করোনার ধরন বদলে গেছে, আক্রান্ত হলে কেউ প্রকাশ করছে না

বাসার গেটে হুট করে বাড়তি করোনা সতর্কতা দেখে সন্দেহ হয় সেলিম সাহেবের। গেটে দায়িত্বশীলদের জিজ্ঞেস করতে জানতে পারেন— অ্যাপার্টমেন্টে অন্তত ১২ জন করোনা আক্রান্ত এবং সেটি গত দুই সপ্তাহ ধরে। কেন তাদের জানানো হয়নি, বা আরও আগে সতর্ক করা হয়নি জানতে চাইলে তাকে বলা হয়, উনারা ফ্ল্যাটওনার। জানাতে নিষেধ করেছিলেন। কিছু বললে সেটা মানতে হয় আমাদের। তাহলে এখন কেন বাড়তি সতর্কতা? সেটা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হলে তাদের কাছে নেই কোনও সদুত্তর।

রাজধানীতে স্বাভাবিক জীবনযাপন শুরুর পর থেকে যতই সতর্ক থেকে সীমিত চলাচল করতে বলা হোক, তেমন কেউই মানছেন না এই নির্দেশনা। এরমধ্যে সংক্রমণের ধরন বদলে গেছে। আর যিনি সংক্রমিত হচ্ছেন, তিনি নানাভাবে সেই খবর চেপে রেখে আরও স্বাভাবিক থাকতে চেষ্টা করছেন। বেশিরভাগ অ্যাপার্টমেন্ট-বাসাবাড়িতে করোনা রোগী থাকলে সেটা অন্য নিবাসীদের জানানো হচ্ছে না। মানুষ কিছু দিন আগেও সতর্ক থেকে করোনা হলে জানানো, কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে সেই বাড়ি লকডাউনের ব্যবস্থাসহ বেশ কিছু উদ্যোগ নিলেও এখন এসবের বালাই নেই। এমনকি প্রতিবেশীদের সুস্থ রাখতে অন্তত বিষয়টি যে জানানো দরকার, সেটাও যেন ভুলে গেছে! আর এতে করে সংক্রমণের শঙ্কা বাড়ছে।

আগারগাঁওয়ের একটি বহুতল ভবনে ৫০টি পরিবার থাকে। করোনার শুরু থেকেই (মার্চের মাঝামাঝি) বাড়ির মালিকরা বসে সিদ্ধান্ত নেন কোনও কাজের সহযোগী, কোনও ড্রাইভারকে অ্যাপার্টমেন্টের ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। আগস্টের শুরু থেকে এই বিধিনিষেধ উঠিয়ে দেওয়া হয়। যতদিন বাইরের কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি, ততদিন আশপাশের বেশ কিছু বিল্ডিংয়ে করোনার খবর পাওয়া গেলেও, এই ৫০ পরিবারের সদস্যরা অনেকটাই নিশ্চিন্তে ছিলেন। কিন্তু সাধারণ ছুটি উঠিয়ে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অফিসে বা কর্মস্থলে যাতায়াত শুরু হয় এই পরিবারগুলোর সদস্যদের। ফলে কাজের সাহায্যকারীদেরও প্রবেশে বাধা নেই। এই অবস্থার মধ্যে কারও করোনা হয়েছে এমনটা শুনতে অস্বস্তি হয়। সেই অ্যাপার্টমেন্টে ছয় জনকে করোনা পজিটিভ শনাক্ত করা হয়েছে। চিকিৎসকরা বলছেন, শুরু থেকেই লক্ষণবিহীন রোগীর সংখ্যা যেখানে বেশি, সেখানে এ ধরনের লুকোচুরি মহাবিপদের সংকেত বলা যেতে পারে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা স্বাক্ষরিত করোনা-বিষয়ক নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ৩৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত করোনায় মোট মারা গেছেন পাঁচ হাজার ৩০৫ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় শনাক্ত হয়েছেন এক হাজার ৩৯৬ জন, আর এ পর্যন্ত শনাক্ত হয়েছেন তিন লাখ ৬৬ হাজার ৩৮৩ জন।

অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান বলেন, ‘মানুষের ভেতরে সচেতনতা কমেছে, সেটা একেবারে সাদা চোখেই দেখা যাচ্ছে। করোনা নিয়ে মানুষের ভয় কমেছে, উদাসীনতা বেড়েছে। অথচ এটা যে ঝুঁকি কতটা বাড়াচ্ছে, সেটা কেউ বুঝছে না। অ্যাপার্টমেন্টগুলোতে আগে হাত ধোয়ার জন্য ব্যবস্থা ছিল, সেগুলোও উধাও হয়ে গিয়েছে। শুরু থেকেই সামাজিক দূরত্ব মানার কথা বলে হয়েছে, সেটা শুরুতে মানা হলেও মানুষ এখন সব ভুলতে বসেছে। সেই সঙ্গে যেটা সমস্যা বেড়েছে—বড় বড় অট্টালিকাতে যোগাযোগ কম থাকার কারণে এখন আর কেউ কাউকে বলছে না।’ অনেক বাসায় হেল্পিং হ্যান্ডদের যাতায়াত বেড়েছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘মানুষ এই ভুলগুলো করছে, যেটা করার কথা ছিল না। এতে সংক্রমণের শঙ্কা বাড়ছে। মনে রাখা উচিত, লক্ষণবিহীন করোনা রোগীর সংখ্যাই বেশি।’

হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালের চেয়ারম্যান এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘এখন ধীরে ধীরে এই সমস্যাগুলো প্রকট হবে। যখন সবাই মিলে বিপদে ছিলাম তখন অন্যজন যেন সুস্থ থাকে, সেই চেষ্টাও করেছে মানুষ। কিন্তু এখন একেবারেই লুকোনোর মতো নেতিবাচক ঘটনার দিকে যেতে হচ্ছে।’ তিনি মনে করেন, করোনা টেস্টের পরে শনাক্ত যে বাসায় পাওয়া যাবে, সেই বাসাটা লকডাউন করা সরকারের কর্তব্য। সেটি না করতে পারলে মানুষ নিজে থেকে সতর্ক হবে, এমনটা ভাবা যাচ্ছে না। নিউ নর্মাল জীবনেরও নিয়ম আছে। সেসব পালন করতে ব্যক্তিকে বাধ্য করতে হবে। কেননা, করোনা আজকে চলে যাবে বা দুই মাস থাকবে, এটাতো সুনিশ্চিত করে কেউ বলে দিতে পারছে না।