং এক ছেলে। বড় মেয়ে তখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়তো। আমি পড়াতাম অপর দুই মেয়ে ও ছেলেকে। ভদ্রলোক অনেক ভালো ছিলো এবং সংসার অনেক ভালো চলতো। প্রথমে প্রাইভেট পড়ানোর সিদ্ধান্ত থাকলেও পড়ে তাঁর বাসায় থেকে তাঁর সন্তানদের পড়াতে শুরু করি।

সময়ের পরিক্রমায় পরীক্ষা চলে আসে অনেক কাছাকাছি। খুব মনোযোগ সহকারে পড়তে বসি। যেন রাত-দিন একাকার। কখন কাটে বুঝতেই পারিনা।আমার চাচা(আব্বার বড় ভাই-আমরা চাচা বলেই ডাকতাম) তখন ওখানকার মসজিদের মুয়াজ্জ্বিন ছিলেন। তাঁর মাধ্যমেই মূলত আমার সেখানে থাকা। দেখতে দেখতেই পরীক্ষা চলে আসে। আমিও মন সংযোগ করি ভালোভাবে পরীক্ষাগুলো দিতে। পরীক্ষার রাতেও অনেকক্ষণ ধরে পড়তাম, উদ্দেশ্য এ প্লাস অর্জন। কারণ, আমার পরিবার, শিক্ষক সবারই প্রত্যাশা আমি গোল্ডেন এ প্লাস না হলেও অন্তত এ প্লাস পাবো। আর আমার প্রত্যাশারও কোনো কমতি নেই। তাই, প্রাণপণে পড়ে পরীক্ষাগুলো দেই।তখন সবসময় আমাকে সাপোর্ট দিতেন আমার চাচা(তিনি ২০০৮ সালে ক্যান্সার রোগে মারা যান)। পড়াশুনা আর পরিশ্রমে পরীক্ষাগুলো শেষ হয় কচ্ছপ গতিতে।শুরু হয় উৎকন্ঠার দিন।

সে সময় এসএসসি পরীক্ষা শেষ হবার তিনমাসের মধ্যে ফলাফল প্রকাশ হতো যদিও এখন তেমন সময় লাগেনা।আর এখন সিস্টেমও অনেকখানি পরিবর্তন হয়েছে। পরীক্ষা প্রদানের সময়ও কমে এসেছে। আগে পরীক্ষা দিতেই লেগেছে দেড়/দুইমাস।

ঠিক ফলাফল ঘোষণার দিন। সকাল থেকেই দ্বিগুণ বেগে উৎকন্ঠা বেড়ে চলছে-কি যে হয়! কারণ, স্বপ্নে দেখেছিলাম, আমি জিপিএ ৪.১৮ পেয়েছি। তাই, উৎকন্ঠার শেষ নেই। রেজাল্টের দিন একপ্রকার খাওয়া-দাওয়া ছেড়েই দিলাম। বিছানায় শুয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলাম। রেজাল্ট আনতে যেতে হবে মাদরাসায়। সবাই গিয়েছে আমি ছাড়া। সকাল পার হয়ে দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। আমার ভয় আর উৎকন্ঠা যেন আরো বেড়ে চলছে। কেউ এমন নেই যে, আমাকে শান্তনা দিবে।তাই মুষড়ে পড়েছি। যাই হোক, পাশের এক পরিচিত নাম সুজন। তাকে বললাম, ভাই, আমার রেজাল্টটা নিয়ে আসেন। আমি রেজাল্ট আনতে যাবোনা। আর আপনি না আসা পর্যন্ত আমি বিছানা থেকে উঠবোনা।

দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে, বিকাল হয়ে গেলো, তবুও দুপুরের খাবার খাচ্ছিনা বলে বাড়ির আন্টিও মন খারাপ করেছে। কিন্তু রেজাল্টের ব্যাপারটি তিনি জানতেন না।আমিও বলিনি তাকে। এক সময় বিকেল হলো কিন্তু রেজাল্টের খবর জানতে পারলাম না।আমার বুকের হার্টবিট বেড়েই চলছে।পবিত্র আসর নামাজের আজান দিলে বের হলাম নামাজের জন্য। কিন্তু রাস্তায় দেখি গ্রামের কয়েকজন আন্টি দাঁড়িয়ে রয়েছে রাস্তা। আমাকে দেখে তাঁরা জিজ্ঞাস করলো, বাবা! তোমার রেজাল্ট কী? আমি লজ্জায়, ভয়ে আর উৎকন্ঠায় বললাম, আন্টি আমিতো রেজাল্ট শুনতে যাইনি। এ কথা শুনে তাঁরা বললো, সবাই রেজাল্ট নিয়ে আসলো, আর তুমি এখনও জানো না!আমি উত্তর না দিয়ে মসজিদে নামাজ পড়তে গেলাম।নামাজ পড়ে আল্লাহকে বললাম, হে আল্লাহ! আমাকে অপমাণিত করোনা, আমার পরিবার, প্রতিবেশি আর শিক্ষকরা আমার কাছে এ প্লাস প্রত্যিাশা করে, খারাপ রেজাল্ট নয়। নামাজ শেষে আবারো এসে না খেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম।

সকাল শেষ হয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল। অপেক্ষার প্রহর শেষ হলেও রেজাল্ট আসছেনা।যাকে পাঠিয়েছি সেও আসছেনা। সন্ধ্যার আগে আসলো সুজন সাহেব, যাকে রেজাল্ট আনার জন্য পাঠিয়েছি। তখনও আমি না খেয়ে মন ভার করে বিছানায় শুয়ে আছি আর ফুঁপিয়ে কাঁদছি। সুজন এসে আমাকে বললো, ভাই রেজাল্ট পেয়েছেন? আমি বললাম, না। সে তখন বললো, আপনি এ প্লাস পেয়েছেন। এ কথা শুনে আমি সব উৎকন্ঠা ঝেড়ে ফেলে বিছানা থেকে উঠলাম এবং দুপুরের রাখা ভাত সামান্য খেয়ে নিলাম। এর মধ্যে সবাই জেনে গেছে আমার ফলাফল এবং বাড়ির আন্টিও জেনে গেছে আমার সারাদিন না খেয়ে থাকার রহস্য।

আন্টি এবার বেজায় খুশি। তিনিও আরেকজনের কাছে গল্প করছিলেন, হামার ছাওয়াটা (আমাদের বাড়িতে থাকা ছেলেটা) ভালো রেজাল্ট করেছে। আমি আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে খবরটা দেওয়ার জন্য বাড়ির দিকে রওয়ানা হলাম। সত্যিকার অর্থে রেজাল্টের দিন যে উৎকন্ঠা আর ভয় কাজ করে, তা একজন পরীক্ষার্থী ব্যতীত আর কেউ উপলব্ধি করতে পারে না। ঐ দিন পেটে যায়না কোনো খাবার, সব সময় ভয় কাজ করে মনে।

এই উৎকন্ঠার একদিন কখনও ভুলবোনা আমি।এই উৎকন্ঠা থাকলেও প্রতিটি শিক্ষার্থী যেন ফেল না করে, ভালো ফলাফল উপহার দেয় জাতিকে।এই প্রার্থনাই থাকবে স্রষ্টার কাছে আর প্রত্যাশা থাকবে শিক্ষার্থীর কাছ থেকে। রেজাল্টের জন্য যেন কোনো শিক্ষার্থীকে আত্মহত্যার পথ বেছে না নিতে হয়, এ ব্যাপারে পরিবারের সচেতন থাকতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থা এমন করতে হবে যেন শিক্ষার্থীরা ভালো রেজাল্ট করে মেধা আর পরিশ্রম দিয়ে।

লেখক: শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক।